সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ক্ষমতালোভী বিরোধীদের নিম্নরুচির প্রচার

ভারতের রাজনীতিতে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেল। অনেক অর্থে অভূতপূর্বও বটে। বিজেপি তথা এন.ডি.এ-র বিপুল জয় সমস্ত বিজেপি বিরোধী দল বোদ্ধা বিশ্লেষকদের পর্বতপ্রমাণ ভুল প্রমাণিত করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতব্যাপী এক নতুন রাজনীতির সূচনা হয়েছে। নতুন, কারণ বিরোধী গোষ্ঠীগুলির ভয় ভীতিমূলক প্রচার ছিল নরেন্দ্র মোদী ২০১৯-এ প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হলে সারাদেশে এক ভয়ংকর দাঙ্গা ও ডিক্টেরশিপের সূত্রপাত হবে। বিরোধীরা জানত যে এই কথা সত্য নয়, তবুও তারা। অহোরাত্র তা প্রচার করে মানুষের মনে ভীতি প্রবিষ্ট করার চেষ্টা করেছিল, যা কিছুটা হলেও কতিপয় বুদ্ধিজীবী মানুষও বিশ্বাস। করেছিলেন। এসব যদি সত্যি হয় তা হলেও এই নির্বাচনের পর নতুন রাজনীতির সূচনা হয়েছে বলা যায়। আবার মিথ্যা প্রমাণিত হলেও তা হবে নতুন ধারার রাজনীতি। নরেন্দ্র মোদীকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে (স্তালিনের নাম এরা সযত্নে এড়িয়ে যান) তারা শুধু জুজুর ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে জিততে চেয়েছিল। তা মানুষকে প্রভাবিত করেনি। নরেন্দ্র মোদী অনেক দূরের নক্ষত্র। মানুষ বিভিন্ন রাজ্যে তাদের স্থানিক নেতা-নেত্রীর মধ্যেই যে যুদ্ধে হিটলারদের দেখে সেটাই তাদের কাছে ডিকটেটরশিপের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এই নির্বাচনে বিরোধীদের চিত্রিত ছবি ও উত্থাপিত স্লোগানের তাৎপর্যহীনতা সম্পর্কে ভবিষ্যতে তাদের ভাবতে হবে। ভারতের নির্বাচনমূলক রাজনীতির ধারা পরিবর্তিত হচ্ছে। এই কারণেই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন অভূতপূর্ব ঘটনাবলীর একটি ফলকচিহ্ন হিসাবে গণ্য হবে।এই নির্বাচনে প্রচারের ঢং ও নেতা-নেত্রীদের বাক্যরাশি ছিল একেবারেই পূর্ব অনাস্বাদিত। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এইবার আক্রমণের মাত্রা ছিল তীব্রতম যা আগে কখনও কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেখা যায়নি। এমনকি ‘বোফর্স’ খ্যাত রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধেও নয়। রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধ শক্তি ছিল অনেক সুশৃঙ্খল শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের নিয়ে গঠিত। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস ছিল দুর্বল, হতচকিত ভীরু ও দিশাহীন। কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী শক্তি শুধু কথার চমকে উতরে যেতে চেষ্টা করেছে। তাদের প্রচার ছিল দুর্বল ও অতি নিম্নমানের। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রুচিহীন ও মিথ্যা। তথ্যবর্জিত ও আদালত অবমাননাকারী মন্তব্য লজ্জিত বাক্যাবলীতে আবৃত। অতীতের কঠিন নির্বাচন লড়াইকে কেন্দ্র করেও এরকম দৃষ্টান্ত ছিল বিরল। এটা এই নির্বাচনের একটি নতুন বৈশিষ্ট্য।
বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ সর্বভারতীয় কংগ্রেস দল সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। তার গ্রহণযোগ্যতা ও দলের সভাপতি রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বদানের ক্ষমতা যে একেবারেই শূন্য তা সম্পূর্ণ প্রমাণিত। তার নেতৃত্বের ওপর তার নিজেরই আর আস্থা নেই। তিনি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে চান, কিন্তু কোনও বিশ্লেষণ চান না। এই সব নেতারা পরাজিত হলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতায় বিশ্বাসী নন। বাস্তবে ‘কপিকলে’তুলে ধরা নেতা-নেত্রীদের এটাই স্বাভাবিক পরিণতি। সে অন্য প্রসঙ্গ। এই নির্বাচনে অন্যান্য আঞ্চলিক বিরোধী দলগুলি একটি ‘ঐক্যবদ্ধ’ গঠবন্ধনের মুখোশ পড়েছিল। তা ঝড়ের দাপটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাস্তবে কংগ্রেস বা বিরোধী দলগুলি কোনও অবস্থাতেই আদৌ ঐক্যবদ্ধ জোট গঠনে প্রয়াসী হয়নি। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অঞ্চলে বা রাজ্যে আপন শক্তি বর্ধনেরই ছক কষছিল। প্রায় সকলেই প্রধানমন্ত্রীর তখতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। জনগণের কাছে এই চালাকি বা বুজরুকিটা ধরা পড়ে গিয়েছিল। এদের সবাই ভেবেছিলেন যে তাদের প্রত্যেকেরই প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্যতা আছে। মায় কর্ণাটকের দেবেগৌড়াও। এদের আবার আরও একটা চেষ্টা ছিল রাহুল গান্ধীকে ক্ষমতার আশপাশে একেবারেই আসতে না দেওয়া। সুতরাং মহাগঠবন্ধনের হাস্যকর রূপ ছিল প্রকট। একটি শক্তিশালী জোটের বিরুদ্ধে কার্যত কোনও জোটবদ্ধ বিশ্বাসযোগ্য বিরোধিতাই ছিল না। এই নির্বাচনে এটা ছিল একটা বৈশিষ্ট্য। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যে দুজন সক্রিয় ও সোচ্চার ছিলেন— চন্দ্রবাবু নাইডু ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা নাকাল হলেন সবচেয়ে বেশি। চন্দ্রবাবুকে অন্ধ্রপ্রদেশ অর্ধচন্দ্র প্রদান করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখিয়েছে। তার একচ্ছত্রতার অপসারণ ও দলে ফাটল। এই নির্বাচন প্রমাণ করল যে, জনগণের কাছে কোনও সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্য নেতা বা নেত্রী নেই। অতীতে নির্বাচনে পরাজয়ের পর শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসের কোনও সর্বভারতীয় সভাপতি পদত্যাগপত্র পেশ করেননি। ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী কেউ নন। রাহুল গান্ধী মাত্র দিনকয়েক আগে তার মায়ের কাছ থেকে নেতৃত্বের ব্যাটন পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা এই বিষাদ মুহূর্তে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। এটাও ভারতের রাজনীতির একটি চমকপ্রদ ঘটনার সূচনা।
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা কোনও উল্লেখযোগ্য ‘ইস্যু উত্থাপন করতে পারেনি। একদিকে বিরোধী নেতানেত্রীরা ব্যাক্তিগত বা দলগত লোভকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং অন্যদিকে মোদীর বিরুদ্ধে কোনও ইস্যুভিত্তিক যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই নির্বাচন ছিল এক ‘ইস্যুহীন’ নির্বাচন যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। এমনকী বিরোধীরা। বিজেপি দলের বিরুদ্ধেও তাদের প্রচার তেমন। নিবদ্ধ করেনি। তারা তাদের সমস্ত বিষ ঝেড়েছিল ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে। তারা ঘোষণাই করেছিল যে তারা অন্য কোনও কিছু জানে না, শুধু নিরন্তর মোদীকেই বিদ্ধ করে যাওয়াটাই তাদের লক্ষ্য। অর্থাৎ মোদীকে প্রচারের আলোয় রাহুল গান্ধীরাই সবচেয়ে বেশি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। অতএব যা হয় অবিশ্রান্ত ব্যক্তিগত গালাগালিই ছিল বিরোধীদের হাতিয়ার। যেমন, মোদী মিথ্যাবাদী, মোদী চোর, মোদী দাঙ্গাবাজ, মোদী যুদ্ধবাজ এসব কথাতো ছিলই। এমনকী মোদী তার মাকে ও স্ত্রীকে কেন দেখেন না, কেন বিবাহের পর স্ত্রীকে ছেড়ে এলেন এসব অবান্তর নিম্নরুচির কথায় বাজার গরম করতে চেয়ে এক ইতিহাস। রচনা করেছে। এটা রাজনীতিতে অভূতপূর্ব। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে রাজস্থানে বিরোধীরা একবার ইন্দিরা গান্ধীর বৈধব্য দেশের ক্ষেত্রে অশুভ বলে প্রচার করেছিল। কিন্তু তা ছিল স্থানীয় ও ক্ষণিক। এই ধরনের প্রচার এদেশে কখনও হয়নি। রাহুল গান্ধী মোদীর ‘চৌকিদার’ তকমাকে মুখরোচক করে নতুন স্লোগান দিলেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। কিন্তু রাজীবের বিরুদ্ধে বোফর্স যে বিতর্কের জন্ম। দিয়েছিল রাফায়েল চুক্তি সেরকম কোন। ধারণাই সৃষ্টি করতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্টও কোর্টের মন্তব্য বিকৃত করার দায়ে রাহুল গান্ধীকে লিখিত ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে। রাজীবের বিরুদ্ধে যে স্লোগান উঠেছিল ‘গলি গলিমে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’। তার অনুকরণে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ বুমেরাং হয়েছে। রাজীব গান্ধীর বোফর্স কেলেঙ্কারি ও ইতালীয় পারিবারিক কেলেঙ্কারির কথা মানুষের আবার মনে পড়ে যায়। গান্ধী পরিবার যারা জমি কেলেঙ্কারি (প্রিয়াঙ্কা ভঢ়রার পরিবার), ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় জড়িত তাদের মুখ থেকে সততার বাণী বা সতর্ক বার্তা হাস্যকর। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নরেন্দ্র মোদীর কলঙ্কহীন রাজনৈতিক চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস ছিল অক্ষম ও অশক্তের নিম্নরুচির রাজনীতি। গোটা নির্বাচন জুড়ে এটাই বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বিরোধী পক্ষের। নির্বাচনের পরেও প্রধানমন্ত্রীর কেদার-বদ্রীর গুহায় ধ্যানচিত্র নিয়েও এদের কটাক্ষও ব্যক্তিগত আক্রমণের রুচিহীন পরিচয়। যে কঠিন আত্মত্যাগ, জীবনচর্যা ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি সেবামূলক জীবন গঠন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী সে সম্পর্কে যদি কোনও ধারণা না থাকে তবে অন্তত বিবেক ওবেরায়ের অভিনীত পি এম নরেন্দ্র মোদী চলচ্চিত্রটি দেখার অনুরোধ করব। রাজনীতির অঙ্গনে রাহুল গান্ধী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তা চিন্তাই করতে পারেন না। সুতরাং তাকে আর পাঁচটা গড়পড়তা সুবিধাভোগী রাজনীতিকের পর্যায়ে নামিয়ে আনার যে চেষ্টা তারা করেছিলেন তার জন্য তাদের সম্বল ছিল ব্যক্তিগত চরিত্র হনন ও গালিগালাজ।
মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে ঘৃণা ও হিংসাত্মক ভাষায় আক্রমণ করে যে প্রচার করেছেন তাও নজীরবিহীন-অভূতপূর্ব। কান ধরে ওঠা বসা করান’, ‘কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া এসব শব্দাবলী এই প্রথম কোনও নির্বাচন প্রচারে ব্যবহৃত হলো।
এই নির্বাচনে বলিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণ করার চেয়েও অপ্রস্তুত ছন্নছাড়া বিরোধীদের লক্ষ্য ছিল নির্বাচনকে বানচাল করা বা বিলম্ব ঘটানো। তারা পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ই ভি এম মেশিন নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়াবার চেষ্টা করেছিল। তা নাকচ হওয়ায় VVPAT নিয়ে বায়নাক্কা তুলল। সুপ্রিম কোর্ট সহ সর্বত্র তা ব্যর্থ হলো। একদিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে সংশয় আবার অন্যদিকে মোদীকে খড়কুটোর মতন উড়িয়ে দেওয়ার প্রচার জনমানসে দাগ কাটেনি। বিরোধীরা একটা অদ্ভুত বৈপরীত্যের সমাহার ঘটিয়েছিল। এটাও অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য।
সমস্তটা মিলিয়ে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রুচিহীনতার পরিচয় বিরোধীরা প্রদর্শন করলেন সেই রুচিহীন শব্দ ও বাক্যাবলীর যে ধারা প্রবাহিত হয়েছে তা যদি অব্যাহত থাকে তবে ভবিষ্যতে রাজনীতি বীভৎস রূপ নেবে। সে সম্বন্ধে সকলকেই সতর্ক হতে হবে।
পুলকনারায়ণ ধর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.