মইদুল ইসলামকে চেনেন ? এঁদের কথা ভুলেও কি কখনো লিখবে আনন্দবাজার ? বর্তমান ? এই সময় ? এঁদের জন্য ভুলেও ‘ঘণ্টা খানেক’, ‘ক্রস ফায়ার’, ‘জনতার দরবার’ আসবে এ বি পি আনন্দে ? ২৪ ঘণ্টায় ? নিউজ ১৮এ ?

মইদুল ইসলামকে চেনেন ?

সাম্প্রতিক কালের সব ধরনের শিক্ষক আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ । শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের আহ্বায়ক । থাকেন দক্ষিণ ২৪ পরগণায় । শিক্ষকতা করেন হেলিয়াগাছি এফ পি স্কুলে । এস এস কে, এম এস কে, পার্শ্ব শিক্ষক পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের অসহায়, প্রাপ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্বে দেন মানুষটি ।

সম্প্রতি বিকাশ ভবনের সামনে একটি অভিনব আন্দোলন করেছিলেন বেশ কয়েক জন অসহায় শিক্ষক নিয়ে । নিখোঁজ ব্রাত্য বসু, শিক্ষা মন্ত্রীর খোঁজ চাই পোস্টার নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন বেশ কিছু মহিলা শিক্ষিকাকে । পুলিশ দেরী করেনি । প্রায় চ্যাং দোলা করে মহিলাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল বিধাননগর পুলিশ । সেই পুলিশ যাঁরা নিজেরাও জানেন রাজ্যের এখনকার শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বেশির ভাগ সময়টা কাটে এখন ত্রিপুরায় গিয়ে মন দিয়ে অভিনয়টা করতে । বিকাশ ভবনে মন নেই । বিকাশ ভবনের লিফট ম্যানও জানেন সে ইতিহাস ।

মহিদুল সেখানেই ঘা টা মেরেছিলেন ।

ঠিক তার পরের দিন মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নবান্নে মহিদুল একদল শিক্ষিকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে । শান্তিপূর্ন প্রতিবাদ হলে কি হবে ! মুখ পুড়েছিল নবান্নের । সারা বিশ্ব জানার সুযোগ পেয়েছিল প্রায় ৭৫ হাজার এস এস কে, এম এস কে, অস্থায়ী শিক্ষক শিক্ষিকা কি নিদারুণ যন্ত্রণায় এই রাজ্যে নাম মাত্র দক্ষিনা পেয়ে শিক্ষক পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছেন । বহির্বিশ্ব জানতে পেরেছিল এ রাজ্যে ৪৫ হাজার পার্শ্ব শিক্ষকদের কি নির্মম ভাবে ঠকানো হয় । কেন্দ্র থেকেও যে টাকা আসে তাও এঁদের দেওয়া হয় না । রাজ্যের দেওটাও নয় । আর এস এস কে, এম এস কে এ রাজ্যে সারা ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে সব থেকে কম টাকা পাওয়া শিক্ষক । তাঁরাই নেমেছিলেন পথে, হাতে শুধু কিছু পোস্টার নিয়ে ।

মইদুলদের এই অভিনব শান্তিপূর্ন প্রতিবাদ মুহূর্তেই সেদিন ডিজিটাল দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় । ব্যাস ! আমায় অপমান ? আমার কীর্তি নিয়ে intellectual মস্করা ! আঁতে লাগে মুখ্যমন্ত্রীর । তারপর কি ঘটে শুনুন ।

এঁদের সবাইকে ধরে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে । মহিলাদের ছেড়ে দিয়েও কালীঘাটের নির্দেশে তাঁদের বাড়ি রাত দেড়টা, দুটোর সময় আবার হানা দেয় রাজ্য পুলিশ । আর মইদুল কে নিয়ে গুন্ডা দমন শাখার ২২/ ২৪ জনের বাহিনী রওনা দেয় ঝাড়গ্রাম । মাঝ রাতে সেখানে নিয়ে গিয়ে এফ আই আর করানো হয় তাঁর নামে ।

ভাবুন, মহিদুল শান্তিপূর্ন আন্দোলন করলেন হাওড়ায় । হাওড়ার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল । কলকাতার পুলিশ তাঁকে জেলে ঢোকালো । তারপর ঝাড়গ্রামে নিয়ে গিয়ে ঝাড়গ্রাম পুলিশ গরাদে ঢুকিয়ে এফ আই আর করল । ভোর রাত পর্যন্ত এস পি পর্যন্ত বসে রইলেন থানায় । কেস সাজালেন মাথা ঘামিয়ে । জজ সাহেবও বুঝলেন । দু দিন জেল খেটে শেষে জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরে মহিদুল পেলেন এক আজব নোটিশ ।

কি নোটিশ শুনবেন ?

পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সেক্রেটারি আর সি বাগচী ১৯ আগস্ট তাঁকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার হেলিয়াগাচি এফ পি স্কুল থেকে তাঁকে চারশো কিলোমিটার দূরের কুচবিহারে হলদিবাড়ির বিবিগঞ্জ জুনিয়র বেসিক প্রাইমারি স্কুলে বদলি করা হয়েছে ।

আর নবান্নের দুয়ারে হাজির হওয়া বাকি মহিলাদের ? তাঁদের কি গতি করা হয়েছে ?

মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা থেকে আসা হত দরিদ্র এস এস কে শিক্ষিকা ফজিলা তুমেশাকে মুর্শিদাবাদ থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনে ট্রান্সফার করা হয়েছে ।

মুর্শিদাবাদে জিয়াগঞ্জের থেকে আসা এস এস কে শিক্ষিকা ছবি চাকী দাস হাজরাকে জলপাইগুড়ি মালএ ট্রান্সফার করা হয়েছে ।

পশ্চিম মেদনিপুরের সালবনিতে চাকুরীরত খুব গরীব ঘরের এস এস কে শিক্ষিকা জ্যোৎস্না টুডুকে জলপাইগুড়ির ধূপগুরিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে ।

পূর্ব মেদনিপুরের মহিসাদলে চাকুরীরত অত্যন্ত দুঃস্থ শিক্ষিকা শিখা দাসকে দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরে ট্রান্সফার অর্ডার ধরানো হয়েছে ।

দক্ষিণ ২৪ পরগণার নামখানা স্কুলে কর্মরত পুতুল মণ্ডলকে ট্রান্সফার করা হয়েছে কুচবিহারের দিনহাটায় ।

মেমো নাম্বার ২৫২/১০৪/এডমিন/PBRSSM/2021 জারি করে এই কীর্তি করেছে নবান্ন চুপচাপ । কেউ যাতে কোনদিন স্পর্ধা না দেখায় নবান্নের দুয়ারে যেতে । প্রাপ্য না চাইতে । চমকে, ধমকে, রগড়ে ।

ভাবুন যে এস এস কে, এম এস কে শিক্ষিকারা এখন এ রাজ্যে এতটাই কম মাইনে পান ভাড়া বাড়িতে থাকলে ঘর ভাড়া দিলে তাঁদের দু বেলা খাবার জোটে না সেই মানুষ গুলোকে ট্রান্সফার করা হয়েছে দুশো, তিনশো, চারশো কিলোমিটার দূরের অজানা, অচেনা নির্জন সব স্থানে, স্কুলে ।

এই মানুষ গুলোর অপরাধ ? এঁরা প্রাপ্য অর্থ, মর্যাদা চাইতে গিয়েছিলেন নবান্নে । একজন শিক্ষক হিসেবে সমাজে অধিকার নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন ভদ্রভাবে ।

বিনিময়ে নবান্ন থেকে কি পেলেন ? যা পেলেন তার অপর নাম তো স্রেফ মৃত্যু পরোয়ানা ।

এঁরা আর কথা বলবেন ভুলেও কোনোদিন ? খেতে না পেলেও, প্রাপ্য না দিলেও কোনোদিন রা কাড়বেন ?

ঠিক এইভাবে এই বাংলায় কত কত অধিকার লুঠ হয়ে যায় প্রতি ঘন্টায়, প্রতিদিন, কেউ কখনো একবারও ভেবে দেখেছেন ? মুহূর্তের জন্যেও ?

এঁদের কথা ভুলেও কি কখনো লিখবে আনন্দবাজার ? বর্তমান ? এই সময় ?
এঁদের জন্য ভুলেও ‘ঘণ্টা খানেক’, ‘ক্রস ফায়ার’, ‘জনতার দরবার’ আসবে এ বি পি আনন্দে ? ২৪ ঘণ্টায় ? নিউজ ১৮এ ?

উত্তরটা খুবই সহজ, উত্তরটাও সবারই জানা, প্রশ্নটা করাই শুধু নিরর্থক ।

ঠিক কি না ?

সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (৯৮৩০৪২৬০৭৮)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.