সুরের ছন্দে কখনও বেঠোভেন, কখনও মোৎসার্ট। গোটা প্রেক্ষাগৃহ সুর, তাল, লয়ে মাতোয়ারা। স্তব্ধ, নির্বাক দর্শকদের মুখে তৃপ্তির হাসি। এমনটা যে হবে তা স্বপ্নেও ভাবা যায়নি। স্টেজের উপর তখন একমনে বেহালায় সুর তুলছেন যুবক। বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছেন সুবেশা তরুণী, ড্রামে ঝঙ্কার তুলছেন মধ্য চল্লিশের সুদর্শন। সঙ্গীতের চমক যতটা, তার চেয়ে ঢের বেশি চমক বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহে। সবই কাঁচা আনাজ দিয়ে বানানো মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট। তার থেকেই বেরিয়ে আসছে অনবদ্য সুর।
ব্যান্ডের নাম ‘ভেজিটেবল অর্কেস্ট্রা।’ অস্ট্রিয়ার এই ব্যান্ড এখন হিল্লোল তুলেছে গোটা বিশ্বেই। লন্ডন, জার্মানি, সিঙ্গাপুর— সবজি-বাদকদের সুরে সুর মেলাতে উপচে পড়ে দর্শক-শ্রোতাদের ভিড়। কখনও হালকা রোম্যান্টিক টিউন, কখনও সমবেত বাদ্যযন্ত্রের উচ্ছ্বাস, সবজি দিয়েও যে এমন বোল তোলা যায় সেটা ব্যান্ড বাদকদের না দেখলে থুড়ি না শুনলে ঠিক বোঝা যাবে না।
‘ভেজিটেবল অর্কেস্ট্রা’ বা ‘দ্য ভিয়েনা ভেজিটেবল অর্কেস্ট্রা’— এই ব্যান্ডের পথ চলা শুরু ১৯৯৮ সালে। দশ জন মিউজিশিয়ান, একজন রাঁধুনী এবং একজন সাউন্ড টেকনিশিয়ান, এই হলো ব্যান্ডের ভরা সংসার। ব্যান্ড বাদকরা প্রায় প্রত্যেকেই নানান দিকে পারদর্শী। কেউ ধ্রুপদী সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত, কেউ সাউন্ড পোয়েট, কেউ ভাস্কর্য শিল্পে পারদর্শী, কেউ ডিজাইনার আবার কেউ বিখ্যাত স্থপতি। নানা পেশা, নানান ধরন। সবে মিলেই ব্যান্ড ‘ভেজিটেবল অর্কেস্ট্রা’।
‘‘সবজির উপর সবসময় ভরসা রাখা যায় না,’’ জানিয়েছেন ব্যান্ডের অন্যতম শিল্পী সুসানা গার্টমেয়ার। অর্কেস্ট্রায় তাঁর হাতে খোলে ‘ক্যারট মারিম্বা’, বা কখনও গাজর দিয়ে বানানো বাঁশি অথবা অন্য কোনও সবজি-বাদ্য। সুসানার কথায়, ‘‘একরকম আনাজ থেকে ভিন্ন সুরও বার হতে পারে। গাজরের মারিম্বায় যেটা হয়, গাজরের বাঁশিতে সেটা নয়। পুরো কাজটাই খুব চ্যালেঞ্জিং।’’
ট্রাডিশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট যেখানে ১০০ বছর টিকে যায়, আনাজপাতি দিয়ে বানানো বাদ্যযন্ত্রের আয়ু সেখানে মাত্র ছ’ঘণ্টা, বললেন সুসানা। তার মধ্যেই গোটা কনসার্ট শেষ করতে হয়। সবজির বাজার করেন শিল্পীরা নিজেই। সুসানার কথায়, রোজ সকালে ব্যাগ ভর্তি কাঁচা আনাজ কিনে আনেন তাঁরা নিজেরাই। টাটকা, তাজা আনাজপাতি ধুয়ে, কেটে তা দিয়েই বানানো হয়ে নানা বাদ্যযন্ত্র। কুমড়ো, পেঁয়াজ, বেগুন, টম্যাটো, শাকপাতা, গাজর, মূলো থেকে কখনও কখনও শশা বা অন্য ফলও ব্যবহার করা হয় ইনস্ট্রুমেন্ট তৈরিতে। এক একটা কনসার্টে প্রায় ১৫০ রকম সবজি দিয়ে বানানো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। কনসার্ট শেষে সেগুলো দিয়ে স্যুপ বানিয়ে দর্শকদের সার্ভ করা হয়। ‘ভেজিটেবল অর্কেস্ট্রা’ শোনার পর ভেজিটেবল স্যুপ নাকি জমিয়ে উপভোগ করেন শ্রোতারা।
ক্রিস্টিনা বর, জুয়েরগান বারলাকোভিচ, নিকোলাস গ্যানসটেরার, সুসানা গার্টমেয়ার, বারবারা কায়সের, ম্যাথিয়াস মেইনহার্টার, জ়র্গ পিরিঞ্জার, রিচার্ড রেপে, মেরি স্টেইনওয়ার, ইনগ্রিড, আলরিচ ট্রয়ার এবং তামারা উইলহেলম— ব্যান্ডের এই সৈনিকরা গত ২১ বছরে অন্তত ৩০০টা কনসার্ট করেছেন। চলতি বছর শো ছিল জার্মানিতে। ‘‘শুরুটা হয়েছিল মজা করেই। তারপর সেটাই ইতিহাস হয়ে গেল,’’ বলেছেন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী ম্যাথিয়াস। জানালেন, তিনি এবং আরও তিন জন শিল্পী মিলে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটির একটি ফেস্টিভালে প্রথম সবজি নিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। তখন বাদ্যযন্ত্রও ছিল অনেক অল্প, অতটাও নিখুঁত ছিল না, কিন্তু দর্শকরা খুব পছন্দ করেছিল। ফেস্টিভালের অন্য অনুষ্ঠানের মধ্যে আলাদা করে নজর কেড়েছিল তাঁদের মিউজিক। সেই শুরু হয় পথ চলা।
ম্যাথিয়াসের কথায়, ‘‘প্রথম শো সফল হওয়ার পরই ভাবতে শুরু করি, আরও কী নতুনত্ব আনা যায়। কী ভাবে দর্শকদের চমক দেওয়া যায়। মিউজিকের পরে গরম স্যুপের আইডিয়াটাও ক্লিক করে যায়।’’ লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, সাংঘাই আর্ট সেন্টারের মতো নামী দামি জায়গায় ইতিমধ্যেই এই ব্যান্ডের কনসার্ট হিট। ‘‘প্রথমে অনেকেই মনে করতেন এটা মজার পারফর্ম্যান্স। ভেলকি দেখানোর মতো। শোনার পরে শ্রোতাদের সেই ভুলটা ভাঙে। শুরুতে ব্যঙ্গ করলেও, পরে এগিয়ে এসে তারিফ করেছেন অনেকেই,’’ সুসানার চোখে গর্ব।
কাঁচা ঝাঁঝাঁলো পেঁয়াজ থেকে বৃষ্টির টুপটাপ ফোঁটার মতো শব্দ হয়, কুমড়ো থেকে ড্রামের বোল বার হয়, দু’টো পেঁয়াজকলি পরস্পরকে ঘষলে গিটারের স্ট্রিংয়ের মতো ধ্বনি হয়, প্রত্যেক সবজিরই নিজস্বতা আছে, জানিয়েছেন সুসানা। তাঁর কথায়, সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে দু’টো সবজি একসঙ্গে করে অর্থাৎ হাইব্রিড বাদ্য বাজানো। স্যাক্সোফোনের মতো বোল তোলাও খুব একটা সহজ নয়। শশার সঙ্গে বেল পেপারের সংমিশ্রণে স্যাক্সোফোনের বোল তুলতে পারেন শিল্পীরা, যার পোশাকি নাম ‘কিউকাম্বারফোন’।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক ধরনের রসুন পাওয়া যেটা দিয়ে বেস স্ট্রিং বাজানো যায়, বিনস দিয়ে মারাকা, বলেছেন ম্যাথিয়াস। ব্যান্ডের সবচেয়ে দক্ষ পামকিনিস্ট জুয়েরগান বারলাকোভিচের কথায়, বিশ্বের এক একটা দেশের তাপমাত্রার বৈচিত্র্য, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও সবজির তারতম্যের জন্য কোনও বিশেষ টাইমলাইন তৈরি করা যায় না। শিল্পীরা এ ক্ষেত্রে কনসার্টের সময় একটা সিক্রেট কোড ব্যবহার করেন। কখন কোন সুর উচ্চগ্রামে হবে, আবার কোনটা একেবারেই লো পিচে, সেটা এই কোড দিয়ে ঠিক করা হয়।
লাইভ কনসার্ট ছাড়াও এই ব্যান্ডের সিডি রয়েছে, ‘Gemise’ (১৯৯৯) ‘Automate’ (২০০৩)‘Onionoise’ (২০১০)। সম্প্রতি রিলিজ করেছে ‘Krautfunding’।
বারবারা কায়সার জানিয়েছেন তাঁর অন্য অভিজ্ঞতার কথা। গ্রীষ্মপ্রবণ দেশগুলিতে কনসার্টের সময় অনেকটাই কমিয়ে আনতে হয়। কারণ কাঁচা আনাজ পচে যাওয়ার ভয় থাকে। বিশেষ করে বাঁধাকপি। তাই কোনও কোনও শো ৯০ মিনিটেও শেষ করে ফেলতে হয়। তাঁর কথায়, ‘‘সমস্যা থাকে অনেক, তাও আমার কাছে এটা মাল্টি-সেনসরি পারফর্মিং অ্যাক্ট। সঙ্গীতকে এখানে অনুভব করা যায়, তার গন্ধে ভরে ওঠে মন। সবজি-সঙ্গীতের স্বাদও অনবদ্য।’’
আগামী দিনে বিশ্বের আরও নানা দেশে কনসার্টের পরিকল্পনা করে ফেলেছে ‘ভেজিটেবল অর্কেস্ট্রা।’ স্বাদে-গন্ধে-সুরে-ছন্দে এই ব্যান্ডের পারফরম্যান্স শুনতে আগ্রহী ভারতের শ্রোতারাও।