নতুন বারিধারায় জীবন তখন বিহ্বল। আসে রথযাত্রা; দেবত্বের অভিমুখে মানুষের চিরকালীন পথ চলা। রোজ রোজ পবিত্রতা আর নিত্য দিন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ঐশী-চর্যা শুরু হবার দিন। দুর্গাপূজার দিন গোনা, মূর্তির কাঠাম-পূজা, জীবনের কাঠামোর মধ্যে ধীরে ধীরে বাঁশ-খড়-মাটি লেপে ঐশী প্রলেপ বুলিয়ে জীবনকে দেবতার মতোই গড়ে তোলা। এই যাত্রা, এই কাঠামো, এই দেহযন্ত্রের ঐশী-বোধ, দেহরূপ মন্দির এবং জীবনের চিরন্তন-শকটের অন্তরালে আমাদের কতই না চিহ্ন-সংকেত! “Each Soul is potentially divine”. আমাদের মধ্যেই জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার পরম উপস্থিতি! রথের রজ্জু টেনে ঐশী যাত্রাকে রমণীয় করে তোলা।
ছোটোবেলায় এক রথের দুপুরে ‘রাধারাণী’ উপন্যাস-টি পড়েছিলাম। শ্রীরামপুরে রথের মেলা। রাধারাণীর মা ঘোরতর অসুস্থ। কাজেই পরিশ্রম-জনিত উপার্জন বন্ধ। আহার চলে না। মা রুগ্না, তাই উপবাস। রাধারাণীর আহার জুটলো না বলে উপবাস। রথের দিন মা একটু সুস্থ হল, পথ্যের প্রয়োজন, কিন্তু পথ্য কোথায়? বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন, “রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে কতকগুলি বনফুল তুলিয়া তাহার মালা গাঁথিল। মনে করিল যে, এই মালা রথের হাটে বিক্রয় করিয়া দুই একটি পয়সা পাইব, তাহাতেই মার পথ্য হইবে। কিন্তু রথের টান অর্ধেক হইতে না হইতেই বড় বৃষ্টি আরম্ভ হইল। বৃষ্টি দেখিয়া লোক সকল ভাঙ্গিয়া গেল। মালা কেহ কিনিল না। রাধারাণী মনে করিল যে, আমি একটু না হয় ভিজিলাম — বৃষ্টি থামিলেই আবার লোক জমিবে। কিন্তু বৃষ্টি আর থামিল না। লোক আর জমিল না। সন্ধ্যা হইল — রাত্রি হইল — বড় অন্ধকার হইল — অগত্যা রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিল।”
রথের মেলায় গিয়ে বালিকা রাধারাণীদের আজও খুঁজি! তাদের কাছ থেকে সুগন্ধি মালা কিনবো। ওরা চাঁপা, রজনীগন্ধা, জুঁই ফুলের মালা নিয়ে আজও আসে গ্রাম-শহরের রথের মেলায়। মেলায় যে গরীব মানুষ গাছ বিক্রি করতে আসেন, তাদের প্রতি আলাদা একটা মমত্ব কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গের ফুলের হাট-বাজারে এমন কত রাধারাণী! ফুল বিক্রি না হলে খালের জলে ফেলে দিয়ে আর্দ্র হৃদয়ে তারা বাড়ি ফেরেন। কারণ ফুলের হাটে উঠতি-পড়তির দোলা। বাংলায় ফুল সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। বিক্রি না হওয়া ফুলকে প্রক্রিয়াকরণ করে রাখার পরিকাঠামো নেই। বঙ্কিমচন্দ্র বহু বছর আগেই ফুলের বাজারের উঠতি-পড়তির দোলায় চড়েছেন, আজও তার সুরাহা হয় নি। ‘রাধারাণী’ উপন্যাসটির কালখণ্ড হচ্ছে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয় ১২৮২ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে।
বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহ-দেবতা ছিলেন রাধাবল্লভজী। রথযাত্রার দিনটি মহাসমারোহে পালিত হত তাঁদের কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে। এই ঘটনার বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই। দুজনের বাড়ি খুব বেশি দূরে ছিল না, নৈহাটি ষ্টেশন থেকে খুবই কাছাকাছি। রথের দিন বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহদেবতাকে বার করে ঘষেমেজে চকচকে করা হত। বাড়ির দক্ষিণে একটা খোলা জায়গায় বেশ একটা মেলা হত, প্রচুর পাকা কাঁঠাল, পাকা আনারস বিক্রি হত, তেলেভাজা-পাঁপর-ফুলুরির গাদি লেগে যেত, আট-দশখানা বড় বড় ময়রার দোকান বসত — তাতে গজা, জিলিপি, লুচি, কচুরি, মিঠাই, মিহিদানা, মুড়ি মুড়কি, মটর ভাজা, চিঁড়েভাজা, ঘিয়ের খাজা যথেষ্ট থাকতো। মেলায় মণিহারী দোকান থাকতো অনেকগুলো, তাতে নানা রকম বাঁশি, কাগজের পুতুল, কাঠির উপর লাফ দেওয়া হনুমান, কটকটে ব্যাঙ কিনতে পাওয়া যেতো। আর ছিল নানারকমের গাছের কলম। তখনকার দিনে চারা তৈরি ও বিকিকিনি কেমন ছিল, তা কাঁঠালপাড়া রথের মেলার প্রত্যক্ষদর্শী হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিবরণে উঠে এসেছে। যারা বাগান করতে চান, যারা চারা কিনতে চান, যারা বাগানবিলাসী তাদের এক মহাসমারোহ ছিল নৈহাটির রথের মেলা। নারকেল, আম, লেবু, সুপারি, লকেট, গোলাপ জাম, পিচ, সবেদা, ফলসা, গোলাপ, যূঁই, জাতি, বেল, নবমালিকা, কামিনী, গন্ধরাজ, মুচকুন্দ, বক, কুরচ, কাঞ্চন, টগর, সিউলি প্রভৃতি ফল ও ফুলের চারা বিক্রি হত। আট দিন ধরে চলতো এই মেলা। বসতো পুতুলনাচের আসর; সীতার বিবাহ, লবকুশের যুদ্ধ, কালীদমন প্রভৃতি চল্লিশ-পঞ্চাশ রকমের পুতুল নাচ হত। রথে বহুলোকের সমারোহ ঘটতো।
এই মেলার ভীড়েই একটি ছোট মেয়ে হারিয়ে গেছিল ১৮৭৫ সালে। সেবার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র রথের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। বাচ্চা মেয়েটির আত্মীয়-স্বজনেরা বহু খোঁজ করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও অনুসন্ধানে নেমেছিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। জানা যায়, এই ঘটনায় অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন বঙ্কিম। ঘটনার দুই মাস পরে ‘রাধারাণী’ উপন্যাসটি লেখেন বঙ্কিম। যদিও ঘটনার বিস্তার অন্যদিকে নিয়ে গেছেন তিনি।
রথের মেলায় নানান ষড়যন্ত্রকারী মানুষের আনাগোনার খবর অনেকসময় শুনতে পাওয়া যায়, সে শহরেই হোক, অথবা নগরে, গ্রামে। মেয়ে মানুষের দিকে দূর থেকে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার ঘটনাও, এই হিংস্রতা সেভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় নি। হিন্দু ধর্মের একটি উৎসব-মুখর দিনে যখন আনন্দ উচ্ছলতা চারিদিকে, তখন নানাভাবে অনুষ্ঠান পণ্ড করার, বিরক্ত করার মানুষ সুযোগ খোঁজে, লাভ-জেহাদের টোপে ফলে। মানুষ ভয় পায়; নারী অপহরণ ও নারী-পাচার চক্র পাছে অপকর্ম করে! তাই মেয়ে বালিকার হাত শক্ত করে ধরে রাখে, তারপরই আনন্দ করে রথের মেলায়। কারণ লাভ-জেহাদের ঘটনা অতীতে কম ঘটে নি তো! হিন্দু মেয়েরা সহজ আক্রমণের শিকার।
খুব ছোটোবেলায় রথের দিন দুপুরে আমার বাবা রহড়া বাজার থেকে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মৃণ্ময় মূর্তি কিনে আনতেন, রথে নবমূর্তি বসিয়ে টানা হবে। ঝুলনের সময় আসতো শ্রীরাধাগোবিন্দের যুগল মূর্তি, ঝুলন-স্কেপে সুন্দর করে ঝুলিয়ে দেবার জন্য। বাবা যখন কলেজে পড়তেন সেই সময় একবার রাজশাহী থেকে পুরী গিয়েছিলেন শ্রী মুখ দর্শন করতে। ঠাকুমা খুব ছোটোবেলায় বলেছিলেন, তীর্থ থেকে ফিরে আসার পর গ্রামসুদ্ধ মানুষ বাবাকে দেখার জন্য এবং একটু মহাপ্রসাদ পাবার জন্য ছুটে এসেছিলেন। তখন ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিক। নানাজন পুরীর মহাপ্রসাদ এনে দিলে তা পরম চিত্তে গ্রহণের পর খানিকটা কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতেন ঠাকুমা। পরে দেখেছি, পুণ্যার্থী আত্মীয়স্বজন পুরী থেকে ফিরে মহাপ্রসাদ মায়ের হাতে দিলে, বাড়ির শিকেয় মাটির পাত্রে তুলে রাখা হত। আমি একদানা করে খেতাম আর মনে মনে কল্পনা করতাম পুরীধাম থেকে ফিরে এসে বাবার অনুভূতির কথা। পরে জেনেছিলাম শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে থাকবার ঘরটির দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে রেখে দিতেন মহাপ্রসাদ, রোজ সকালে পরিচ্ছন্ন হয়ে একদানা করে মুখে দিতেন।
বাবা বলতেন, রথযাত্রা মানে হল দেবত্বের অভিমুখে মানুষের চিরকালীন এগিয়ে যাওয়া। রোজ রোজ পবিত্রতা আর পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ঐশী-জীবনচর্যা শুরু হয় রথের দিনটি থেকে। এই দিন থেকেই দুর্গাপূজার দিন গোণার শুরু, মূর্তির কাঠাম-পূজা। আমাদের মনুষ্য জীবনের কাঠামোর মধ্যেও ধীরে ধীরে বাঁশ, খড়, মাটির এক এক ঐশী-প্রলেপ বুলিয়ে বুলিয়ে জীবনকে দেবতার মতো করে গড়তে হয়। রথযাত্রা, দুর্গাকাঠামো, দেহযন্ত্রের ঐশী-বোধ, দেহ-রূপ মন্দির ও চিরন্তন-রথ-শকটের অন্তরালে কতই না কথা বলতেন বাবা! রথের দিন সকালে গীতাপাঠ করতেন, পাশে আসন নিয়ে বসতে বলতেন আমাদের, আমি বসতাম। তখন এতসব কথা বুঝতাম না। সেদিনের দুই একটি কথা ও কৃত্য আজ স্মরণ করলে পুরোটাই কেমন ছবির মতো ভেসে ওঠে। বাবার অকাল প্রয়াণের পর যখন স্বামী বিবেকানন্দের ঐশীবাণীটি শুনলাম, “Each Soul is potentially divine” তখন মনে হল রথযাত্রার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাবা হয়তো এই কথাই বলেছিলেন।
রথের সাজসজ্জা করে দিতেন আমার দিদি (বড়দি) আর ছোড়দি; আমি আর ছোটোবোন চুপচাপ বসে বসে দেখতাম আর টুকটাক সাহায্য করতাম। বাহারী পাতার ডাল, কদম ফুল, কলাবতীর সৌকর্য, টগর ফুলের মালা দিয়ে দোতালা রথ সাজানো থাকতো। একটি ছোট্ট থালায় বাতাসা আর নকুলদানা, সঙ্গে ছোটো শিশিতে রাখা তারই বিস্তৃতি। কেউ রথের রশি ধরে টানলে দুই একদানা এলাচ-দানা আর একটি বাতাসা দিতাম। অনেকে কয়েক আনা পয়সা দিতেন, তা জমিয়ে ফেরার সময় জিলিপি আর পাঁপড় কেনা হত। পুরো বিকেল আর সন্ধ্যাটা কতই না মনোরমভাবে কাটতো!
এরই মধ্যে মন উদাস হয়ে যেতো। তখন রহড়া-খড়দহ ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে সবুজে ভরা — অসংখ্য পুকুর, তাতে শাপলা-কলমি-হিঞ্চে শাকের সমারোহে ডাহুক পাখির ডাক, মাঠের পাশে সন্ধ্যাদির বাড়িখানা কদমফুলের কেশরে ছেয়ে গেছে, জীবনবাবুর প্রাচীরের ধারে পুরনো অমলতাস গাছে হলুদ ফুলে ভর্তি, রাক্ষসী পুকুর পাড়ে কয়েকটি বহু পুরাতন কাঠচাঁপা গাছ, বিশ্বাসদের তালপুকুর আর বাঁশবন, কেয়া-কল্লোলদের উঠোনে তেজপাতা গাছের মহাসমারোহ, শীতলা বাড়ির পিছনে বুনো আঁশফলের গাছ, নমুদির উঠোনে রসকাটা খেজুর গাছ। এসব গাছ ফুলে-ফলে ভরে উঠলে মনটা খুশিতে ভরে উঠতো। রথ টানতে টানতে আপন মনে গাছের দিকে তাকাই, তারাও তাকায় একরাশ অব্যক্ত কথা নিয়ে। আজ রহড়ায় সেসব কিছুই নেই, চেনা রহড়ায় বড় বড় সব বাড়ি। যে বাড়িতে ভাড়া ছিলাম অনেকদিন, জমিটুকু কিনতেও সুযোগ দেওয়া হয় নি। ওখানে বেড়ে ওঠা আজকের ইমারত ছাড়িয়ে সেদিনের রথ সাজানোর ক্ষুদ্র বাসাটুকু অনেক বেশি অম্লান হয়ে ওঠে। টিনের চালে এক ইটে গাঁথা ঘর, বৃষ্টি ঝাপিয়ে এলে ঘরে বসেই টিন ছাপিয়ে জলের নরম সান্নিধ্য; তারমধ্যে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার পরম উপস্থিতি, বাবা বলতেন এখানেই চরমতম ঐশীশক্তি। বাবা অনেক সংগ্রামের পর শেষ প্রশ্বাসটুকু ওই শক্তি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। পূর্ণতার দিকে যাওয়ার পথে, জগন্নাথ যাত্রায়।
ড.. কল্যাণ চক্রবর্তী।