প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর হাত ধরেই অবশেষে “আত্মনির্ভর ভারত”-এর বিমূর্ত ধারণা মূর্তরূপ পেতে চলেছে। ৯০-এর দশক থেকে নীতি নির্ধারক ‘স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ’ স্বদেশী আদর্শের জন্য লড়াই চালিয়ে আসছে।সেই গণ আন্দোলন সাফল্যের বৃত্ত পূর্ণ করতে চলেছে।দাক্ষিণাত্যের জনজাতিদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করার জন্যই স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম প্রথমে শুরু হয়েছিল।এতদিন পরে এসে তাদের সেই জাগরণ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
মঞ্চের এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ সরল,ঋজু বা ফুল ছড়ানো ছিলনা।পদে পদে নানা বাধা তাদের গতি রুদ্ধ করতে চেয়েছে।১৯৯১ সালের ২২ নভেম্বর মঞ্চের প্রতিষ্ঠা হয় মহারাষ্ট্রের নাগপুরে।এই নাগপুরের রেশমবাগেই প্রতিষ্ঠিত হয় আরেকটি রাষ্ট্রবাদী-স্বদেশপ্রেমী অরাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের।সেটা ১৯২৫ সালের কথা।
যাইহোক।
স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সার্বভৌমত্বের এক নতুন অধ্যায়।সঙ্ঘের প্রবীন প্রচারক দত্তপন্থ ঠেংড়িজীর উদ্যোগেই মঞ্চের প্রতিষ্ঠা হয়।ঠেংড়িজীর ব্যক্তিগত সাংগাঠনিক দক্ষতা,বুদ্ধিমত্তা আর বাগ্মিতা স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের চলার পথ অনেকটাই সুগম করে দেয়।মঞ্চের প্রথম পাঁচ বছর ছিল নানা মতভেদে ভরা।তা স্বত্ত্বেও সার্বিক ভাবে মঞ্চ ভুবনায়নের নামে সার্বভৌমত্ব খর্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখে।
মঞ্চের সহকারি আহ্বায়ক অশ্বনী মহাজন(ASHWANI MAHAJAN) বলছিলেন যে, “ক্ষমতার অলিন্দে থাকা এবং বিশ্বায়নের প্রবক্তাদের ভুবনায়নের অন্ধকার-দিক আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।কেন না,তাঁদের উপর আমাদের প্রভাব ফেলতে আমরা সমর্থ হই নি।তাঁরা আশ্বাস দিচ্ছিলেন বিশ্বায়নের কোনোরূপ কুফল আমাদের দেশে পড়বে না।”
তিনি আরও বললেন, “উদারিকরণ ও বিশ্বায়ন দুটোই মনোহারি শব্দ।শব্দের যাদুতে সকলেই মোহিত হয়ে পড়ে।স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের মতো দু-একটি সংগঠন বা ব্যক্তি এই যাদুতে মোহিত হন নি।কিছু দিনের মধ্যেই এই মোহ সৃষ্টিকারি বিষয় দুটির অদৃশ্য দিক মানুষের সামনে আসতে লাগল।মানুষ বুঝতেও শুরু করলেন।”
১৯৯৬ সাল এসে মঞ্চের কন্ঠস্বর অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারকদের কানে পৌঁছতে লাগল।ওই বছর থেকেই মঞ্চ “স্বদেশী পত্রিকা” নামক মাসিক জার্নাল ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশ শুরু হয়।মহাজন বলছিলেন যে,নানারূপ প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও,এমন-কি কোভিড মহামারির আবহেও তাঁদের পত্রিকা প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটেনি।তাঁরা পরিকল্পনা নিয়েছেন আগামিতে পত্রিকার একটি ভার্চুয়াল সংস্করণও প্রকাশ করবেন।
বাজপেয়ী-যুগ ও স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ
১৯৯৮-২০০৪ সময়কালে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।বিজেপি-র নেতৃত্বে কেন্দ্রে জাতীয় গণতান্ত্রিক মৈত্রী জোট (NDA) ক্ষমতায় আসে।প্রধানমন্ত্রী হন বাজপেয়ী।যদিও বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিল না।তাই জোটের বাধ্যবাধকতায় বাজপেয়ী অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি।কতিপয় রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলে থাকেন বাজপেয়ীকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS) পরিচালনা করত।যদিও বিষয়টি সঠিক নয়।সেই সময় থেকেই মঞ্চকে আর পিছনে আটকে থাকতে হয় নি।বিলগ্নিকরণ ও অন্যান্য বিষয়ে মঞ্চ বাজপেয়ী সরকারের সমালোচনাও করেছে।মঞ্চের সক্রিয় কর্তাব্যক্তিরা সেই সময় সরকারকে কিছু ইতিবাচক পরামর্শও দিয়েছে।অনেক সময়ই তা বাস্তবায়িত করা যায় নি জোটের কারণে।
যদিও বাজপেয়ী-ক্যাবিনেটের অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা,বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ ও বিলগ্নি সংক্রান্ত মন্ত্রী অরুণ শৌরী ছিলেন আর.এস.এস.-এর আদর্শে দীক্ষিত।মঞ্চ রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বদেশপ্রীতি রক্ষার জন্য নানা বিষয়ে সরকারের উপর চাপ বজায় রেখেছিল।
সংযুক্ত প্রগতিশীল মৈত্রী জোট (UPA) যুগ
বাজপেয়ী যুগের অবসানে দেশে এলো ইউ পি এ যুগ ; কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি পঙ্গু সরকারের যুগ।যারা ২০০৪-২০১৪ পর্যন্ত ভারতকে সবদিক দিয়েই পিছনের সারিতে নিয়ে গেল।প্রথম পাঁচ বছর নৈতিকতার দোহাই দিয়ে বাম দলগুলি সরকারে না-থেকেও কংগ্রেসকে “নীতিগত” সমর্থন দিল কিছু কিছু সাধারণ শর্তের বিনিময়ে।বিজেপি-কে ঠেকাতে সব অ-ভারতীয় মনোভাবাপন্ন দলগুলি একজোট হয়ে ইউ পি এ গঠন করে।বামেরা চেয়েছিল সরকারের বাইরে থেকে নাকে দড়ি দিয়ে সরকারকে ‘কলুর বলদ’-এর মতো ঘোরাতে!তারা এ-বিষয়ে সফলও হয়েছিল।ইউ পি এ-র প্রথম পাঁচ বছর মনমোহন সিং সরকার নীতি পঙ্গু-হীনতায় কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্তই নিতে পারে নি বামেদের বাধা দানের কারণে।মঞ্চের জনৈক কর্তা বলেন, “মঞ্চ সব বিষয়গুলিই গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছিল।এও দেখেছিল যে,দেশকে ইউ পি এ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।”
ইউ পি এ-র দ্বিতীয় জমানায় স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ অন্যান্য বিরোধী দলগুলির সাথে হাত মেলায়।এবং ইউ পি এ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে।বলা চলে যে,সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পর যেম যুদ্ধংদেহী মেজাজে ছিল।বিশেষত দ্বিতীয় ইউ পি এ জিনগত পরিবর্তীত শস্য চালুর করার জন্য ছিল দৃঢ় সংকল্প।মঞ্চ ও বিরোধীরা এর তীব্র বিরোধীতা করে।
মোদী যুগ
নানা কারণেই আপামর ভারতবাসী নীতিহীন ইউ পি এ-কে ২০১৪-তে তীব্র ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।পচন ধরা কংগ্রেস সারা ভারতে ৪২টি আসন পায়।আর কমিউনিস্ট-সহ বামেদের ভারত থেকেই “সসম্মান”-এ বিদেয় করে চীনে বা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়।লোকসভায় বিজেপি একক গরিষ্ঠতা পেল।প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদী।২০১৯-এও দ্বিতীয় বার বিজেপি আরও শক্তি নিয়ে ফিরে এলো।এবারও প্রধানমন্ত্রী হলেন মোদী।মোদীর প্রথম ছয় বছরের শাসনকালে মঞ্চের দীর্ঘদিনের লালিত স্বদেশী আদর্শ অতি দ্রূত বাস্তবতা পেতে লাগল।জিনগত পরিবর্তীত শস্যের উৎপাদন বন্ধ বা কমানো,হিমঘরের সংখ্যা বৃদ্ধি,বিদেশী ঋণের বোঝা কমানো,সঞ্চয় বাড়ানো,নীতি আয়োগ গঠন এবং সর্বোপরি “আত্মনির্ভর ভারত” ইত্যাদি মঞ্চের দাবিগুলি সাকার রূপ পেল।
শ্রী মহাজন জানান যে,”২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার দু মাসের মধ্যেই জেনেটিক শস্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনে রাশ টানা হয়।যা বর্তমানেও বহাল রয়েছে।ওই বছরই অক্টোবরে মঞ্চের দাবি মতো জমি নীতি গৃহীত হয়।একই বিষয়ে পর পর তিনটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।” তিনি আরও জানান, “ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দুই গভর্ণর রঘুরাম রাজন ও উর্জিত প্যাটেল,নীতি আয়োগের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান অরভিন্দ্ পানাগেরিয়া স্বদেশী ভাবাপন্ন কোনো পদক্ষেপ নেন নি।”
অন্যদিকে,মঞ্চের দাবী মতো মোদী সরকার রিজিওনাল কম্প্রিহেনসন ইকোনমিক পার্টনারশিপে যোগ দেয় নি। “মঞ্চ মনে করে এতে করে মেক ইন ইন্ডিয়া,ডিজিটাল ইন্ডিয়া ও স্কিল ইন্ডিয়ার প্রকল্পে যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হত তা থেকে বঞ্চিত হলেন দেশের যুবক-যুবতীরা”-বলছিলেন মঞ্চের সহকারি আহ্বায়ক শ্রী মহাজন। মঞ্চের দ্বিতীয় কর্তা জানান যে, “অনেকেই প্রশ্ন করছেন,কী এমন হল যাতে মোদী সরকার মঞ্চের সাথে সহমত হচ্ছে না।আমরা তাঁদের বলছি যে,দ্বিতীয় মোদী সরকার আরও শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে।সেই কারণের দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও অনেক বেড়ে গিয়েছে।তাছাড়া আমাদের তিনটি মূল নীতি হল –সচেতনতা বৃদ্ধি,শিক্ষিত দেশবাসী ও গঠনমূকল প্রকল্পগুলি চালিয়ে যাওয়া।যা মোদী সরকারেরও নীতি।এ-বিষয়ে আমাদের সাথে কোনো মতপার্থক্য নেই।
সুজিত চক্রবর্তী।