যে সব সংবাদমাধ্যম বা বিশ্লেষক, এমনকী ভারতীয় অর্থনীতিবিদরাও ভারতীয় জনতা পার্টি ঘোষিত ২০১৯-এর নির্বাচনী ইস্তাহারকে ‘আর একটি কল্পতরু হওয়ার বার্তা’ বলে ব্যঙ্গ করছেন, তাদের বলব—আরও একবার ভালো করে পড়ুন। আলটপকা মন্তব্য করার আগে তলিয়ে ভাবুন। বুঝতে পারবেন, কল্পতরু নয়, ২০১৯-এ বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার আসলে ভারতবর্ষের উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি মার্গদর্শন যা প্রমাণ করে একটি সঠিক রাজনৈতিক দলের সঠিক বিচারধারা। যা প্রমাণ করে, আর শুধু ভরতুকির রাজনীতি নয়— এই ইস্তাহার ভারতবর্ষের উন্নয়নের ইস্তাহার। এবং স্বাধীনতা ইস্তক এমন ইস্তাহার আর কখনও কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক দল প্রকাশ করেনি।
কারণ? কারণ এই ইস্তাহার আগামী পাঁচ বছরের জন্য ৭৫টি উন্নয়ন প্রস্তাব এমনভাবে পেশ করেছে যা ভারতবর্ষকে নতুন দিশার পথে পা বাড়াতে সাহায্য করবে। প্রকৃত মানব উন্নয়নের সূচকে বিধৃত হবে ভারতবর্ষ এবং ২০৪৭ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে ভারতবাসী হিসেবে আমরা সবাই সমবেত কণ্ঠে গর্বের সঙ্গে বলতে পারব, আমার ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উন্নত রাষ্ট্র।
এতদিন ভাবতবর্ষে উন্নয়ন বলতে বোঝানো হতো নির্বাক প্রতিরোধহীন নাগরিক শক্তির হাতে ভরতুকির মোয়া তুলে দিয়ে ভিখারি বানানো। অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিই ছিল রাজনৈতিক দলগুলির অস্ত্র। কিন্তু এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী তার প্রথম পাঁচ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ঝুলিকে মূলধন করে ঘোষণা করলেন, আর সুযোগের অপব্যবহার নয়। এবার আসুন আমরা সবাই মিলে একটি শক্তিশালী এবং সর্বতোভাবে উন্নত ভারতবর্ষ গড়ে তুলি যেখানে ভারতীয় নাগরিকরা সম্মান পাবেন, উন্নয়নের শরিক হবেন, নিরাপদ জীবন যাপন করবেন এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন। তার দৃপ্ত ঘোষণা : *Nationalism is our inspiration, good governance is our Mantra.’ না, ব্যক্তিবিশেষের অনুপ্রেরণা নয়, এই নতুন ভারতবর্ষ গড়ে উঠবে জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণায়, ভারতীয়ত্বের গরিমায় এবং এ যাবৎ অদেখা একটি সুশাসনের পরিকাঠামোয়। জাত নয়, পাত নয়। সংকীর্ণ ধর্মান্ধতা নয়। বিজেপির এবারের নির্বাচনী ইস্তাহারের অলঙ্করণ হলো Multi-dimentional এবং Multi Layered।
অর্থাৎ বহুমুখী এবং বহুস্তরীয়। কারণ ভারতবর্ষ গড়ে উঠেছে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান-এর কৌলিন্যে। সেখানে সবক্ষেত্রে এক মত এক গীত প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বিজেপির ইস্তাহার হয়ে উঠেছে রাজনাথ সিংহের ভাষায় vision document এবং জাতীয়তাবাদের প্রতীক যা সন্ত্রাসবাদের ন্যূনতম প্রচেষ্টাকেও সহ্য করবে না।
এই ইস্তাহারের মূল গুরুত্ব কোথায়? উত্তর : এর ভাবনায়। ৭৫টি প্রস্তাব এক একটি মাইলস্টোন। কৃষি, যুবশক্তি ও শিক্ষা, পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সুস্থ প্রশাসন, সার্বিক উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি —এই প্রতিটি বিষয়কেই উন্নয়নের শরিক হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে প্রতিটি ভারতবাসী ২০২৫ সালে বলতে পারেন, আমার দেশের অর্থনীতির ভিত্তি পাঁচ মার্কিন ট্রিলিয়ন ডলার। যাতে প্রতিটি ভারতবাসী ২০৩২-এ দাঁড়িয়ে দাবি করতে পারে, আমার দেশের অর্থনৈতিক শক্তির মূল্য দশ মার্কিন ট্রিলিয়ন ডলার এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিক বলতে পারেন, হ্যাঁ মাত্র পাঁচ বছরেই আমার দেশের সরকার শুধুমাত্র পরিকাঠামো ক্ষেত্রেই খরচ করেছে ৯৭ লক্ষ কোটি টাকা আর নগরোন্নয়ন ও গ্রামীণ উন্নয়নে খরচ হয়েছে ২০ লক্ষ কোটি টাকা।
হ্যাঁ, বিরোধীরা যতই চীৎকার করুন না কেন, তারাও স্বীকার করতে বাধ্য যে একমাত্র বিজেপিই নির্বাচনী ইস্তাহারে সাহস করে বলতে পেরেছে—সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কোথাও আপোশ নয়। প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সামগ্রিক ক্ষমতা অর্পণ করা হবে এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থে সরঞ্জাম ও অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে বিলম্বিত সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করা হবে। একমাত্র বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারই বলতে পেরেছে কাশ্মীরের জনগণের স্বার্থে আর সংবিধানের ৩৭০ ধারা বজায় রাখা যাবে না। কারণ এক দেশের মাটিতে এতবছর ধরে সুবিধা পাবার পর কাশ্মীর আর বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে না। এমনকী বাতিল করতে বিল আনা হবে সংবিধানের ৩৫-এ ধারার বিরুদ্ধেও যা আইনে পরিণত হলে সকল ভারতবাসীই কাশ্মীরে জমি, বাড়ি, সম্পত্তি কিনতে পারবেন। একমাত্র বিজেপি ইস্তাহারই বলতে পারে, রামমন্দির হবে। কিন্তু সৌভ্রাতৃত্বের আবহাওয়ায়। প্রতিটি ভারতীয় পরিবারের জন্য গড়ে উঠবে এক নতুন ভারতবর্ষ।
‘সংকল্পিত ভারত সশক্ত ভারত’ শীর্ষক এই নির্বাচনী ইস্তাহারের মূল অনুধ্যানগুলির দিকে একঝলক নজর দেওয়া যাক।
কৃষি : • প্রত্যেক কৃষকের জন্য এক লক্ষ টাকা ঋণ বিনা সুদে ১ থেকে ৫ বছরের জন্য। কিন্তু শর্ত হলো মূল ঋণ শোধ করতে হবে নিয়মিত পাঁচ বছরের মধ্যে। • কৃষি উন্নয়নে বরাদ্দ হবে ২৫ লক্ষ কোটি টাকা। ষাট বছর পেরিয়েছেন এমন সমস্ত ছোটো ও প্রান্তিক চাষি পাবেন মাসিক পেনশন।
জাতীয় সুরক্ষা : সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কোনো আপোশ নয়। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতেই ক্ষমতা অর্পণ। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে বিলম্বিত পদক্ষেপ বর্জন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল : সংবিধান ৩৭০ ধারার বিলোপ সাধন। সংবিধানের ৩৫-এ ধারার বিলোপ সাধন।
স্বাস্থ্য : •১.৫ লক্ষ স্বাস্থ্য ও কল্যাণকেন্দ্র গঠন।• ৭৫টি নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন।• টেলিমেডিসিন ও স্বাস্থ্যপরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন।
অর্থনীতি : করস্তর ও কর ছাড়ের পুনর্বিন্যাস। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। • সহজে ব্যবসা করার পদ্ধতি রূপায়ণ করা। • ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি। খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে জাতীয় নীতি প্রণয়ন।• ছোটো শিল্প গঠনের ক্ষেত্রে এক জানালা ব্যবস্থার রূপায়ণ। কর কমানো, কর আদায় বৃদ্ধি। • শিল্পক্ষেত্রে আইনি জটিলতা মুক্তির জন্য কোম্পানির অ্যাক্টের সংশোধন। (বাকি অর্থনৈতিক বিষয়গুলি আগেই আলোচিত হয়েছে।)
দারিদ্র্য দূরীকরণ : দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী জনগণের পরিমাণ একক সংখ্যায় নামিয়ে আনা। • ২০২২-এর মধ্যে সবার জন্য পাকা বাড়ি গড়ে তোলা।
যুবশক্তি ও শিক্ষা :•অপারেশন ডিজিটাল বোর্ড প্রকল্পের আওতায় সমস্ত মাধ্যমিক স্তরের স্কুলকে নিয়ে আসা।• উচ্চশিক্ষায় আর আই এস ই প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করা। • ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি। একই সঙ্গে আইনশিক্ষা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি। • উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে কাজের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য ইএনইএস প্রকল্পে আর্থিক সাহায্যদান।
পরিকাঠামো : ১০০শতাংশ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ। • প্রতিটি সাবালক নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। • প্রতি বাড়িতে টয়লেট। প্রতি বাড়িতে নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ।• জাতীয় সড়কের দ্বিগুণ বৃদ্ধি। বিমানবন্দরের সংখ্যা ১৫০ করা।বন্দরের ক্যাপাসিটি ২৫০০ মেট্রিকটন করা। • সমস্ত লাভজনক রেলপথকে ব্রডগেজ লাইনে পরিণত করা। • সব রেলস্টেশনের ওয়াই ফাই সংযোগ করা। • ২০২২-এর মধ্যে ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোর সম্পূর্ণ করা। • স্মার্ট রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা। • ২০২২-এর মধ্যে সমস্ত রেলপথে বিদ্যুতায়ন।• পৃথক জলমন্ত্রক গঠন। ১০০ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রহ। পেট্রোলে আরও ১০ শতাংশ ইথানল মেশানোর চেষ্টা। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের শহরে পাটপলাইনে গ্যাস সরবরাহ।সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য হাই স্পিড অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক গঠন।সমস্ত গ্রাম ও শহরকে আবর্জনামুক্ত করে ওডিএফ মর্যাদা দেওয়া।
স্বাস্থ্য : আয়ুষ্মন ভারত প্রকল্পে ১.৫ লক্ষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি।• ৭৫টি নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপন।• শিশুস্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা তিনগুণ বৃদ্ধি করা।ডাক্তার : জনসংখ্যা অনুপাত ১:১৪০০ করা। পোষণ অভিযান। প্রকল্পে অপুষ্টি স্তর কমানো।
সুশাসন প্রতিটি পরিবারের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ব্যঙ্ক স্থাপন। • সমস্ত আদালতে ডিজিটাল টেকনোলজি চালু করা। • ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে অর্থনৈতিক আদানপ্রদান। • সরকার কাজকর্মে ডিজিটাল টেকনোলজি প্রয়োগ। • বায়ু দূষণের প্রকোপ দূর করা। •মহাকাশে প্রথম ভারতীয় নভেশ্চর প্রেরণ।
নারী উন্নয়ন : নারীকর্মীর সংখ্যাবৃদ্ধি। • তিন তালাক প্রথা রদে আইন প্রণয়ন।
সাংস্কৃতিক উন্নয়ন :২০১১ সালের মধ্যে গঙ্গার দূষণমুক্তি।• স্বদেশ দর্শন, প্রসাদ এবং হৃদয় প্রকল্পের রূপায়ণ।সব সংগ্রহশালায় ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে কাজকর্ম চালু করা।
সামগ্রিক উন্নয়ন : সমস্ত শিশুর জন্য রোগ প্রতিষেধক।• সমস্ত সরকারি ভবনে অবাধ প্রবেশ। প্রধানমন্ত্রী শ্রমযোগী মানধন প্রকল্পের আওতায় সমস্ত দোকানদারদের অন্তর্ভুক্তিকরণ। • অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা দান। • সমস্ত জনজাতি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে ৬টি সংগ্রহশালা তৈরি করা।
অর্থাৎ নির্বাচনী ইস্তাহারের প্রতিটি বিষয় গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে এটা স্পষ্ট যে, এই ইস্তাহার ভিক্ষাদানের ইস্তাহার নয়। এই ইস্তাহার দেশের নাগরিকদের ভিখারি বানানোর ইস্তাহার নয়। উন্নয়নের সমস্ত সূচক যাতে সম্মানে পৌঁছতে পারে। মানবসম্পদ উন্নয়নের সমস্ত সূচকগুলি যাতে পরিপুষ্ট হতে পারে সেই সব দিতে সমান ভাবে মানবিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিপাতই এই ইস্তাহারের লক্ষ্যণীয় বিষয়। এই ইস্তাহার বুঝিয়ে দেয় পাঁচ বছর নয়। মোদীজীর লক্ষ্য দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন যা ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদে যেমন দীক্ষিত করবে তেমনি গর্বিত করবে ভারতবাসী হওয়ার জন্য। তাই ২০১৯-এর বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার ঐতিহাসিকভাবেই একটি অনন্য অধ্যায়ের সংকল্পপত্র।
সনাতন রায়
2019-04-22