প্রাক-নির্বাচনী রাজনীতি শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। যে লড়াই দলের মতাদর্শের সঙ্গে মতাদর্শের হওয়ার কথা, সে লড়াই প্রার্থীর প্রতি ন্যক্কারজনক ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিণত হচ্ছে। বিশেষত মহিলা প্রার্থীর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ তাঁর ব্যক্তি পরিচয়কে অতিক্রম করে লিঙ্গভিত্তিক হয়ে উঠছে। মহিলাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির মূলভাব, সেখানে কোনো মহিলাকে লিঙ্গভিত্তিক আক্রমণ শুধু শালীনতা নয়, ভারতীয় সংস্কৃতিরও সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খান রামপুরের বিজেপি প্রার্থী জয়াপ্রদাকে অশ্লীল যৌন-ইঙ্গিতে আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেন উত্তরপ্রদেশের মানুষ হয়তো জয়াপ্রদাকে সতেরো বছরেও চিনতে পারেননি কিন্তু আজম খান নাকি তার অন্তর্বাসের রং পর্যন্ত জেনে গিয়েছেন মাত্র ১৭ দিনে। ইঙ্গিতটি অশ্লীল শুধু নয়, আজম খানের সুপ্ত ধর্ষকামের নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশও বটে। আজম খান এক্ষেত্রে এমন এক সমাজের প্রতিনিধি যে সমাজ মহিলাদের লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ের বাইরে তাদের মনুষ্যসত্তাকে বিবেচনা করতে রাজি নয়। এবং যারা নারীত্বকে লজ্জা ও সঙ্কোচের বিষয় বলে মনে করেন বলেই নারীর লিঙ্গবৈশিষ্ট্যের প্রতি কুরুচিকর ইঙ্গিত করে নারীকে সঙ্কুচিত, অবদমিত করতে চান। এরা সেই প্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি বিস্মৃত হয়েছেন, যে সংস্কৃতিতে নারী সকল রূপেই পূজ্যা। কারণ নারীই প্রকৃতি। নারীই ধারণকী, মাতৃরূপিণী, ধরিত্রী। স্ত্রী-রূপিণী নারীর মধ্যেও মাতৃরূপিণীর বাস। নারী কেবল তার যৌনতার পুত্তলিমাত্র নয়। বরং নারীর সৃষ্টিধর্মই তাকে করে তোলে প্রকৃতিস্বরূপা, প্রাণদায়িনী। কিন্তু আজম খান এতসব ভাবেননি। প্রকাশ্য জনসভায় নির্দ্বিধায় জয়াপ্রদাকে অপমান করে তিনি ভেবেছেন যে এর দ্বারা বিজেপিকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু বিজেপি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের নাম। তাকে আক্রমণ করতে গেলে পাল্টা মতাদর্শ ও বিকল্প কার্যপ্রণালীর দ্বারা করতে হবে। বিজেপির একজন মহিলা প্রার্থীকে অশালীনভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলে কেবল নিজের কাপুরুষতাই প্রকাশ পায় মাত্র। তবে হ্যাঁ, ভারতীয় জনতা পার্টি যেহেতু সমস্ত ভারতীয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, ফলে আজম খানের এহেন আচরণে তারাও লজ্জিত বৈকি। দেশের এক নাগরিক যদি দেশজ সংস্কৃতিকে অসম্মান করে, তবে ভারতীয় জনতা পার্টি লজ্জিত বোধ করে। কিন্তু বাস্তবে এ লজ্জা সর্বাধিক গ্রাস করা উচিত আজম খানকেই। কারণ আদতে ওই অশালীন মন্তব্য করে তিনি জয়াপ্রদাকেও নয়, বিজেপিকেও নয়, অপমান করেছেন গোটা সমাজকে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মহিলাকে।
আজম খানের এহেন মন্তব্য নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে বুঝতে পেরেই ‘দ্য ওয়ার’ নামক কুখ্যাত (অর্ধসত্য ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের জন্য কুখ্যাত) সংবাদমাধ্যমের এক অতি পরিচিত লিবারেল মনোভাবাপন্ন সাংবাদিক, শ্ৰীমতী আরফা খানুম, আজম খানের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি। নিজে মহিলা হওয়া সত্ত্বেও আজম খানের মন্তব্যের অবিমিশ্র নঞর্থকতাকেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কিছুটা লঘু করে দেখাতে চেয়ে টুইট করেছেন। বলেছেন, আজম খান নাকি ওই মন্তব্য। জয়াপ্রদার উদ্দেশ্যে নয়, বরং অমর সিংহের উদ্দেশ্যে করেছিলেন। কিন্তু আরফার এমন টুইটের জবাবে মানুষ কড়া প্রত্যুত্তর দেওয়ায় আরফা টুইইটি ডিলিট করতে বাধ্য হন। আজম খানের হয়ে আরফা খানুমের ওই মিথ্যে সাফাই কোনো কাজে আসেনি। কারণ যাঁরা আজম খানের বক্তৃতা শুনেছিলেন, তাঁরা জানেন যে আজম খানের ওই অশালীন ইঙ্গিত জয়াপ্রদার উদ্দেশ্যেই ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিজেকে লিবারেল বলে দাবি করা আরফা খানুম কেন নিজে একজন মহিলা হয়ে আর একজন মহিলার অপমানের পরেও মহিলাটির পাশে না দাঁড়িয়ে আজম খানের পাশে অর্থাৎ অপমানকারীর পাশে দাঁড়ালেন? এ নিয়েও চলেছে জল্পনা। তবে কি এই ঘটনার মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভেদরেখা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ? অপমানকারীর নাম আজম খান বলেই কি আরফা খানুম নামের লিবারেল সাংবাদিক তার রক্ষণার্থে টুইট করেছিলেন? অর্থাৎ নিজে মুসলমান মহিলা বলেই কি আরফা মুসলমান পুরুষটির হয়ে সাফাই দিতে চেয়েছিলেন? আরফার পক্ষপাতদুষ্টতা কি তবে জয়া’র প্রতি আজম খানের মৌখিক আক্রমণকে একটা কম্যুনাল মাত্রা দিয়ে দিল? এসব প্রশ্ন উঠেছে।
আজম খানের হয়ে আরফা খানুমের সালিশি প্রমাণ করে যে নিজেদের লিবারেল ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা সাংবাদিককুলের সকলেই যে লিবারেল, এমন নাও হতে পারে। উপরন্তু, এক মহিলাকে কুৎসিত অপমান করার পরেও লিবারেল মহিলা সাংবাদিক আরফা খানুমের আজম খানপ্রীতি তথাকথিত বামপন্থী ফেমিনিজমের অসারতাকেও জনসমক্ষে উন্মুক্ত করে।
দেবযানী ভট্টাচার্য
2019-04-26