রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিবাজী উৎসব কবিতায় লিখেছেন, “এক ধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি।” একথা শুধুকবির কল্পনা ছিল না, বাস্তবে শিবাজী মহারাজ তার এই আদর্শকে কাজে রূপায়িত করেছিলেন সেই মধ্যযুগে। ভারতের বেশিরভাগ অংশকে তখন প্রবল প্রতাপান্বিত বিদেশি মোগল রাজশক্তি তার। তরবারির জোরে পদানত করেছে। দার-উল-হরব-কে দার-উলইসলামে পরিণত করার জন্য গোঁড়া, যুদ্ধবাজ, ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ইসলামিক আক্রমণ দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার দিকে ধাবিত হয়েছে। এই ধরনের এক পটভূমিকায় শিবাজীর উত্থান হয় দাক্ষিণাত্যের মহারাষ্ট্রে। শাহজী ভোসলের দ্বিতীয় পুত্র শিবাজীর জন্ম জুন্নার শহরের কাছে শিবনের গিরিদুর্গে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল। তার পরিবারের দাবি অনুযায়ী, তারা রাজা পুরু এবং উদয়পুরের রাণাদের বংশধর। শিবাজীর পিতামহ মালোজী। উদয়পুর। থেকে আগত তার পূর্বপুরুষদের মতো মালোজীও একজন বেতনভুক সৈনিক ছিলেন। তার পিতা শাহজী ভোঁসলে বিজাপুরে ১৬৩৬ সালে চাকুরি নিয়ে চলে যান। ফলে ওই বাল্যবয়সেই শিবাজী ও তার মাকে পুণা শহরে দাদাজী কোণ্ডদেব নামক এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের অভিভাবকত্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিবাজীকে বাল্যবয়স থেকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ হতে হয়েছিল। দাদাজী কোণ্ডদেবের সঠিক অভিভাবকত্ব ও মায়ের উপযুক্ত স্নেহ ও তত্ত্বাবধানে শিবাজী বড়ো হন। ১৬৪৭ সালের ৭ মার্চ দাদাজী মারা যান। ফলে শিবাজী মাত্রই কুড়ি বছর বয়সে নিজেই নিজের কর্তা হয়ে বসেন। আর এর মধ্যেই তিনি সামরিক ও সাধারণ প্রশাসনে নিজেকে শিক্ষিত করে। নিয়েছিলেন। তিনি মাউলি জাতির লোকেদের নিয়ে এক সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এরই মধ্যে বিজাপুরের সুলতান দীর্ঘ অসুস্থতায় পড়ে এবং প্রায় দশ বছর পীড়িত থাকে। শিবাজীর সামনে। সুযোগ উপস্থিত হয় এবং তিনি এই সুযোগে তোরনা দুর্গ দখল করেন। তাছাড়া, তিনি সরকারি তহবিল থেকে ২ লক্ষ হুন প্রাপ্ত হন। এই অর্থ দিয়ে তিনি রাজগড়ে এক দুর্গ নির্মাণ করেন। এইভাবে শিবাজী তার অভীপ্সিত পথে এগোতে শুরু করেন। এরপরে ধারাবাহিকভাবে তিনি একের পর এক যুদ্ধে লিপ্ত হন। মোগলদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ শুরু হয় ১৬৫৭ সালে। শিবাজী যুদ্ধে যার সঙ্গে যেমন তার সঙ্গে তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন নীতি অবলম্বন করেছিলেন। তার নীতি ছিল, ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’ অর্থাৎ শঠকে শঠতাপূর্বক বিনাশ করা। মহাভারতের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের নীতি অবলম্বন করে তিনি একে একে বিজাপুরের সেনাপতি আফজল খাঁকে হত্যা (১৬৫৯), শায়েস্তা খাঁকে রাত্রে হঠাৎ আক্রমণ, দক্ষিণ কোঙ্কণে রাজ্যবিস্তার, সুরাট বন্দর লুণ্ঠন, ১৬৬৪ সালে মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ, জয়সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পুরন্দরের সন্ধি, আগ্রায় আওরঙ্গজেবের সাক্ষাৎ ও বন্দি হওয়া, বন্দি অবস্থায় পলায়ন ও স্বদেশে প্রত্যাগমন ইত্যাদি ঘটনা পর পর ঘটে যায়। বন্দিদশা থেকে ফিরে শিবাজী তিন বছর (১৬৬৭-১৬৬৯) চুপচাপ থাকলেন। কিন্তু, তারপরে, ১৬৭০ সালের জানুয়ারি থেকেই আবার যুদ্ধ শুরু করলেন মোগলদের সঙ্গে। মোগলদের কাছ থেকে একের পর এক দুর্গ দখল করতে থাকেন তিনি। অপ্রস্তুত ও গৃহবিবাদে লিপ্ত মোগলরা আর তার সঙ্গে পেরে উঠল না। চারিদিকে শিবাজীর জয়জয়কার হলো। পর পর সুরাট লুণ্ঠন, ডিনডোরির যুদ্ধ, বেরার ও বাগলানা লুণ্ঠন ও অধিকার, কোলি অধিকার ইত্যাদি সম্পন্ন হলো। প্রবল প্রতাপান্বিত মোগলেরা শিবাজীর সঙ্গে যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত হয় এবং তাদের গুরুত্ব কমে যায় ভারতের ইতিহাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অবস্থায় অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায়
“তার পরে শূন্য হলো ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নিবিড় নিশীথে দিল্লিরাজশালা—
একে একে কক্ষে কক্ষে অন্ধকারে লাগিল মিশিতে দীপালোকমালা।
শবলুব্ধ গৃধ্রদের ঊধ্বস্বর বীভৎস চীৎকারে মোগলমহিমা।
রচিল শ্মশানশয্যা মুষ্টিমেয় ভস্মরেখাকারে হলো তার সীমা।”
শিবাজীর সাম্রাজ্য স্থাপন ও তাঁর রাজ্যাভিষেক ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিদর্শনের সূচনা করে। তার মধ্যে হিন্দু রাজনীতি ও স্বদেশনীতির সমস্ত শ্রেষ্ঠ গুণগুলোই প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, স্বদেশনিষ্ঠ, দৃঢ়, সৎ, সক্ষম প্রশাসক। তিনি ছিলেন মা ভবানী এবং নিজের মাতৃদেবী জীজা বাঈয়ের প্রতি অনুগত ও একান্ত শ্রদ্ধাশীল। শত্রুর প্রতি তিনি ছিলেন নির্মম, কিন্তু মহিলা, শিশু এবং নিজেদের লোকের প্রতি ছিলেন দয়াল। সমস্ত ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। সমস্ত ধর্মগ্রন্থের প্রতি তাঁর ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তিনি তার গুরু স্বামী রামদাসের প্রতি ছিলেন অসীম শ্রদ্ধাশীল। তিনি গুরু রামদাসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য শাসন করতেন।তিনি ছিলেন কর্মযোগের উপর আশ্রিত এক আদর্শ নৃপতি। তার গুরু রামদাস সর্বদা তাকে আদর্শ রাজা বলে উল্লেখ করতেন। আর শিবাজীও সর্বদা গুরুর উপদেশ অনুযায়ী রাজকার্য করতেন।
বিভিন্ন রাজ্য দখল এবং দক্ষিণ ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করলেও তিনি নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করেননি। ফলে, অন্যান্য রাজা তাকে এক জায়গিরদারের পুত্র হিসেবেই গণ্য করছিল। এর ফলে তার অনেক অসুবিধা ও ক্ষতি হচ্ছিল। তাছাড়া, তাঁদের মধ্যে অতি পুরানো বংশগুলি যেমন মোরে, যাদব, নিম্বলকর ইত্যাদি শাহজীও শিবাজীকে ভুইফোড়, অকুলীন বলে অবজ্ঞা করত। তাছাড়া শিবাজীর প্রজারাও অসুবিধায় পড়েছিল। কারণ, যতদিন না তিনি রাজা হিসেবে গণ্য হন, ততদিন তার প্রজারা তাদের পূর্বের রাজাদের প্রজা। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী তার শিবাজীর শাসন মানতে বাধ্য ছিল না। এমতাবস্থায় তিনি নিজেকে এক স্বাধীন হিন্দুনরপতি হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এছাড়া মহারাষ্ট্রের সকল মানুষ দেশে স্বাধীন হিন্দুরাজার– “হিন্দবী স্বরাজ’ স্থাপনের জন্য উৎসুক ছিল। তিনি প্রচার করলেন যে, ভারতবর্ষে হিন্দু রাজত্বকালে যে পদ্ধতিতে পুরাতন সম্রাটদের অভিষেক হতো ঠিক সেইভাবে তিনি নিজেকে হিন্দুভারতের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করবেন। সেই অনুযায়ী ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হবে বলে স্থির হয়। বিরাট সমারোহের উপযোগী নানা ধরনের জাঁকজমক পূর্ণ সজ্জায় রাজধানী রায়গড় সুসজ্জিত করা হয়। কিন্তু শাস্ত্র অনুযায়ী ক্ষত্রিয়। ভিন্ন অন্যজাতের লোক রাজা হতে পারে না; অথচ, সেযুগে ভোসলে বংশ শূদ্র বলে গণ্য হতো। এই অবস্থায় শিবাজীর মুন্সী বালাজী আবজী মারাঠা জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত কাশী বিশ্বেশ্বর ভট্ট (ডাকনাম গাগা ভট্ট)-কে রাজি করালেন। গাগা ভট্ট শিবাজীর ক্ষত্রিয়ত্ব প্রমাণে এবং তার আদিপুরুষরা যে সূর্যবংশীয় চিতোরের মহারাণার বংশ তা লিখিতভাবে জানিয়ে দিলেন এবং অভিষেকক্রিয়ায় নিজে প্রধান পুরোহিত হিসেবে কাজ করতে সম্মত হলেন। ভারতবর্ষের সকল প্রদেশের পণ্ডিতগণ এই রাজ্যাভিষেকে আমন্ত্রিত হলেন। এগারো হাজার ব্রাহ্মণ ও তাদের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে পঞ্চাশ হাজার লোক রায়গড় দুর্গে হাজির হলো অভিষেকের পূর্বে প্রয়োজনীয় সব অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে শিবাজী প্রথমে নিজের গুরু রামদাস স্বামী এবং মাতা জীজা বাঈকে বন্দনা করে তাঁদের আশীর্বাদ গ্রহণ করলেন। জ্যেষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে ‘অভিষেকের’ শুভদিন। ইংরাজি ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন। সেদিন খুব ভোরে উঠে শিবাজী প্রথমে মঙ্গলস্নান ও কুলদেব-দেবী-মহাদেব ও মাভবানীর পূজা, কুলগুরু বালম ভট্ট, পুরোহিত বিশ্বেশ্বর ভট্ট এবং অন্যান্য পণ্ডিত ও সাধুদের বন্দনা ও বস্ত্রালঙ্কার দান করলেন। তারপরে অভিষেক স্নান সম্পন্ন অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করে সিংহাসন-গৃহে প্রবেশ করলেন। অনুষ্ঠানাদির পরে তিনি সিংহাসনে উপবেশন করলেন। উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ উচ্চৈঃস্বরে শ্লোক পাঠ করে রাজাকে আশীর্বাদ করলেন। প্রথমে গাগা ভট্ট, তারপরে অষ্টপ্রধান ও ব্রাহ্মণগণ মহারাজাকে আশীর্বাদ করলেন। পণ্ডিত গাগা ভট্ট গঙ্গা-সিন্ধু-যমুনা-গোদাবরী-কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীর পবিত্র জল তাঁর মস্তকে সিঞ্চন করলেন এবং অভিষেকমন্ত্র পাঠ করলেন। তার মাথার উপর রাজছত্র ধরা হলো। তাকে ‘শককর্তা’, ক্ষত্রিয় কুলবন্তস’এবং “ছত্রপতি’উপাধিতে ভূষিত করা হলো। এইভাবে তাঁর রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়।
কিন্তু তাঁর মা জীজা বাঈ এর ঠিক পরেই, ১৮ জুন, ১৬৭৪ সালে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রয়াত হন। একে খারাপ লক্ষণ মনে করে আবার ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৬৭৪ দ্বিতীয়বার তার অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এইবার অভিষেক সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে এবং এতে পৌরোহিত করেন নিশ্চল পুরী।
শিবাজী মহারাজের এই রাজ্যাভিষেকের তাৎপর্য ভারতীয় এবং হিন্দু সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগের মুসলমান শাসনের দীর্ঘ তমসাকাল কাটিয়ে আবার ধুমধাম করে এক হিন্দু রাজার রাজ্যাভিষেক হিন্দুজাতির মধ্যে এক নতুন আশা ও ভরসার সঞ্চার করেছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন, “একতাহীন, নানা খণ্ডরাজ্যে বিছিন্ন, মুসলমান রাজার অধীন, এবং পরের চাকর মারাঠাদের ডাকিয়া আনিয়া শিবাজী প্রথমে নিজ কার্যের দ্বারা দেখাইয়া দিলেন যে তাহারা নিজেই নিজের প্রভু হইয়া যুদ্ধ করিতে পারে। তাহার পর, স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়া তিনি প্রমাণ করিলেন যে বর্তমানকালের হিন্দুরাও রাষ্ট্রের সব বিভাগের কাজ চালাইতে পারে; শাসন-প্রণালী গড়িয়া তুলিতে, জলে-স্থলে যুদ্ধ করিতে, দেশে সাহিত্য ও শিল্প পুষ্টি করিতে, বাণিজ্যপোত গঠন ও পরিচালন করিতে, ধর্ম রক্ষা করিতে, তাহারা সমর্থ; জাতীয় দেহকে পূর্ণতা দান করিবার শক্তি তাহাদের আছে।
শিবাজীর চরিত্র-কথা আলোচনা করিয়া আমরা এই শিক্ষা পাই যে, প্রয়াগের অক্ষয় বটের মতো হিন্দুজাতির প্রাণ মৃত্যুহীন, কত শত বৎসরের বাধা-বিপত্তির ভার ঠেলিয়া ফেলিয়া আবার মাথা তুলিবার, আবার নূতন শাখাপল্লব বিস্তার করিবার শক্তি তাহাদের মধ্যে নিহিত আছে। ধর্মরাজ্য স্থাপন করিলে, চরিত্রবলে বলীয়ান হইলে, নীতি ও নিয়মানুবর্তিতাকে অন্তরের সহিত মানিয়া লইলে, স্বার্থ অপেক্ষা জন্মভূমিকে বড়ো ভাবিলে, বাগাড়ম্বর অপেক্ষা নীরব কার্যকে সাধনার লক্ষ্য করিলে,জাতি অমর অজেয় হয়।”
(হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)
বিনয়ভূষণ দাশ
2019-06-07