বলরাম জয়ন্তী

আগামী ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১; ২৬ শে ভাদ্র, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, রবিবার ভাদ্র শুক্লাষষ্ঠীতে ভারতীয় কৃষকসমাজে কৃষি ও গো-পালনের দেবতা ভগবান বলরাম জয়ন্তী পালিত হবে। করোনা পরিস্থিতিতে সামগ্রিক আচরণ বিধি মেনে গৃহেই পালিত হোক এই পবিত্র তিথিটি। আপনি আগে থেকেই ভগবান বলরামের একটি ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে তা শক্তকাগজে সাঁটিয়ে, ছবিতে ফুলমালা দিয়ে, সাধ্যমতো নৈবেদ্য সাজিয়ে সামান্য আয়োজনে সপরিবারে বলরাম পূজনে ব্রতী হোন। বলরাম পূজনের ছবিটি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করুন। অন্যদেরও পূর্বে জানান এবং দিনটি পালন করবার অনুরোধ করুন।

ভারতীয় কৃষকের আরাধ্য দেবতা বলরাম

থমাস হার্ডির লেখা ‘ইন দ্য টাইম অফ দ্য ব্রেকিং অফ নেশনস্’ কবিতাটি যখন হায়ার সেকেন্ডারি পড়ি, আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কবিতাটি পড়াতে গিয়ে ভগবান বলরামের কথা বলেছিলেন। কবিতায় আছে, “Only thin smoke without flame/From the heaps of couch-grass;/Yet this will go onward the same/Though dynasties pass.” যুদ্ধ হবে, জাতির পতনোত্থান ঘটবে, সাম্রাজ্যের বদল হবে, তবুও কৃষিক্ষেত্র একই ভাবে ফলদায়ী হবে, কৃষক আপন জমিতে লাঙ্গল দিয়ে মাটির ঢেলা ভাঙ্গবে, জমিতে আগাছা-ঘাসের আগুন-ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে উঠবে। সভ্যতা আপনার প্রয়োজনের গতিতে এগিয়ে চলবে, থেমে যাবে না।

জানা যায়, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধে হলধর ভগবান বলরাম কোনো পক্ষই অবলম্বন করেন নি। তিনি তীর্থে তীর্থে যাবার পথে পথে কৃষক সমাজকে কৃষিকাজে উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। কারণ বহু কৃষক বহু রাজার সৈন্যরূপে যুদ্ধে গেছেন, কৃষিকাজ না হলে বিপুল মানুষের গ্রাসাচ্ছাদন বন্ধ হয়ে যাবে৷ আপন আচরণে এই বার্তাটি দেবার মাধ্যমে ভগবান বলরাম বুঝিয়েছেন, দল-নিরপেক্ষভাবে, গোষ্ঠী-নিরপেক্ষভাবে সকল কৃষককে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কৃষির মাধ্যমে দেশহিতৈষণায় নিয়োজিত থাকতে হবে। কিন্তু কৃষিকাজ থেকে কৃষক যেন আপন সৌকর্যে আপন প্রাপ্তি লাভ করেন, তারজন্যও ভগবান অনন্ত আশীর্বাদ রেখে গেছেন। ভগবান বলরাম আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন, কীভাবে সকল বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-কষ্ট ধৈর্য্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে আত্মবল, আত্মবিশ্বাস ও সংগঠিত শক্তিকে সাথী করে দুষ্টের দমন করা যায়, আরদ্ধ কাজ সমাপ্ত করা যায়। শ্রীবলরাম কৃষক চৈতন্যকে জাগ্রত করার এক মহাশক্তি — কৃষির বিকাশ ও উন্নয়নের দেবতা।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে ভগবান বলরামকে দুধ আর পুত্রের দাতারূপেও পূজা করা হয়। তাঁর জন্মদিনে সমগ্র ভারতের নানান অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় উৎসব। মহিলারা ব্রত উৎযাপন করেন। অনুষ্ঠিত হয় মেলা ও কৃষি-কৃষ্টির নানান উৎসব। এই দিনটিকে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ তাদের প্রেরণাদায়ী দেবতার আবির্ভাব তিথিরূপে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে। ভাদ্রমাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় বলরাম জয়ন্তী। তিনি কেবল পরম্পরাগত চাষের দেবতা নন, তিনি চাষের প্রকার, সেচন প্রক্রিয়া ও বিকাশের আশীর্বাদক। উন্নত কলাকৌশলে চাষাবাদ, তারই সুবাদে ধন-ধান্যে সম্পদশালী জীবনের তিনি ভারতীয় প্রেরণা। তাঁর অস্ত্র ‘হল’, তাই নাম ‘হলধর’ বা ‘হলায়ুধ’, অর্থাৎ লাঙ্গলধারী ঈশ্বর তিনি, কৃষিকৃষ্টির দেবতা। লাঙ্গল হচ্ছে কৃষি ও গ্রাম বিকাশের লক্ষ্যে এক নির্মাণের প্রতীক। কিন্তু নির্মাণের জন্য অশুভ শক্তিকে, অধর্মকে পরাস্ত করতে হয়, দুষ্টকে দমন করতে হয়, তার জন্যও আয়ুধ দরকার। সেই আয়ুধ হল মুষল, যা ধার্মিক আর শিষ্টলোককে পালন ও রক্ষণে সহায়তা করে।

কে এই বলরাম?
তিনি বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম অবতার। তিনি বসুদেব ও রোহিণীর পুত্র, শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, শুভ্র গাত্রবর্ণ তাঁর। তিনি বলদেব, বলভদ্র, অমিত শক্তির অধিকারী। আপন বলে অতিশয় উন্নতির এক ঐশী নাম হচ্ছে ‘বলভদ্র’। তিনি ‘সঙ্কর্ষণ’, কারণ তিনি দেবকীর সপ্তম গর্ভ, যোগমায়া সেই গর্ভ সঙ্কষণ করে রোহিণীর গর্ভে সংস্থাপন করেছিলেন, তাই তার নাম হল ‘সঙ্কর্ষণ’। তিনি ‘শেষনাগ’, নাগরাজ শেষের অবতার, তার মধ্যেই এই নাগ অবস্থান করতেন। দেখা যায়, মৃত্যুকালে যদুবংশ ধ্বংসের আগে, কৃষ্ণের মৃত্যুর পূর্বে যোগসমাহিত ধ্যানস্থ বলরামের মুখ-গহ্বর থেকে লাল রঙের হাজার-মুখো-সাপ বেরিয়ে এসে সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। ‘বলরাম’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এই রকম — ‘বল’ শব্দের অর্থ ‘শক্তি’, আর ‘রাম’ কথাটির অর্থ ‘রমন’ বা ‘আনন্দ’, আধ্যাত্মিকতার আনন্দ, একত্রে বলরাম, শক্তি ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে বলরামের আবির্ভাব।

দ্বাপর যুগে তিনি যেমন শ্রীকৃষ্ণের অগ্রজ, ত্রেতা যুগে তিনি শ্রীরামের অনুজ। দুই যুগেই ভারতীয় গার্হস্থ্য জীবনের শুভঙ্করী আদর্শে পরিচালিত ভ্রাতৃশক্তি। দুই যুগেই তিনি শ্রীবিষ্ণুর মূল আধার রাম ও কৃষ্ণের সহায়ক শক্তি, তাদের বহুবিধ বিপদের সহায়তাকারী। বলরাম গদাযুদ্ধে পারদর্শী এবং ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধের শিক্ষাগুরু।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.