আকারে মানুষের হাতের মুঠোর সমান। আসল কিডনি প্রতিস্থাপনের তুলনায় এই কৃত্রিম কিডনি বসানোর খরচ অনেক কম।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী শুভ রায়ের আবিষ্কার করা এই কৃত্রিম কিডনির বিশ্ববাজারে আসার সম্ভাবনা আছে ২০১৯-এর মধ্যেই।
কেবলমাত্র ভারতেই প্রত্যেক বছর খুব কম করে হলেও আড়াই লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় কিডনির বিভিন্ন অসুখে। এই কৃত্রিম কিডনি বাজারে এলে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ ও তাঁদের পরিবার পরিজনদের দুশ্চিন্তার দিন চিরতরে শেষ হবে। সেই স্বপ্নই দেখতেন বিজ্ঞানী শুভ রায়।
কে এই শুভ রায়?
আমেরিকা প্রবাসী এক বাঙালি বিজ্ঞানী। নিজেকে বলেন বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার।
ইনি বছর কয়েক আগেই সারা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন, বিশ্বে প্রথম কৃত্রিম কিডনি আবিষ্কার করে।
ঢাকার বিখ্যাত চিকিৎসক অশোক নাথ রায়ের পুত্র শুভ। জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর। আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম জেলার রোসাংগিরিতে।
ছোটবেলা থেকেই শুভ ছিলেন কল্পনাপ্রবণ। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয় তাঁকে বেশি আকর্ষণ করত। ঢাকার একটি নার্সারি স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলেন।
কিন্তু যখন শুভর বয়স পাঁচ, চিকিৎসক অশোক নাথ রায়কে কর্মসূত্রে চলে যেতে হয়েছিল আফ্রিকার উগান্ডা। বাংলাদেশ ছেড়ে ছোট্ট শুভ ভর্তি হয়েছিলেন উগান্ডার জিনজা সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে। সেখানেই স্কুল জীবন শেষ করে, আমেরিকা পাড়ি দেন শুভ।
ওহাইও’র মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ থেকে একই সঙ্গে কম্পিউটার সায়েন্স, ফিজিক্স ও গণিতে স্নাতক হন মেধাবী শুভ।
এর পর ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৫ সালে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি করেন। ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি করেন ২০০১ সালে।
১৯৯৮ সালে ওহাইও’র ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়ো মাইক্রো ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে যোগ দেন ডঃ শুভ রায়। মানুষের শরীরের অপার রহস্য তাঁকে তখন থেকেই ভাবাতে শুরু করে।
চাকরির সঙ্গে সঙ্গে ডঃ শুভ রায় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে থাকেন ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্স পড়াতে থাকেন কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটিতে।
২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মলিকুলার মেডিসিন পড়িয়েছিলেন লার্নার কলেজ অব মেডিসিনে।
এরপর, ২০০৯ সালে তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের নেফ্রোলজি বিভাগের দায়িত্বে আসেন। তখনই তিনি নিজের চোখে, খুব কাছ থেকে দেখেছেন কিডনির অসুখে ভুগতে থাকা মানুষদের। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা কিছু মানুষের মুখ তাঁকে রাতদিন ভাবাতো। দিনের শেষে ঘরে ফিরে কোনও কাজে মন বসাতে পারতেন না।
সারাক্ষণ ভাবতেন কীভাবে সারা বিশ্বে কিডনির অসুখে ভোগা মানুষগুলির মুখে হাসি ফোটানো যায়। কীভাবে আরও কিছুদিন তাদের আয়ু বাড়িয়ে দেওয়া যায়। রাতের পর রাত জেগে মানুষের কিডনির সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অংশগুলি ও তাদের কাজ নিয়ে পড়াশুনা করতেন মানুষটি।
মানুষের কল্যাণে শুরু করেছিলেন এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার ডঃ শুভ রায়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড থেরাপিউটিক সায়েন্স পড়িয়ে আসছিলেন ২০০৮ সাল থেকে। সেখানেই শুরু করলেন এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ৪০ জন অধ্যাপক ও গবেষককে নিয়ে শুরু করেছিলেন Bioartificial Kidney project বা কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে। গবেষক দলে ছিলেন বিশিষ্ট নেফ্রোলজিস্ট উইলিয়াম এফ ফিসেল।
দিনের পর দিন,ঘন্টার পর ঘন্টা চলেছিল নিরলস গবেষণা। একদিন, ডঃ শুভ রায় আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন silicon nanopore membranes (SNM)। এটি সিলিকন নির্মিত সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত একটি পর্দা, যা রক্তকে নিখুঁত ভাবে ছেঁকে ফেলতে সক্ষম। বাকিটা ইতিহাস।
৪১ জন নাছোড়বান্দা বিজ্ঞানীর নিরলস পরিশ্রমে তৈরি হয়ে গেল কৃত্রিম কিডনি।
আমাদের দু’টি কিডনি রক্তস্রোত থেকে দূষিত পদার্থগুলিকে ছেঁকে (Filter) নেয়। জীবন্ত কিডনি কোষ দিয়ে তৈরি বায়ো রিঅ্যাক্টর এবং সূক্ষ্ম পর্দার (SNM)মাধ্যমে কৃত্রিম কিডনি একইভাবে রক্ত শোধনের কাজ করতে পারে।
কীভাবে শরীরে বসানো হবে এই কৃত্রিম কিডনি ?
আমাদের তলপেটের পিছনদিকে আমাদের দু’টি কিডনি থাকে। সেখানেই যেকোনও একদিকে, কফির কাপের মতো দেখতে এই কৃত্রিম কিডনি বসিয়ে দেওয়া হবে। হৃদপিন্ড থেকে দূষিত রক্ত আসবে কৃত্রিম কিডনিতে। সেই রক্তকে ছেঁকে নিয়ে বিশুদ্ধ করে দেবে কৃত্রিম কিডনি।
একইসঙ্গে কৃত্রিম কিডনি নজর রাখবে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলির উৎপাদন ও ক্ষরণের ওপরেও। আসল কিডনির মতই রক্ত শোধন করা ছাড়াও এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ডি তৈরি করবে
সাধারণ মানুষ কবে পাবেন?
কৃত্রিম এই কিডনি আমেরিকার কয়েক হাজার রোগীর দেহে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয়েছিল। সে পরীক্ষায় সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে ডঃ শুভ রায়ের আবিস্কৃত Bioartificial Kidney। ডঃ শুভ রায় ও তাঁর টিম এখন Food and Drug Administration( FDA )-এর চুড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।
অনুমোদন আসতে চলেছে কিছুদিনের মধ্যেই। হয়তো এই বছরের শেষেই।
তারপর বিশ্ব বাজারে কৃত্রিম কিডনি আসতে বেশি সময় নেবে না। কারণ দ্রুত উৎপাদনের পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে।
প্রশ্ন একটাই, কত দাম হতে পারে একটি কৃত্রিম কিডনির?
সঠিক দাম এখনও জানা যায়নি। তবে, অসহায় পরিবারদের কিডনি রোগীর নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে, সব শেষে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বিরাট অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে হয়। তার তুলনায় কৃত্রিম কিডনি বসানোর খরচ অনেক কম হবে, বলে আশা দিয়েছেন ডঃ শুভ রায়।
তিনি এখন মগ্ন রয়েছেন কৃত্রিম অগ্নাশয় বা Implantable Bio-Artificial Pancreas (iBAP) তৈরিতে।