ভারতে নানা ধর্ম, ধর্মাচরণের বিবিধ পদ্ধতি, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে যে সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতার ভাব দেখা যায়, তার প্রেক্ষাপটে রয়েছে সনাতন ধর্মের শিক্ষা। ভারতবাসী বিশ্বাস করে ঈশ্বর আস্তিক-নাস্তিক, জ্ঞানী-মূর্খ সকলের হৃদয়ে বিরাজমান রয়েছেন। এই অনুভব থেকেই এসেছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা—যা স্বামী বিবেকানন্দ গর্বের সাথে বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়েছেন। কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব নয়—সনাতন ধর্মের ভ্রাতৃত্ব সকল মানুষের জন্য। পরধর্ম সহিষ্ণুতার এরকম উদাহরণ বিরল।
প্রাচীন ভারতের সহিষ্ণুতানীতির ঐতিহ্যবাহী ভারতকে বারবার বহিঃশত্রুদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে ধর্মস্থান, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নামে জোর করে ইসলাম ও পরবর্তীকালে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে দরিদ্র বনবাসী এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের। আজও ধর্মান্তরকরণের কাজ অবাধে চলছে উত্তর-পূর্ব ভারতে, ওড়িশা এবং কেরল রাজ্যে। এ নিয়ে কখনো কখনো অশান্তির খবরও আসছে। ছদ্ম সেকুলাররা এ বিষয়ে নীরব। অথচ হিন্দু সংগঠনগুলি যখন প্রলোভনে ভোলা ধর্মান্তরিত এই গরিব মানুষগুলিকে স্বধর্মে ফিরে আসার আহবান জানায় ঘর-ওয়াপসির মাধ্যমে, তখন এই নীরব আন্তর্জাতিকতাবাদী মোড়লরা রে রে করে ওঠেন। তবে, ধর্মান্তর বিরোধী আইন প্রণয়নের কথা উঠলেই এরা চুপসে যান।
ভারতের মুক্তি সংগ্রামের সময় আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সংকীর্ণতা এবং আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের মানুষ। লক্ষ্য অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা। হিন্দু মুসলমান ঐক্যে যাতে চিড় না ধরে তা নিশ্চিত করতে মহাত্মা গান্ধী মুসলমানদের ধর্মীয় এজেন্ডা ‘খিলাফত আন্দোলন’ সমর্থন করলেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন না। এজন্য গান্ধীজীকে তোষণ রাজনীতির প্রবক্তা বলা যায়। যদিও ‘তোষণ এবং বিভাজন’ এই রাজনীতি আমদানি করে ব্রিটিশরা। ১৯০৫ সালে বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ভাঙ্গার জন্য ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ মদতে ১৯০৬ সালে ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাকে আর্থিক ও নৈতিক সাহায্য দিয়ে মুসলিম লিগের জন্ম দেওয়া হয়। ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট গভর্নর হেয়ার সাহেব তখন ঢাকায় কর্মরত। তার উদ্যোগেই ভারতীয়দের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতির উদ্বোধন ঘটে। পিছনের সারিতে চলে যায় জাতীয় সংহতি। অনতিবিলম্বে মুসলিম লিগ মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি ‘পাকিস্তান’ দাবির স্বপক্ষে ভারতীয় কমিউনিস্টদের পাশে পায়। বর্তমান ভারতবর্ষে সংগঠিত সন্ত্রাস, জাতি-দাঙ্গা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইত্যাকার সমস্যার মূলে রয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের বিষময় ফল। ভারতীয় কমিউনিস্টরা অবশ্য মুসলিম লিগের পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করে মুসলমানদের ‘Right of self determination’ মোড়কে-অর্থাৎ মুসলমানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। অথচ, মুসলিম লিগ নেতারা হিন্দুদের ব্যাপারে কী ধরনের মনোভাব পোষণ করতেন তা গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেলের একটি উক্তিতে প্রতিফলিত হয়। আমি ভাবতে পারি না ক্যাবিনেট মিশনে সুরাবর্দির হিন্দু বিরোধী ভূমিকার পরেও এরকম একজন ব্যক্তির সঙ্গে কী করে যুক্ত বাংলার প্রস্তাব দেন শরৎচন্দ্র বসুর মতো লোকেরা।
বামপন্থী এবং ক্ষমতালিঙ্গু কংগ্রেস মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি মেনে পাকিস্তান প্রস্তাবে রাজি হলেও, হিন্দুদের রক্ষাকবচের কোনো ব্যবস্থা করেনি। বাঙ্গালি হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য ভবিষ্যত দ্রষ্টা রাজনীতিক ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রয়াসে পাকিস্তানের হাত থেকে পশ্চিমবাংলাকে ছিনিয়ে আনা হয় বাংলা ভাগ করে—তা না হলে যুক্ত বাংলায় হিন্দুদের অবস্থা হতো কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মতো। কলিকাতা হাতে না পাওয়ার খেদ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহ, তাঁর মতে তারা পেয়েছেন পোকায়-কাটা পাকিস্তান। আজ সেই পশ্চিমবঙ্গ-পশ্চিম বাংলাদেশ হবে কি হবে, বাঙ্গালিদের তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে, ১৯৩৭ সালে ফজলুল হককে সমর্থন না করে, বাংলার কংগ্রেস মুসলিম লিগের ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেয়। তারপর আর মুসলিম লিগকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখনো সময় আছে, জাতীয়তা বিরোধীদের মদত না দিয়ে জাতীয় সংহতি’র কথা ভাবার।
ঐতিহ্যগতভাবেই ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতার শেকড় গ্রথিত রয়েছে ভারতের সংস্কৃতিতে এবং দর্শনে। ভারতের ৮৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু বলে তাদের পরিচয় দিলেও, নির্দিষ্ট কোনও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নন, তাদের ধর্মীয় কার্যকলাপ কতগুলি আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর। পালন করা না করা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র আচারভিত্তিক না হয়ে, বর্তমানে আনুষ্ঠানিক বা উদ্যাপনের রূপ নিয়েছে। যেখানে অংশগ্রহণ অবারিত, ‘বসুধৈব কুটুম্বক ধাঁচের। অর্থাৎ হিন্দুধর্ম কোনো রেজিমেন্টেড রিলিজিয়ন না হয়ে এক উদার পরমত সহিষ্ণু ধর্মে পরিণত হয়েছে। একেবারেই নিরীহ ধর্ম, তাই বারবার ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে হিন্দু ধর্মকে। বর্তমানে এক ধরনের হিন্দুদের মধ্যে যে নিস্পৃহ মানসিকতা লক্ষ্য করা যায় যা তা নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে কি না, সমাজবিজ্ঞানীরা ভেবে দেখতে পারেন।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধে সেকুলার শব্দটি যোগ করেন। পৃথিবীর কোনও দেশেই এই ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি খুঁজে পাওয়া যাবে না—এমনকী পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলিতেও নয়। তার মানে কিন্তু এই নয় ওই সমস্ত দেশের সরকার ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ১৯৭৬ সালের আগে ভারতের সংবিধানে ওই শব্দটি যুক্ত ছিল না। তার মানে কি দেশ ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না? এহেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকেও ১৯৮৩ সালে একটি মাইনরিটি ডেপুটেশনকে বলতে শোনা যায়, “Minorities can not claim to be safe by constantly irritating the majority.’’ শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে সংখ্যালঘুদেরও ভূমিকা নিতে হবে, একথার মানে তো তাই দাঁড়ায়। মুসলমানদের জন্য আলাদা Civil Code বজায় রাখার দাবি জাতীয় সংহতির অন্তরায় নয় কি?
গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো এবং তার সফল রূপায়ণ ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় সংহতির পরিপূরক। প্রাচীন ভারতে রাজতন্ত্রে প্রজাদের জন্য দায়বদ্ধতা এবং তাদের জন্য নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাজন্যবর্গের দুশ্চিন্তা ও সহযোগিতা ধর্মীয় ঐতিহ্যের অঙ্গ ছিল। যা বর্তমানে ভারতবর্ষে বহুলাংশে বিরল। জনগণের টাকা লুট এবং দুর্নীতির মাধ্যমে ক্যাডার পুষে রাজনৈতিক ক্ষমতা আগলে রাখার পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। জনসেবার নামে ‘রাজনীতি’ জনগণের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। এরাই আবার ক্ষমতাচ্যুত হলে নিরীহ গিনিপিগে পরিণত হয় কিছুদিনের জন্য। আবার দল বদলের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসে, এটাই সাধারণের অভিজ্ঞতা। এরা যখন ক্ষমতায় থাকেন প্রচারের আলোতে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেদের ‘সার্বভৌম’ এবং সবজান্তা মনে করেন। আর সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবেন। যে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে হিংসায় ২৯ জনের মৃত্যু হয়, ৫৭৩টি বুথে পুনর্নির্বাচন করতে হয় হিংসা ও বুথ দখলের ঘটনায়, যেখানে প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হয় ধর্ষণ এবং মৃত্যু দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে বা সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে, সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, তাঁর রাজ্য শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ স্থান। অথচ ভারতের ৫টি রাজ্যে ডিসেম্বরে বিধানসভার ভোটে একজনেরও মৃত্যুর খবর নেই, কেবলমাত্র ছত্তিশগড়ে ভোটের আগে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর মাওবাদী হামলা এবং জীবনহানির ঘটনা ছাড়া। এ রাজ্যে পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতায় যত্রতত্র বিষমদের ঠেকগুলিতে বিষপান করে মৃত্যু ঘটছে গরিব মানুষের, জনগণের করের টাকায় ক্ষতিপূরণ দিয়ে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে ‘মদ নিষিদ্ধ করে সামাজিক সুস্থিতি ফিরিয়ে দিচ্ছে সরকার। ভোট রাজনীতি না করে সরকার প্রশাসনিক দক্ষতা দেখালে জনগণ উপকৃত হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি প্রসঙ্গে ৯০-এর দশকের প্রথমদিকের একটি ঘটনা উল্লেখ্য। পশ্চিমবঙ্গে বাস-মালিকরা বাস ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন করছেন। ১/২ দিন বাস ধর্মঘটও হয়েছে। বামফ্রন্টের ম্যানেজারেরা, বিশেষ করে পরিবহণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর দাবি, কলিকাতায় ৪টাকা ন্যূনতম ভাড়া শুধু ভারতবর্ষেই নয়, পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। এই প্রতিবেদক তার কয়েকদিন আগেই মুম্বাই এবং হায়দরাবাদ শহরে ন্যূনতম ২টাকা ভাড়ায় বাসে চড়ে এসেছেন। আজ হয়তো রবি ঘোষ বেঁচে থাকলে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলতেন, “আস্তে বলুন, শুনলে ঘোড়ায়ও হাইসবো।”
বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতি একটি ফরিবিডেন ফুটে পর্যবসিত হয়েছে। সবাই জানে ওটা থেকে দূরে থাকা কর্তব্য কিন্তু অনেকেই লোভ সামলাতে পারছেন না, তার প্রভাব পড়ছে সমাজ জীবনে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালনে দৃবৃত্তরা নিরীহ, শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষকে উত্যক্ত করছে, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের পরিসরে ঢুকে পড়ছে। তাইতো, নেতাজীর বাড়িতেও তোলাবাজরা স্বগর্বে ঢুকে পড়ার সাহস দেখাচ্ছে। দুর্নীতি এবং অপরাধ যেন সমাজ জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এদের প্রতি ধিক্কার জানানোর মতো মনোবল হারিয়ে ফেলছে মানুষ। এ থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ-প্রতিরোধে। শান্তি-সংস্কৃতি বা গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার পূর্বশর্ত সচেতন মানুষের সাহসিক যোগদান।
(লেখক ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য প্রবন্ধক)
কে. এন. মণ্ডল