জ্যৈষ্ঠে মাসে সিতে পক্ষে ষষ্ঠী চারণ্য সংজ্ঞিতা – পর্ব প্রথম

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে পালিত হয় অরণ্য ষষ্ঠী। খুব সাধারণের কাছে যা জামাই ষষ্ঠী নামে পরিচিত। বোশেখ জষ্ঠী মাসে আমের আধিক্য থাকায় পক্ক আম্রফল নৈবেদ্যর প্রধান উপকরণ। এইজন্য বহু ঘরে এই ষষ্ঠী ব্রতর অপর নাম আম ষষ্ঠী ব্রত।

রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বম্ – এ উল্লেখ আছে –

জ্যৈষ্ঠে মাসে সিতে পক্ষে ষষ্ঠী চারণ্যসংজ্ঞিতা।
ব্যজনৈককরাস্তস্যামটন্তি বিপিনে স্ত্রিয়ঃ।
তাং বিন্ধ্যবাসিনীং স্কন্দষষ্ঠীমারাধয়ন্তি চ।
কন্দমূলফলাহার লভন্তে সন্ততিং শুভাম্।।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের আরাধ্যা ষষ্ঠীর নাম অরণ্যষষ্ঠী। এই দিন কুলস্ত্রীগণ এক হস্তে একখানি পাখা নিয়ে বিপিনে ভ্রমণ করবে এবং বিন্ধ্য পর্বতবাসিনী স্কন্দষষ্ঠীর পূজা করবে। ওইদিন যে সকল স্ত্রী কন্দ, মূল, এবং ফল আহার করে তারা উত্তম সন্তান লাভ করে।

বেদব্যাস রচিত মহাভারতের বনপর্বে উল্লিখিত হয়েছে –

বৃহস্পতির্মন্ত্র জজাপ চ জুহাব চ।
এবং স্কন্দস্য মহিষীং দেবসেনাং বিদুর্জনাঃ।।
ষষ্ঠী যাং ব্রাহ্মণাঃ প্রাহুর্লক্ষ্মীমাশাং সুখপ্রদাম্
সিনীবালীং কুহূঞ্চৈব সদ্ধৃত্তিমপরাজিতাম্।।

মন্ত্রবেত্তা বৃহস্পতি জপ ও হোমক্রিয়া নির্ব্বাহ করলেন। ঋষি, ব্রাহ্মণ এবং বেদ যাঁকে ষষ্ঠী, সুখপ্রদা, লক্ষ্মী, সিনীবালী, অপরাজিতা, কুহূ বলে নির্দেশ করেন সেই দেবসেনা স্কন্দ মহিষী হলেন।

ঋগ্বেদ সংহিতার ২ মণ্ডলের ৩২ সূক্তের ৬ এবং ৭ ঋক বলছেন –

সিনীবালি পৃথুষ্টকে যা দেবানামসি স্বসা।
জুষস্ব হব্যমাহুতং প্রজাং দেবি দিদিডূঢি নঃ।।
যা সুবাহুঃ স্বঙ্গুরিঃ সুষূমা বহুসূবরী।
তস‍্যৈ বিশপন্ত‍্যৈ হবিঃ সিনীবাল্যৈ জুহোতন।।

হে পৃথুজন্মা সিনীবালী। তুমি দেবগণের ভগিনী, প্রদত্ত হব্য সেবা কর এবং আমাদের অপত্য উপচিত কর। সিনীবালী সুবাহু, সুন্দর, অঙ্গুলিবিশিষ্ট, সুপ্রসবিনী এবং বহু প্রসবিত্রী, সেই লোক পালিকা সিনীবালীর উদ্দেশ্যে হব্য প্রদান কর।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

সিনীবালী সম্পর্কে টীকায় বলা হয়েছে –

” দৃষ্টচন্দ্রমামাবস্যা সিনীবালী” সায়ণ। নৈরুক্তগণ বলেন সিনীবালী ও কুহূ দুজন দেবপত্নী। যাজ্ঞিকগণ বলেন তারা দুটি অমাবস্যা।

Sinivali is, however, also connected with parturition – Muir’s snaskrit Text, Vol.V

ঋগ্বেদ সংহিতার ১০ মণ্ডলের ১৮৪ নং সূক্তের ২ নং ঋক্ – সিনীবালীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন –

গর্ভং ধেহি সিনীবালী গর্ভং ধেহি সরস্বতী
গর্ভং তে অশ্বিনৌ দেবাবা ধত্তাং পুষ্করস্রজা।।

হে সিনীবালী , গর্ভ ধারণের ক্ষমতা দান করুন। হে মা সরস্বতী ,গর্ভ ধারণের ক্ষমতা দান করুন। পদ্মমাল্যধারী অশ্বিদয়ের কৃপা করে সেই গর্ভ উৎপাদনে করুন।

কাশীরাম দাস বিরচিত মহাভারতের সভাপর্বে নারদ কর্ত্তৃক লোকপালগণের সভা বর্ণন অংশে ষষ্ঠীর দেবীর উল্লেখ করা হয়েছে –

সাবিত্রী ভারতী লক্ষ্মী অদিতি বিনতা।
ভদ্রা ষষ্ঠী অরুন্ধতী কন্দ্রু নাগমাতা।।

দেবীভাগবতম্ এর নবম স্কন্দের ছেচল্লিশ অধ্যায়ে দেবী ষষ্ঠীর কথা বর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডের তেতাল্লিশতম অধ্যায়ে নারায়ণ নারদকে দেবী ষষ্ঠীর পরিচয় দিয়ে বলেন –

ষষ্ঠাংশা প্রকৃতে চ সা প্রকৃতের্যা চ সা চ ষষ্ঠী প্রকীর্ত্তিতা।
বালকানামধিষ্ঠাত্রী বিষ্ণুমায়া চ বালাদা।।
মাতৃকাসু চ বিখ্যাতা দেবসনাভিধা চ যা।
প্রাণাধিকা প্রিয়া সাধ্বী স্কন্দভার্যা চ সুব্রতা।।
আয়ুঃ প্রদা চ বালানং ধাত্রী রক্ষণকারিণী।
সততং শিশুপার্শ্বস্থা যোগেন সিদ্ধিযোগিনী।।

বালকগণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী , বালকদায়িনী বিষ্ণুমায়া প্রকৃতির ষষ্ঠকলা , এই নিমিত্ত তিনি ষষ্ঠী নামে কীর্ত্তিতা। তিনি সুব্রতা। তিনি ষোড়শমাতৃকার মধ্যে দেবসেনা নামে বিখ্যাতা। তিনি মাতার ন্যায় সর্বদা বালকগণের পরমায়ুবৃদ্ধি করেন। যোগে সিদ্ধিস্বরূপা সেই দেবী নিরন্তর শিশুগণের সঙ্গে অবস্থান করে রক্ষা করেন।

ব্রহ্মবৈবর্তের প্রকৃতিখণ্ডে বলা হচ্ছে, রাজা প্রিয়ব্রতর মৃত পুত্র দেবী ষষ্ঠীর কৃপায় পুনর্জীবন লাভ করলে তিনি কৃতজ্ঞতাবশত দেবীর পূজা আরম্ভ করেন। দেবীর ধ্যানমন্ত্র, অষ্টাক্ষর মহামন্ত্র এবং স্তোত্রসহ বিস্তারিত পূজাপদ্ধতি এই পুরাণে রয়েছে৷ সেখানে দেবী বলছেন –

দদর্শ তত্ৰ দেবীঞ্চ কমনীয়াং মনোহরাম্।
শ্বেতচম্পকবর্ণাভাং শশ্বৎসুস্থির যৌবনাম্।।
ঈষদ্ধাস্য প্রসন্নাস্যাং রত্নভূষণভূষিতাম্।
কৃপাময়ীং যোগসিদ্ধাং ভক্তানুগ্রহকাতরাম্ ।।

সেই রথমধ্যে শুভ্রা, প্রসন্নবদনা, রত্নালঙ্কারে ভূষিতা, দয়াময়ী, যোগসিদ্ধা দেবী ভক্তের আহ্বানে আবির্ভুতা হলেন।

ব্রহ্মণো মানসী কন্যা দেবসেনাহমীশ্বরী।
সৃষ্টবা মাং মনসা ধাতা দদৌ স্কন্দায় ভূমিপ।।
মাতৃকাসু চ বিখ্যাতা স্কন্দভার্যা চ সুব্রতা।
বিশ্বে ষষ্ঠীতি বিখ্যাতা ষষ্ঠ‍্যাংশা প্রকৃতেঃ পরা।।
অপুত্রায় পুত্র দাহং প্রিয়দাত্র্যপ্রিয়ায় চ।
ধনদাহং দরিদ্রভ্যঃ কর্ম্মিভ্যশ্চ স্বকর্ম্মদা।।

আমি ব্রহ্মার মন হতে উৎপন্না ঈশ্বরস্বরূপীনি দেবসেনা। বিধাতা আমাকে মন থেকে সৃষ্টি করে অগ্নিজাতক দেবতা স্কন্দের শক্তি করেছেন। আমিই ষোড়শমাতৃকার মধ্যে স্কন্দ শক্তি সুব্রতা দেবসেনা। আমার এই মহামায়ার সংসারে মায়ার বন্ধনে থাকা প্রাণীকুল আমাকে ষষ্ঠী নামে অর্চনা করেন। আমি সন্তানহীনকে সন্তান দান করি। প্রিয়বিহীনকে দান করি প্রিয়। আমি দরিদ্রকে ধন এবং কর্মহীনকে কর্ম দান করি।

বেদের সংহিতা অংশে অগ্নিজাতক দেবতা স্কন্দের কথা একাধিকবার উল্লিখিত৷ ষড়বেদাঙ্গের অন্যতম ‘কল্প’ সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্র, কঠক গৃহ্যসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থে স্কন্দ ও স্কন্দপত্নী ষষ্ঠীর উপাসনার বিধি মিলবে। আর দেবী ষষ্ঠীর স্বতন্ত্র উপাসনাবিধি মেলে ‘মানব গৃহ্যসূত্র’ গ্রন্থে। এই উপাসনাবিধির নাম ‘ষষ্ঠীকল্প’। সেখানে বলা হচ্ছে, প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করে পরদিন, অর্থাৎ ষষ্ঠী তিথিতে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা কর্তব্য।

ধনদাং বসুমিশানাং কামদাং সর্বকামিনাং।
পুণ্যাং যশস্বিনীং দেবীং ষষ্ঠীং শক্র যুজস্ব মে।।

ষষ্ঠী দেবীর নিকটে পুত্র, পশু, ধন, ধান্য আদি সার্বিক সমৃদ্ধির কামনায় এই উপাসনা। এই ষষ্ঠীকল্পের মধ্যে বৈদিক শ্রীসূক্তের একাধিক মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে, এবং ‘শ্রী’, ‘লক্ষ্মী’ প্রভৃতি নামাবলীর উল্লেখ আছে। অর্থাৎ অনুমান করা চলে, গৃহস্থের সার্বিক কল্যাণের জন্য কৃত ষষ্ঠী-উপাসনা ও লক্ষ্মী-উপাসনার মধ্যে সেকালে একটা নিকটসম্বন্ধ ছিল, যে নৈকট্যের সাক্ষ্য পরবর্তীকালে মহাভারতে আবারও পাওয়া যাবে৷

গবেষকদের মতে মানব গৃহ্যসূত্রের সম্ভাব্য সংকলন-কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতকেরও আগে। অর্থাৎ বৈদিক বা শ্রৌত পদ্ধতিতে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা এ দেশে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন। কালের নিয়মে এই পূজার রীতিনীতিতে অজস্র বদল এসেছে, এবং বর্তমানে বাংলার নারীসমাজে প্রচলিত ষষ্ঠী-উপাসনা বিধি তেমনই এক সুপ্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতির অনুবর্তন, কোনওভাবেই তা অর্বাচীন বা লৌকিক কোনো অভ্যাস মাত্র নয়৷ বৈদিক সাহিত্যে যা ছিল ‘ষষ্ঠীকল্প’, বাংলার নারীসমাজে তাই হয়েছে ‘ষষ্ঠীব্রত’। শ্রৌত আচারের স্থানে এসেছে স্ত্রী-আচার, শ্রুতিমন্ত্রের স্থান নিয়েছে আঞ্চলিক ভাষার প্রায়োগিক ছড়া, যার পোশাকি নাম শাবর মন্ত্র। প্রতি মাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে দেবীর উপাসনার সংস্কৃতি এইভাবে বাংলার মাতৃসমাজে সজীব আছে, আর নতুন নামও পেয়েছে৷ বৈশাখে ধূলাষষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠে অরণ্যষষ্ঠী (নামান্তরে জামাইষষ্ঠী), আষাঢ়ে কোড়াষষ্ঠী, শ্রাবণে লোটনষষ্ঠী, ভাদ্রে মন্থনষষ্ঠী, আশ্বিনে দুর্গাষষ্ঠী, কার্তিকে গোটষষ্ঠী, অগ্রহায়ণে মূলাষষ্ঠী, পৌষে পাটাইষষ্ঠী, মাঘে শীতলষষ্ঠী, ফাল্গুনে অশোকষষ্ঠী এবং চৈত্রে নীলষষ্ঠী— বারো মাসের বারো ষষ্ঠীতে নামের বৈচিত্র্য যেমন, পূজাপদ্ধতির বৈচিত্র্যৈও কিছু কম নয়!

ব্রহ্মবৈবর্তে ষষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে— উল্লেখ থাকা মানে সেই গ্রন্থের অর্বাচীনতা প্রমাণিত হয় না, প্রমাণিত হয় যে খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে বেদানুগ প্রচলিত ষষ্ঠী-উপাসনার একটি বিশেষ রূপ ধরা পড়েছে ব্রহ্মবৈবর্তে। তাই, এই পুরাণ অর্বাচীন বিষয় হাজির করছে না, বহুশতাব্দীবাহিত এক সুপ্রাচীন ধারার অনুবর্তন করছে মাত্র।

মধ্যযুগে স্মার্ত অনুষ্ঠানবিধির সংকলক রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্বম্’ গ্রন্থে বিভিন্ন উৎস থেকে ষষ্ঠীপূজার স্মার্ত বিধি সংকলন করেছেন। কৃষ্ণরাম দাস, রুদ্ররাম চক্রবর্তী, শঙ্কর প্রমুখ কবি রচনা করেছেন ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্য। এছাড়াও কৃত্তিবাস ওঝার ‘শ্রীরাম পাঁচালী’, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ প্রভৃতি গ্রন্থে জাতকের কল্যাণার্থে ষষ্ঠীপূজার উল্লেখ রয়েছে।

লোচন দাস বিরচিত ‘চৈতন্যমঙ্গল’ গ্রন্থের আখ্যানটি খানিক অন্যরকম। লোচন দাস লিখছেন, একদিন শচী দেবী ষষ্ঠীব্রতের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য প্রস্তুত করে আঁচলে ঢেকে নিয়ে চলেছেন বটতলায়, সঙ্গে আছেন প্রতিবেশিনী নারীরা। এমন সময়ে শিশু নিমাইয়ের আগমনে মা ত্রস্ত, চঞ্চল গোরাচাঁদ আবার কী কাণ্ড ঘটায়। আর হলও তাই, মায়ের আঁচলে ঢাকা নৈবেদ্য কেড়ে নিল কৌতূহলী বালক, তারপর মধু ঘৃত গব্য আদি সবকিছু নিজের মুখে পুরে দিল। ক্রুদ্ধ ও শঙ্কিত মায়ের বকুনি শুনে নিমাই বলল,

শুন অবোধিনী, আমি সব জানি, আমি তিন লোক সার।
জগতে যতেক, আমি মাত্র এক, ত্রিভুবনে নাহি আর।।
তরুমূলে যেন, জল নিষেচন, উপরে সিঞ্চিত শাখা।
প্রাণ নিষেচন, ইন্দ্রিয় যেমন, ঐছন আমার লেখা।।

অরণ্য ষষ্ঠীর পূজার ব্যবস্থা অরণ্যের মাঝে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তেমন গহীন অরণ্য বঙ্গীয় পুরুষ সিংহদের পক্ষেও সুগম নয়। তাই গৃহিনীগণ গৃহ মধ্যেই অরণ্যকে কল্পনা করে দেবী ষষ্ঠীর পূজা করে থাকেন। পাহাড় , জঙ্গল সুলভ শিলাখণ্ডে ষষ্ঠীদেবীর অধিষ্ঠান কল্পিত হয়। অনেক সময় অন্য প্রস্তর খণ্ডের অভাবে মশলা পেশণী নোড়া দ্বারাই কার্য সম্পন্ন হয়। কুলবতীগণ সিঁদুর লিপ্ত একটি নোড়া এই বার্ষিক ব্রতের জন্য তুলে রাখেন।

গৃহে অরণ্য কল্পনা মন্দ নয়। তাছাড়া এখন মনুষ্যকুলের জ্বালায় অরণ্যকুল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। যদিও প্রাচীনকালে অরণ্যের ধারে গিয়ে এই ব্রত পালিত হত। নিদেন পক্ষে গাঁ ঘরের মা ঠাকুমা তো তেমনটিই করতেন।

সুপ্রাচীন ভারতের প্রাচীন ব্রতগুলির মধ্যে অন্যত ব্রত হল মা ষষ্ঠীর ব্রত । শৌরসেনী প্রাকৃতে রচিত শূদ্রক প্রণীত মৃচ্ছকটিকম্ নাটকের তৃতীয় অঙ্কে চারুদত্তের স্ত্রী ধূতার রত্নষষ্ঠী ব্রতের উল্লেখ আছে –

অহং খলু রত্নষষ্ঠীমুপোষিতা আসম্।
তস্মিন্ যথাবিভাবানুসারেণ ব্রাহ্মণঃ
প্রতিগ্রাহয়িতব্যঃ, স চ ন প্রতিগ্রাহিতঃ,
তততস্য কৃতে প্রতীচ্ছ ইমাং রত্নমালিকাম্।।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে প্রথমার্ধে বাণভট্ট রচিত কাদম্বরীতেও দেবীর প্রসঙ্গ আছে। উজ্জয়িনীতে তারাপীড় নামক এক রাজা বাস করতেন। তাঁর রাণীর নাম ছিল বিলাসবতী। রাণী সন্তান কামনায় বহু বারব্রত, মানত, পূজা , দানধ্যান করতেন। একদিন বিলাসবতী সন্তান সম্ভবা হলেন। শুভদিনে রাণী এক পুত্র সন্তানের জন্মদিলেন। রাজা মন্ত্রী শুকনাসকে নিয়ে আঁতুড় ঘরে গিয়ে দেখলেন ঘরটি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।সেখানে এয়োগণ নানান মাঙ্গলিক কাজে ব্যস্ত। এঁদের মধ্যে কেউ গড়ছেন –

“হারিদ্র – দ্রব – বিচ্ছুরণ – পরি – পিঞ্জরাম্বর – ধায়িণীং ভগবতীং ষষ্ঠীদেবীং কুর্বতা , বিকচ – পক্ষপুট – বিকট শিখণ্ডি – পৃষ্টমণ্ডলাধিরূঢ়ম্ আলোল – লোহিত পট – ঘটিত – পতাকম্ উল্লসিত – শক্তিদণ্ড – প্রচণ্ডং কার্তিকেয়ং সমঘটয়তা …”

হলুদের রসে ছোপানো টুকটুকে – হলুদ কাপড় – পরা ষষ্ঠী ঠাকুরণ তৈরী করছে কার্ত্তিক – ছড়ানো পেখমে মস্ত ময়ূরের ছাড়ালো পিঠে চড়া , লাল পতাকাটি ফুরফুরিয়ে উড়ছে , শক্তি – অস্ত্রটি উঁচিয়ে দেখতে লাগছে ভয়ঙ্কর ।

ব্রতাচার মূলত বছরজুড়ে পালন করা হয় । দীনেন্দ্রকুমার সরকার ‘ বারো মাসে তের পার্বণ ও ষষ্ঠীব্রত ’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে ( ‘ লোক ও লৌকিক ‘ পত্রিকা ) বলেছেন যে তেরো পার্বণ আসলে তেরোটি ষষ্ঠীব্রত । সৌরবৎসরকে চন্দ্রকলার হ্রাস – বৃদ্ধি অনুসারে ভাগ করলে তেরোটি মাস মেলে , তা থেকেই তেরো পার্বণ । প্রতিমাসে নির্দিষ্ট তিথিতে তেরোটি ষষ্ঠীব্রত পালনের নির্দেশ দেওয়া আছে শাস্ত্রীয় পঞ্জিকায় । সেই তিথিগুলিতে ষষ্ঠী পুজো করা হয়ে থাকে । তবে প্রচলিত মতে বৈশাখ , আষাঢ় , কার্তিক ও ফাল্গুন মাসে ষষ্ঠীর পুজো করা হয় না ।

ঠিক যেমন ষষ্ঠীর ব্রত সোম ও শনিবারে পড়লে পালন করা হয় না । বারো মাসে তেরো পার্বণের ছোঁয়া পাওয়া যায় অরণ্যষষ্ঠীর ছড়াতেও –

জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষাট ।
ফিরে ঘুরে এল ষাট ।।
বারো মাসে তেরো ষাট ।
ষাট ষাট ষাট ।।
ঝি – চাকরের ষাট ।
গোরু বাছুরের ষাট ।।
কর্তার ষাট , ছেলেমেয়ের ষাট ।
বউ ঝিয়ের ষাট , নাতি – নাতনির ষাট ।
ষাট ষাট ষাট ।।

অরণ্য ষষ্ঠীর দিন দেবীর পূজা হয় , কোথাও পুরোহিত করেন , কোথাও অন্তঃপুরবাসিনীরা নিজেরাই পূজা করেন। পুষ্প, চন্দন, ধূপ প্রদীপ ধুনোর গন্ধের মধ্যে থেকে উচ্চারিত হয় মন্ত্র –

ওঁ গৌরাভাং দ্বিভুজাং ষষ্ঠীং নানালঙ্কার – ভূষিতাম সর্বলক্ষণ – – সম্পনাং পিনোন্নতপয়োধরাম || দিব্যাবস্ত্রপরিধানাং বামক্রোড়ে সপুত্রিকাম | প্রসন্নবদনাং ধ্যায়ে জগৎধাত্রীং সুখপ্রাদাম ||

অর্থাৎ : দেবী ষষ্ঠীর ধ্যান যন্ত্র অনুযায়ী তিনি দ্বিভুজা , বরাভয়দায়িনী , গৌরবর্ণা , নানালঙ্কারভূষিতা , স্তনযুগল পরিপূর্ন , দিব্যবসন পরিহিতা , নিত্যা , জগদ্ধাত্রী , সন্তান প্রদা , সর্ব সুলক্ষণ সম্পন্না । সকল মাতৃত্বে গুন নিয়েই যা ষষ্ঠী আবির্ভূতা । যা ষষ্ঠী বামক্রোড়ে সন্তান ধারন করে থাকেন । যা মাতৃত্বের পরিচয় ।

পূজান্তে ব্রত কথা শ্রবণ করে এবং ব্রত নির্দিষ্ট কার্যাদি করে সেই দিবস ব্রতনীগণকে ফলমূলাদি ভক্ষণ করতে হয়। সব থেকে বড় কথা এই ব্রতের সংকল্প গৃহের কন্যাদের নামে বা মেয়ে বউদের নামে হয়। আমার গৃহে আমার মা ঠাকুমাকে যেমন করে এই ব্রত পালন করতে দেখেছি এখানে তারই উল্লেখ করলাম –

যতজন ব্রত করবেন ততগুলি বীজন ( তালপাতার পাখা), পক্ক আম্র, দুর্বাগুচ্ছ আবশ্যক।এই দুর্বাগুচ্ছ অপরাহ্নে বাড়ির কন্যাগণ দুর্বাক্ষেত্র থেকে সযত্নে সংগ্রহ করেন। ★ছয় কুড়ি ছয় গাছি★ দীর্ঘবৃন্ত দুর্বা এবং ছয়টি নূতন বাঁশপাতার অগ্রভাগ একত্র করে কলাগাছের ছোবড়া বা আঁশ দ্বারা বাঁধতে হয়। এই ভাবে এক একটি দুর্বাআঁটি তৈরি হয়। আম, কলা, খেজুর ছড়া, করমচা, জামরুল, ইত্যাদি ফল একটি কুলোর মধ্যে সাজিয়ে রাখতে হয় ।

পূজা স্থানে পিটুলী দিয়ে মা ষষ্ঠী ষেটেড়রা নামে নানা আলপনা চিত্র অঙ্কন করে , প্রত্যেক ব্রতচারিনীর নির্দিষ্ট বীজনটির উপর একটি পক্ক আম্র, এক আঁটি দুর্বা এবং অন্যান্য পূর্ণ ফল স্থাপন করে পূজা স্থলে রাখতে হয়। পাখায় সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া বিধি। এসবের সঙ্গে একটি কলা, একটি সুপারি এবং একটি পান একত্র করলে একভাগ হয়।এরূপ প্রতি ব্রতচারিণীর নিমিত্ত ছয়ভাগ দিয়ে নৈবেদ্য ন্যায় একটি বড় ডালা সাজিয়ে দিতে হবে। তাম্বুলপত্র দোভাঁজ করে খড়কে দ্বারা আবদ্ধ করে দিতে হয়।পূজার পূর্বে ব্রতচারিণীগণ জলের ঘটি ইত্যাদি নিয়ে নিকটবর্তী জলাশয় বা নদীতে যায় স্নান করতে। একে বলে “পাখা ধোয়া”।

অঞ্চল ও পরিবার ভেদে ফলের সংখ্যা ও দূর্বার গাছা তৈরিতে কিছু তারতম্য দেখা যায়। কিন্তু, সব ক্ষেত্রেই আম ও কলা এই দুটি ফল ও ষাট বা ষাটের গুণিতক সংখ্যক দূর্বাঘাস থাকেই ।দেশভাগ পরবর্তী নগর জীবনে নদী বা জলাশয়ে স্নান সম্ভব না হলেও বাড়িতে গামলায় জল দিয়ে, কৃত্রিম পুকুর তৈরী করে এই রীতি পালনের প্রথা আজও সমানভাবে সক্রিয়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি সর্ববিধ ষষ্ঠীব্রতে ছয় সংখ্যার বড়ই মাহাত্ম্য। প্রকৃতির ষষ্ঠতম রূপ হলেন ষষ্ঠী। ষষ্ঠী অর্থাৎ ষাট, ষাট অর্থাৎ বহুত্ব প্রকাশক।তাই ষষ্ঠী ষাট অর্থে শিশুর দীর্ঘায়ু কামনা করা।

শ্রদ্ধেয় সনৎকুমার মিত্র মহাশয় বলেছেন , ” নারী রজস্বলা হবার পর ছয়দিন থেকেই প্রজনন বার্তা প্রচারে আস্তে আস্তে সক্ষম হতে থাকে । প্রাচীন কালের মানুষ তাদের জৈবিক অভিজ্ঞতা থেকে ষষ্ঠ দিবসই মানবীর উর্বরতার সূচনাকাল ধরে নিয়ে উর্বরতা দেবীর নামকরণ করেছে ষষ্ঠী । অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়ম বা চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে ছয়দিন পর থেকেই নারীর ডিম্বাণু নিষ্ক্রমণের সম্ভাবনার সূচনাকাল শুরু হয়ে যায় বলেই উর্বরতার ও শিশু পালিকা ষষ্ঠী দেবীর সৃষ্টি হয়েছে । এই কারণেই ষষ্ঠী দেবীর নাম সংখ্যাবাচক হয়েছে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান মনে করে ।”

ব্রতের দিন ব্রতচারিণীরা গাত্রে তৈল ব্যবহার করেন না। ষষ্ঠী ব্রতে তৈল এবং আমিষ নিষিদ্ধ থাকে। স্নানের পর ভিজে কাপড়ে ফলগুলি কোঁচড়ে নিয়ে পাখা ও দূর্বার গাছাটি জলে ডুবিয়ে ধোয়া হয় ও ঘটিতে জল পূর্ণ করা হয়। এর পর চন্দ্র সূর্য থেকে শুরু করে নিজের ও আত্মীয়দের সন্তান, গৃহপালিত পশু, দেবদেবী, সবার নাম করে ব্রতিনী নিজের নাভিতে দূর্বার জল ছেটায় ও ভিজে পাখার বাতাস দেয়। একে বলে “ষাট বাছা “। নাভিই হল মাতৃত্বের আধার। সন্তানের সঙ্গে মায়ের থাকে নারীর টান। দশমাস দশদিন গর্ভের এই নাভির সঙ্গে সন্তান ও মায়ের যোগ। সন্তানের বেঁচে থাকা। মণিপুর চক্র দেহের নাভি বা বৃক্কাশয় বা পাকস্থলির নীচের শিরাজাল নিয়ে গঠিত। এই চক্রের দশটি দল। এটির রঙ বেগুনি। এটি আমাদের উচ্চ চেতনা, জীবনীশক্তি, আবেগ, বাসনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটিতে আছে মাংসধাতুর শক্তি। তেজশক্তির আধার এটি। এ চক্রে দিব্যশক্তি মণিপুরি নৃত্য করে। দিব্যশক্তির উন্মাদ নাচের তালে দেহের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়।

স্নানান্তে ওই দ্রব্য সকল পূজা স্থানে রেখে পূজায় বসেন ব্রতচারিণী। বাড়ির উঠানে ছোট পুকুর কেটে তার ধারে বট অশ্বথের ডাল পুঁতে, কৃত্রিম অরণ্য তৈরী করা হয় ও ঘট স্থাপন করে পুরোহিত দিয়ে ষষ্ঠী দেবীর পূজা করা হয়। পুজোতে অন্যান্য উপকরণের সাথে লাগে “তুলার কঙ্কণ “, “পিঠালির কালো বিড়াল ” “ছয় খাই সুতা ” ইত্যাদি। পূজা শেষে ব্রতচারিণী ফুল দুর্বা হাতে ব্রতকথা শোনেন।

এক ব্রাহ্মণের ঘরে তাঁর তিন ছেলে ও তাঁদের তিন বউ থাকতেন। আর ছিল তাঁদের পোষা বেড়াল। তিন বউয়ের মধ্যে ছোট বউ মাঝে মাঝেই খাবার জিনিস চুরি করে খেতেন আর দোষ চাপাতেন তাঁদের পোষা বেড়ালটার ওপর। বেড়ালটা ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন। সে মা ষষ্ঠীর কাছে ছোট বউয়ের নামে নালিশ করত। এইরকম ভাবেই একদিন জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে ব্রাহ্মণী ব্রত পালনের জন্য পায়েস, মিষ্টি রান্না করেছিলেন। তিনি স্নানে যাবার আগে ছোট বউকে খাবারগুলো দেখতে বলে গেলেন, “দেখো তো মা! বেড়ালটা যেন কিছুতে মুখ না দেয়।”
তিনি স্নানে গেলে খাবারগুলো দেখে ছোটবউ লোভ সামলাতে পারলেন না। সব খাবার থেকেই একটু একটু করে নিয়ে খেয়ে দেখলেন। আর দই নিয়ে বেড়ালটার মুখে লাগিয়ে দিয়ে এলেন। এরপর স্নান করে এসে ব্রাহ্মণী খাবারের এরম অবস্থা দেখে ছোটবউকে জিজ্ঞেস করলেন এরম কে করেছে! ছোটবউ বললেন, “কি জানি মা! আমার একটু চোখ লেগে গেছিল। মনে হয় বেড়ালটাই খেয়েছে।”
এই বলে তিনি বেড়ালটাকে নিয়ে এসে মাকে দেখালেন, “এই দেখুন মা! মুখে খাবার লেগে আছে এখনও!” বলে বেড়ালটাকে দু চার ঘা দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেড়ালটা বনে গিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে সব কথা বলল। মা ষষ্ঠী বললেন, “আমি সব জানি। তুই কাঁদিস না! আমি ওকে শীঘ্রই এর প্রতিদান দেব।”
কয়েকমাস পর ছোটবউ সন্তানসম্ভবা হলেন। তাঁর একটি ফুটফুটে ছেলে জন্মাল। বাড়ির সকলে তো বিশাল খুশি। ব্রাহ্মণী গরিবদের বস্ত্র বিতরণ করলেন। একদিন রাতে ছেলেকে কোলে নিয়ে শুয়েছিলেন ছোটবউ। পরের দিন ঘুম ভেঙে দেখলেন ছেলে তাঁর কাছে নেই। অনেক খুঁজেও কোথাও ছেলেকে পাওয়া গেল না। এইভাবে ছোটবউ সাত সাতটি সন্তানের জন্ম দিলেন, কিন্তু একইভাবে সকলেই যেন কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেল। রাতে কোলে নিয়ে তিনি শুতেন আর সকালে উঠেই কাউকে খুঁজে পেতেন না। পাড়ার লোকেরা সকলে বলা চালু করল, “এ নিশ্চয়ই রাক্ষসী। নিজের ছেলেমেয়ে খেয়ে ফেলে। একে ঘরছাড়া করা উচিত।”
এই কথা শুনে ছোটবউ নিজেই ঘর ছেড়ে বনে চলে গেলেন। বনে এসে মা ষষ্ঠীর নাম করে কাঁদতে থাকলেন।

তাঁর কান্না শুনে মা ষষ্ঠীর দয়া হল। তিনি একজন বুড়ির ছদ্মবেশে এসে ছোটবউকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
ছোটবউ তাঁর দুঃখের কথা জানালেন। তখন বুড়ি বললেন, “নিজের দুঃখের কথা তো বললি কিন্তু ছেলেপুলে হবার আগে যে তুই খাবার চুরি করে তোদের বেড়ালের নামে দোষ দিতিস সেটা তো বললি না!”
ছোটবউ তখন বুড়ির পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়লেন, “তুমি কে মা! আমার এত কথা জানলে কি করে!”
মা ষষ্ঠী নিজের পরিচয় দিলেন। তখন ছোটবউ আরও জোরে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমি অনেক ভুল করেছি মা। আমায় ক্ষমা করুন। আপনি যা বলবেন তাই করব।”
তখন মা ষষ্ঠী তাঁকে বললেন, “পথের ধারে একটা মরা বেড়াল পচে পড়ে আছে। তুই এক হাঁড়ি দই নিয়ে ওর গায়ে ঢেলে চেটে আবার সেই দই হাঁড়িতে তুলতে পারলে তোর ছেলেমেয়েরা ফিরে আসবে”

ছোটবউ তাই করলেন। তখন মা ষষ্ঠী তাঁর ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেন, “এই দইয়ের ফোঁটা এদের কপালে দে। আর কখনও পুজোর জিনিস চুরি করে আমার বাহনের নামে দোষ দিবি না। আর ছেলেমেয়েকে কখনও ‘দূর হ! মরে যা’ বলবি না।”
এই বলে মা ষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ছোটবউ ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফিরে এলেন। ব্রাহ্মণী নাতি নাতনিদের পেয়ে খুব খুশি হলেন। সকলে মা ষষ্ঠীর পূজা করলেন। এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হলে তাঁদের বিয়ে দিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে মেয়ে জামাইকে ডেকে জামাই ষষ্ঠী করলেন। এইভাবে এই ব্রতের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

ব্রত কথা শ্রবণকালে ব্রতিনীরা একটি হাঁটু উঁচু করে বিশেষ ভঙ্গিমায় বসে ও একগোছা হলুদ সুতো দিয়ে ব্রত স্থান ঘিরে রাখে। এই সময় প্রত্যেকে দূর্বাগাছাটি কোলে করে থাকে ও তুলোর কঙ্কণ দুটি উত্থিত হাঁটুতে রাখে। কথা শেষ হলে কঙ্কণগুলো জলে ভাসিয়ে দেয়। এরপর হয় “ষাট বদল “।

কথা শ্রবণের পর এক গাছি দুর্বা নিয়ে দেবী ষষ্ঠীর স্বরূপ নোড়ার উপর দিয়ে বলা হয় –

অগ্রহায়ণে মূলো ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট ( দুর্বাদান)
পৌষে লোটন ষষ্ঠী , ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
মাঘে শীতল ষষ্ঠী ,ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
ফাগে গুণো ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
চৈত্রে অশোক ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
বৈশাখে দুই ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
জ্যৈষ্ঠে অরণ্য ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
অরণ্যে গেলেও ঝি পুত ফিরে আসে( দুর্বাদান)
আষাঢ়ে চাপড়া ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
শ্রাবণে লুন্ঠন ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
ভাদ্রে অক্ষয় ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
আশ্বিনে বোধন ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
কার্ত্তিকে শ্মশান ষষ্ঠী, শ্মশানে গেলেও ঝি পুত ফিরে আসে।( দুর্বাদান)
ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
কালী ,দুর্গা, গৃহে যত দেবতাগণ ( দুর্বাদান)
ষাট ষাট ষাট( দুর্বাদান)
কন্যা, বউ এবং পুত্রের নাম করে ( দুর্বাদান)

সর্বশেষে ডালার আম , কলা, পান, সুপারি এক এক ভাগ তুলে একজন অপরজনের হাতে দেন। একে বায়না বদল বলে। ননদ- ভাইবউ , জায়ে জায়ে এরূপ বদল হয়। শাশুড়ী – বৌতে হয় না।

এই নিয়ম সম্পন্ন হলে নোড়ার উপর আলো চাল ছিটিয়ে বলতে হয় যথা-
নিজ পেটে নাই এলোমেলো
ষাট ষাট ষাট
বৌ এর পেটে নাই
ষাট ষাট ষাট
ঝির পেটে নাই
ষাট ষাট ষাট

অবশেষে গৃহের সকল পুত্র কন্যার গায়ে পূর্বোক্ত দুর্বার আঁটি দ্বারা জল ছিটিয়ে ও বীজন বাতাস দিয়ে বলতে হয় ” জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠীপূজা, ষাট ষাট ষাট”….

ক্রমশঃ

তথ্যঃ ১. দেবী ষষ্ঠীর উৎস ও পরিচয়

২. বাংলার ব্রত ও আলপনা

৩. ঋগ্বেদ

৪. মহাভারত

@দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.