কাশ্মীরের মুসলমানরা কি সত্যিই ভারতীয়?

সম্প্রতি পুলওয়ামার ঘটনার পর দেশব্যাপী রাজনৈতিক দল, নেতা ও সাধারণ মানুষ নানা প্রকার মন্তব্য করেছেন। তারমধ্যে মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায়ের একটি বক্তব্য নিয়ে। দেশব্যাপী বিতর্কের ঝড় উঠেছে। প্রসঙ্গত, রাজ্যপাল মহোদয় কাশ্মীরিদের বয়কটের ডাক দিয়েছেন এবং তার এই বক্তব্যের জন্য বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও পাক পন্থী সেকুলারিস্টরা রাজ্যপালের পদ থেকে তার অপসারণের দাবি তুলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান (‘কলম’ পত্রিকা খ্যাত) তাঁর সম্পাদিত ‘পুবের কলম’ পত্রিকায় গত ১০ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সম্পাদকীয়র কলামে প্রধানমন্ত্রীকে শ্রী রায়ের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে কিছু বিষয়ের অবতারণা বড়োই প্রয়োজন।

১৯৪৭-এ দেশভাগ ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অল্পদিন পরেই পাকিস্তান হানাদার পাঠিয়ে কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হামলা করে। একমাত্র কারণ তখনও রাজা হরি সিংহের সৈন্যদের ওপর আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়ার নির্দেশ থাকলেও তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে হাত মেলায়। কাশ্মীরের রাজার সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার নারায়ণ সিংহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর তার মৃতদেহ লাইটপোস্টের মাথায় ঝুলিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে, ভারতীয় আর্মির পাল্টা মারে কাশ্মীরের অর্ধেক ভারতে এলেও প্রথম থেকেই তার প্রতি বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান করাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর প্রধান কর্তব্য হয়ে পড়ে। তার একটি হলো ৩৭০ ধারা, যার পাপ সমগ্র ভারতবর্ষ আজও নিজের রক্ত দিয়ে শোধ করে চলেছে। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নিঃসন্দেহে, কিন্তু কাশ্মীরি মুসলমানরা আদৌ ভারতীয় কিনা বা তারা ভারতীয় সভ্যতার অংশ কোনোদিন হয়ে ওঠার চেষ্টা করবে কিনা— সেটি বিচার করার দিন এসেছে।

যদি কোনো কাশ্মীরি মুসলমান ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বা পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন এবং নিহত হন তাদের নামাজ-ই-জানাজায় পরিবারের মানুষ ব্যতিরেকে আর কেউ যোগ দেন না। এই প্রথাটি কাশ্মীরি উপত্যকায় বহুকাল ধরেই চলে আসছে। যদি কেউ যোগ দেন তারা অত্যন্ত ভীত থাকেন নিরাপত্তার কারণে। পক্ষান্তরে কোনো উগ্রপন্থী বা জঙ্গি নিহত হলে তার নামাজ-ই-জানাজায় হাজার হাজার পাকপন্থী মুসলমান সমবেত হয়। এই প্রসঙ্গে দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রয়োজন বলেই মনে হয়। ১৯৮৪ সালে জেকেএলএফ-র প্রতিষ্ঠাতা মকবুল ভাটের ফাঁসি হয় তিহার জেলে। জেল চত্বরে তাকে কবর দেওয়া হয় পূর্ণবিধি অনুসারে। কিন্তু তার দেহ তিহার জেল থেকে কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় কাশ্মীরের উপত্যকায়। হিজবুল মুজাহিদিনের কুখ্যাত নেতা তথা ভয়ংকর জঙ্গি সাইফল নিহত হয় এপ্রিল ৪, ২০০৩। এই কুখ্যাত জঙ্গির নামাজ-ই-জানাজায় এবং কবর দেওয়ার সময় (পূর্ণ বিধি অনুসারে) ২৫ হাজারেরও বেশি পাকপন্থী মুসলমানরা সমবেত হয়। শোকে আচ্ছন্ন বহু বৃদ্ধা মহিলা এবং শিশুরা কাঁদতে কাঁদতে মৃতদেহটি প্রদক্ষিণ করে এবং আজাদির জন্য বারংবার ধ্বনি দিতে থাকে। হিজবুল নেতা বুরহান ওয়ানির নামাজ-ই- জানাজায় দুই লক্ষেরও বেশি পাকপন্থী মুসলমান সমবেত হয়।

১৯৪১-র সেন্সাসে শ্রীনগর উপত্যকায় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংখ্যা ছিল ১৫ শতাংশ। ১৯৮১ সালের সেন্সাসে তা কমে দাঁড়ার মাত্র ৫ শতাংশে। ১৯৯০ সালে সংখ্যালঘু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিতাড়নের জন্য সমগ্র উপত্যকায় ঘটে এক ভয়াবহ ও নারকীয় অত্যাচার। গণহত্যা, গণধর্ষণ, গৃহদাহ, মন্দির লুণ্ঠন, ধ্বংস। ঝিলম নদীতে বিগ্রহ ভেঙে নিক্ষেপ করা হয়। ফলত এক রাতের মধ্যেই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া তিন লক্ষ বিধ্বস্ত, লাঞ্ছিত ও ভয়ংকরতমভাবে নিপীড়িত কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আশ্রয় নেন দিল্লিতে। এটি নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো আদর্শনিষ্ঠ, ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা একটিও কথা বলেননি। অথচ ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে কাশ্মীরে উৎসব পালিত হয় ও ঠিক তার আগের বছর কাশ্মীরে ইন্দিরার একটি জনসভায় প্রথম সারিতে বসে থাকা কাশ্মীরি মুসলমানেরা প্রকাশ্যে নিজেদের লিঙ্গ প্রদর্শন করে।

তাছাড়া সেনাদের প্রতি পাথর ছোঁড়া তো তাদের অধিকারের মধ্যে পড়েছে। তাই আবার প্রশ্ন করছি, কাগজে কলমে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও কাশ্মীরি মুসলমানরা কি সত্যিই ভারতীয় না মনেপ্রাণে পাকপন্থী? অথচ তাদের পূর্বপুরুষরা সকলেই ছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত। শেখ আব্দুল্লার ঠাকুরদা ছিলেন রঘুরাম কাউল। এখানে আর একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে পোষণ করি— ভারতে কি আদৌ কোনো জাতীয়তাবাদী মুসলমান আছেন? সর্দার প্যাটেলের মতে (সেই যুগে) একজনই জাতীয়তাবাদী মুসলমান ছিলেন আর তার নাম জওহরলাল নেহরু।

একান্তভাবেই আমার মনে হয়, ভারতে বসবাসকারী কোনো মুসলমানই চায় না পাকিস্তান দুর্বল হোক বা ভারতীয় সেনার হাতে পর্যদুস্ত হোক। কারণ তারা এদেশের মুসলমানরা পাকিস্তানকেই তাদের আশা-ভরসার শেষস্থল মনে করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে এ বঙ্গের সমস্ত মুসলমান দল-মত নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে তৎকালীন কলকাতাস্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ‘আছেছলাম ওয়ালেকুম’ বলে সম্বোধন করে তাদের পাকিস্তান ভাঙার চক্রান্ত থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে। পরে বিতর্ক এই পর্যায়ে পৌঁছয় যে তা ধস্তাধস্তিতে পরিণত হয়।

ভারতীয় মুসলমানরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কণামাত্রও সাহায্য করেননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনার নিকট ৯৩ হাজার পাকসেনা আত্মসমর্পণ করলে তারা মুহ্যমান হয়, বুক চাপড়াতেও থাকে। বলে, “হে আল্লা তুমি এ কী করলে?” কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থে আছে ইসলামি জেহাদিরা অপরাজেয়।

রবীন্দ্রনাথ দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.