।।১।।
পঞ্চনদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে শিখ
নির্মম নির্ভীক।
হাজার কণ্ঠে গুরুজির জয়
ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্।
নূতন জাগিয়া শিখ
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ।
নিজের সর্বস্ব উৎস্বর্গ করে দিয়ে দেশপ্রেম, রাষ্ট্রধর্ম , রাজধর্ম পালন করতে হয়… এইটাই নিয়ম। জনগণই রাষ্ট্র। নিজভূমি রক্ষা করার অর্থ হল নিজের মাকে রক্ষা করা। কিভাবে নিজের সব উজাড় করা যায়?
ধর্ম রক্ষতি রক্ষতে , সেই গুরুর আদেশ শিরধার্য করে কিভাবে তা পালন করতে হয় …?
শত্রুর চোখে চোখ দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ধর্ম ও কর্মের অহংকার প্রকাশ করতে হয় …কিভাবে?
তা যদি কোনো ব্যক্তির নিকট হতে শিক্ষা প্রাপ্ত হতে হয় , তবে তিনি হলেন গুরু গোবিন্দ সিংহের প্রিয়, শক্তিশালী, সাহসী সিংহের ন্যায় বিক্রমকারী শিষ্য বান্দা সিং বাহাদুর ।
হ্যাঁ , বান্দা সিং বাহাদুর , বৈরাগী থেকে যোদ্ধা হয়ে ওঠার এক শক্তিশালী ঐতিহাসিক ব্যক্তি , যিনি সম্পুর্ন জীবন, পরিবার অব কিছুই নিয়োজিত করেছিলেন গুরুবানী ও ধর্ম রক্ষার্থে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুই যুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। যা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মুঘল শাসনের পতনের গুরুত্বপূর্ণ কারন হিসাবে বিবেচিত হয়। এই যুদ্ধগুলি হল – পাঞ্জাবের সিরহিন্দ ও গুরুদাস নংগল যুদ্ধ। এই দুই যুদ্ধের নেতৃত্ব ছিল বীর বান্দা সিং বাহাদুর । বান্দা সিং বাহাদুর এই সংগ্রামের জন্য গুরু গোবিন্দ সিং দ্বারা মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। যে দিনগুলিতে বাবর ভারত আক্রমণ করেছিল, একই সময়ে ভারতের ঐতিহাসিক গুরু পরম্পরার ঐতিহ্য পুনশ্চঃ সূচিত হয়েছিল। যার সূচনা করেছিলেন গুরু নানক দেব।
‘ অলখ নিরঞ্জন ‘
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝন্ঝন্।
পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল,
‘ অলখ নিরঞ্জন! ‘
ভারত তখন মুঘল শাসনে জর্জরিত। যন্ত্রনা , অপমান , লাঞ্ছনার স্বীকার হয়ে চলেছেন হিন্দু, বৌদ্ধ ,শিখরা। হয় ধর্ম ত্যাগ কর। নইলে মর। এই নীতি চলে আসছিল বহু দিন ধরে। এই সময় কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় রাজউরিতে রামদেবের ঘরে জন্মালেন লছমন দাস। কৃষক পরিবার, ক্ষত্রি জাতির একটি ভাগ সোধি বংশের সন্তান লছমন ছোট থেকেই বেশ সাহসী। পাঠশালা, বাবাকে সাহায্য করার থেকে তার ঘোড়া চালানো, কুস্তি, তীরন্দাজি এসবেই বেশি মন যায়।
একদিন চাষার ছেলে লছমন শিকারে গেল জঙ্গলে।সেখানে অনেক হরিণ। সোনার হরিণ চপল হয়ে ছুটে বেড়ায় এদিক ওদিক। একটি হরিণীকে সে দেখল গাছের আড়ালে। ভয়ে লুকিয়েছে বা সে কোনো কারণে দৌড়তে পারছে না। লছমন তীর দাগল তার দিকে। এক, দুই, তিন….শোঁ করে আওয়াজ হল। হরিণী পড়ে গেল। লছমন আর তার বন্ধু এগিয়ে গেল আহত হরিনীর দিকে । একি একি সৱনাশ করেছে? এর যে গর্ভবতী ছিল…ছি ছি কি পাপ…বমি এল লছমনের….শরীর যেন পক্ষাঘাত গ্রস্থ হল। বসে পড়ল সে হরিণীর সামনে…
গুরুদেব পাঠশালায় বাল্মীকি মুনি , বুদ্ধদেব এনাদের গল্প বলেছিলেন। লছমনের মনে পড়ল , এক ব্যাধ দুটো উড়ন্ত হংস জোড়ার একটিকে মেরেছিল, অন্যটি যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছিল। তা দেখে বাল্মীকির বড় কষ্ট হল , তিনি যন্ত্রনায় শ্লোক উচ্চারণ করলেন…এক আহত হংসের যন্ত্রনা দেখে শাক্য সিংহ গৌতমের প্রথম বৈরাগ্য এসেছিল…লছমন তো অনেক বড় পাপ করেছে…নাঃ সে আর ঘরে যাবে না। প্রায়শ্চিত্ত চাই, এই মোহ ,মায়া, হিংসার সংসার থেকে নির্বাণ চাই…সে বনের পথে বিবাগী হল….
বৈরাগী হয়ে সে বনে বনে ,পথে পথে ঘুরতে লাগল। কোথায় মুক্তি মিলবে? নির্বানের পথ কত দূর? কত টা পথ হাঁটলে তবে আত্মার মুক্তি পাওয়া যায়.. একদিন তার দেখা হল জানকিদাস বলে এক সাধুর সাথে। লছমন তাঁকে গুরু মানলেন। শুরু হল ব্রহ্মচর্য জীবন। জানকি বৈরাগী লছমনের নতুন নাম রাখলেন মাধো দাস। বেশ কিছু বছর মাধো দাস কাটালেন কিন্তু আত্মার মুক্তি মিলল না। মাধো সন্ন্যাসী আবার পথে বেরিয়ে পড়লেন। কেউ খেতে দিলে খায়। না পেলে নয়। এখানে ওখানে পড়ে থাকেন।
।।২।।
একদিন তাঁর দেখা হল সন্ন্যাসী রামদাসের সাথে। রামদাস মাধোর মধ্যে যোদ্ধা ও বৈরাগী দুইকেই দেখলেন। সন্ন্যাসী যোদ্ধা করতে হবে। তার পূর্বে কিছু শিক্ষা প্ৰয়জন। রামদাস মাধো দাসকে পরিচয় করালেন সেই আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে যেখানে আত্মার মুক্তি হয় কিন্তু জীবন উৎসর্গ হয় ন্যায় ও সত্যের জন্য। এরপর মাধো নাথ যোগী সাধুদের নিকট যোগসাধনা শিক্ষা লাভ করলেন। যোগী হয়ে তিনি সংসারের মায়া মোহ ত্যাগ করলেন। তারপর গোদাবরী নদীর তীরে এক ছোট্ট কুটির আশ্রম বানিয়ে বাস করতে লাগলেন।
এদিকে ভারতে তখন মুঘল অত্যাচার উত্তরততর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু মধো দাস এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না। তিনি তাঁর বেশিরভাগ সময় তার যোগসাধনে ব্যয় করতেন।
একদিন, গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর দুই পুত্রদের সঙ্গে শিখ কৌমের রক্ষার উদ্দ্যেশে গোদাবরী নদীর তীরে সেই নান্দদ গ্রামে এলেন। এসে লোক মুখে শুনলেন মাধো দাসের আশ্রমের কথা। সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করার বড় ইচ্ছে হল গুরুজীর।
বাবর থেকে আউরঙ্গজেব এই সুদীর্ঘ মুঘল শাসনে , তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজার উত্থান ঘটে। ফলত মুঘল শাসনের ভিত টলতে শুরু করেছিল। এর মধ্যে মেবার অন্যতম। মেবারের রাজা মহারানা প্রতাপ এই কারনে ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। মহারানা প্রতাপের প্রবল প্রতাপ , মাতৃ ভূমির নিমিত্ত ত্যাগ, ধর্মের জন্য লড়াই আজও ভারতীয়দের মনে শক্তি উত্থাপন করে।
১৪৬৯ সালে ভারতের পবিত্র ভূমিতে জন্ম নেন গুরু নানক। ১৫২৬ সালে যখন বাবর ভারত আক্রমন করে তখন গুরুদেব তার সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় , সামাজিক ফলাফলকে উপলব্ধি করেছিলেন। ভবিষৎ প্রজন্মকে রক্ষার নিমিত্ত তাই তিনি রননীতি সহ একটি সাহসী বীর যোদ্ধা কৌমের সৃষ্টি করেন।
গুরু নানক দেবের দ্বারা সূচিত , গুরু পরম্পরার পঞ্চম গুরু ছিলেন গুরু শ্রী অর্জুন সিং । গুরু অর্জুন সিং এর নেতৃত্বে ভারত নতুন করে লড়তে শিখতে শুরু করে। কিন্তু সিংহাসনে বসেই জাহাঙ্গীর আঘাত এনে শিখদের উপর। ১৬০৬ সালে গুরু অর্জুন দেব জি শহীদ হন। এরফলে শিখ কৌম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে। ফলত পাঞ্জাবে একটি মুঘল বিরধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। মুঘল অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ছিল।
দুর্গেশ নন্দিনী
(ক্রমশ)