নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান থেকে বন্যার জলের মতো ঢুকছে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক থেকে জাল নোট । জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) থেকে খবর পেয়ে দিনকয়েক আগেই নিয়ন্ত্রণরেখায় ব্যবসা-বাণিজ্যে লাগাম টেনেছে কেন্দ্র। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, নিরাপত্তার খাতিরেই এমন কড়াকড়ি। কিন্তু, নিরপত্তা বিধি মেনে নিয়ন্ত্রণরেখায় চোরাচালান কি আদৌ বন্ধ হয়েছে? গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে একেবারেই নয়, বরং পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে এমন থাকা দশ জঙ্গিকে সনাক্ত করা হয়েছে যারা প্রত্যক্ষভাবে উপত্যকায় পাচারকার্যের সঙ্গে জড়িত। এবং এরা সকলেই জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা।
এনআইএ সূত্রে খবর, এই দশ জন নানা সময় কাশ্মীর থেকে পাড়ি দেয় পাকিস্তানে। সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে বিভিন্ন নামে ভুয়ো সংস্থা খুলে বসে। এরা মূলত ছড়িয়ে রয়েছে ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিণ্ডি এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফফরাবাদে। পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মদতে নিয়ন্ত্রণরেখায় অত্যন্ত সক্রিয় এই দশ জঙ্গি। সীমান্ত পেরিয়ে আমন্ড, ড্রাই ফ্রুটস রফতানির আড়ালে এদের সংস্থা নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ত প্রহরা এড়িয়ে অবাধে উপত্যকায় চালান দেয় অস্ত্র, মাদক-সহ অনেক কিছুই। এমনকি উপত্যকার নানা জঙ্গি সংগঠন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের কাছে আর্থিক সাহায্যও পাঠানো হয় এদের হাত ধরেই।
পুলওয়ামা হামলার পর থেকে গোটা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাসবাদীদের স্লিপার সেল, এমনটাই জানিয়েছে এনআইএ। দিন কয়েক আগেই খবর মিলেছিল চিনে তৈরি স্পেশাল বুলেট সীমান্ত পেরিয়ে উপত্যকার জঙ্গিদের হাতে হাতে পৌঁছচ্ছে। এই বুলেট ভারতীয় সেনাদের জন্য তৈরি বিশেষ বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ভেদ করতে সক্ষম। গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণরেখার চাকান-দা-বাগ ও সালামাবাদের পথ ধরে যে কোনও রকম বাণিজ্যে রাশ টানা হয়েছে। তাও চোরা পথে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আমদানিতে খামতি পড়েনি।
পাকিস্তানের যে দশ জঙ্গিকে চিহ্নিত করেছেন এনআইএ-র অফিসাররা তাদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মেহরাজুদ্দিন ভাট। ত্রালের বাসিন্দা মেহরাজুদ্দিন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে পাকিস্তানে রওনা দেয় এক দশক আগেই। বর্তমানে তার ঘাঁটি রাওয়ালপিণ্ডিতে। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে অস্ত্র ও মাদক পাচারের অন্যতম মাথা সেই। ‘মেহরাজুদ্দিন ট্রেডারস’ নামে তার একটি সংস্থা রয়েছে।
মেহরাজুদ্দিনের ভাই নাজির আহমেদ ভাট আবার উরির ‘ট্রেড ফেসিলিটেশন সেন্টার’ (TFC)-এ কর্মরত। সুতরাং, পাকিস্তান থেকে তার মাধ্যমেই অস্ত্র-সহ অন্যান্য জিনিসপত্র ভারতে ঢুকছে অবাধে। সূত্র বলছে, পম্পোরের বাসিন্দা নাজির পাকিস্তানের জঙ্গি শিবিরেও অন্যতম সদস্য। সরকারি নথিতে সে টিএফসি-র সদস্য হলেও তার আরও দু’টি সংস্থা রয়েছে, ‘নিউ কাশ্মীর ট্রেডারস’ ও ‘নিউ কাশ্মীর ফার্ম।’
বাশরত আহমেদ ভাট। বদগামের বাসিন্দা পাকিস্তানে পাড়ি দেয় বছর দুই আগে। বর্তমানে তার ঘাঁটি রাওয়ালপিণ্ডিতে। ‘অল নাসির ট্রেডিং’ নামে একটি সংস্থা চালায় বাশরত যার মাধ্যমে উপত্যকায় অস্ত্র আমদানি করে সে।
নিয়ন্ত্রণরেখায় চোরাচালানের অন্যতম নাম শওকত আহমেদ ভাট। বদগামের বাসিন্দা শওকত বাশরতের মতোই বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানের জঙ্গি ক্যাম্পে নাম লেখায়। বর্তমানে রাওয়ালপিণ্ডিতে থাকলেও নিয়ন্ত্রণরেখায় সে খুবই সক্রিয়। ‘তাহা এন্টারপ্রাইস’ নামে তার একটি সংস্থা রয়েছে।
শ্রীনগরের বাসিন্দা খুরশেদের বর্তমান ঠিকানা ইসলামাবাদ। আট বছর আগে পাকিস্তানের জঙ্গি শিবির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখায় অস্ত্র ও মাদক পাচারের কারবার চালায় সে। সবটাই হয় তার সংস্থা ‘এম/এস খুরশেদ অ্যান্ড সনস’-এর মাধ্যমে।
বদগাম থেকে পাকিস্তানে গিয়ে জঙ্গি শিবিরে নাম লেখায় নূর মহম্মদ। রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ‘অল নূর’ সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণরেখায় চোরাচালানে সক্রিয়ভাবে যুক্ত সে।
বদগাম থেকে সাত বছর আগে পাকিস্তানে পাড়ি দেয় ইমতিয়াজ আহমেদ। বর্তমানে মুজফফরাবাদের বাসিন্দা। ‘এমআইকে ট্রেডারস’ ও ‘এম/এস ইমতিয়াজ ট্রেডারস’ নামে সংস্থার মাধ্যমে উপত্যকায় মাদক, অস্ত্র ও জাল নোটের কারবার চালায় সে।
বারামুল্লার আমির পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম মাথা। বর্তমানে রাওয়ালপিণ্ডির বাসিন্দা আমির নিয়ন্ত্ররেখায় অস্ত্র পাচারে খুবই সক্রিয়।
পাক জঙ্গি শিবির থেকে রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র ব্যবসা ফেঁদে বসেছে বারামুল্লার আজাজ রেহমানি। মুজফফরাবাদ ও ইসলামাবাদে রয়েছে তার ঘাঁটি।
‘এম এন ট্রেডিং কোম্পানি’ নামে একটি সংস্থা দুই দেশেই খুব সক্রিয়। গোয়েন্দা সূত্রে বলছে, ট্রেডিং কোম্পানির আড়ালে পাকিস্তান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করে এই সংস্থা। এর মাথা শাব্বির ইলাহি সোপোরের বাসিন্দা। বর্তমানে ঘাঁটি ইসলামাবাদে। হিজবুল মুজাহিদিনের সক্রিয় সদস্য সে।
উপত্যকায় স্লিপার সেল ছড়িয়ে দেওয়া, সন্ত্রাসের ছক কষা এবং কাশ্মিরীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে পরিকল্পিত হিংসা ছড়ানোর পিছনে এদের হাত রয়েছে।