নির্মলা সীতারামানের কৃষি সংস্কার:  স্বাধীনতার 73 বছর পর কৃষকদের ফোঁড়ে, বাবু, নেতা-মন্ত্রীদের থেকে শৃঙ্খলামুক্তি

কৌটিল্যের অর্থ অনর্থ 
 
নির্মলাজী কৃষক, পশুপালক ও মৎস্যজীবিদের জন্য মূলত এগারোটি ঘোষণা করেছেন l প্রথম আটটি বিভিন্নখাতে অর্থ বরাদ্দ প্রসঙ্গে আর শেষ তিনটি সংস্কারমূলক, যা কৃষকদের শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দেব l 1991 এর পর সম্ভবত, দেশের বৃহত্তম সংস্কার যা দেশের 70% মানুষকে লাইসেন্সরাজের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করলো l
 
 
এখানে এই তিনটি যুগান্তকারী সংস্কার নিয়ে আলোচনা করছি, যা অচিরেই, দেশের কৃষকদের জীবন জীবিকা পাল্টে দেবে l 
 
এক, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন 1955 ( ECA): এর সংশোধনী এনে হিমঘর ক্ষেত্রে বিনিয়োগের একটা রাস্তা খুলে গেল  সমস্যার l লালবাহাদুর শাস্ত্রীজির সবুজ বিপ্লব ( জয় জওয়ান, জয় কিষান ) আমাদের দেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পুর্ন করে দিয়েছে l তবুও সবুজ বিপ্লবের ( 1965-66) পূর্বের ‘নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আইন 1955’,  কার স্বার্থে আজও বলবৎ থাকে, যখন আমরা উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনে ও দেশের 40% খাদ্য একদল অসৎ ফোঁড়ে নষ্ট করে? ভারতের হিমঘর ব্যবসায় বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা এই ECA আইন ও তার সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতি l কোন সবজি বা শস্য,  যেমন ফুলকপি বা টমেটো, সারা বছর মানুষকে সরবরাহ করতে গেলে আমাদের মজুত করতে হবে l কিন্তু বর্তমান মজুত আইন অনুযায়ী, সরকার যেকোন সময় অত্যাবশ্যক পণ্য আইন প্রয়োগ করতে পারে l আর এতে বিপদে পড়বে বিনিয়োগকারী l ধরা যাক, সরকার পেঁয়াজের ফলন কম আন্দাজ করতে না পেরে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করল না l এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল l সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন প্রয়োগ কর l যে হিমঘরে বিনিয়োগ করা হয়েছিল 100 কুইন্টাল মজুতের জন্য,  সরকারি বাবু এসে তার 90 কুইন্টাল পেঁয়াজ নিয়ে চলে গেল l সঙ্গে পেল জনতার হাততালি l কিন্তু, ঠিক এই ভয়ে কেউ হিমঘরে বিনিয়োগ করছে না l ফলে, উৎপাদিত ফসল সারা বছর জমা`নোর মত হিমঘরের অভাবে দেশের 40% খাদ্য নষ্ট হচ্ছে l দাম পায় না কৃষক, আর প্রান্তিক ক্রেতা অধিক দামে খাদ্য কিনতে বাধ্য হয় খাদ্যের চাহিদা একটু বাড়লেই l 
 
দুই, কৃষি বিপণন আইন ( APMC Act ) : এই আইনের সংশোধনের ফলে কৃষক আর রাজ্যের কৃষিবিপণন দপ্তরের কাছে বা তাঁদের দান করা লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফড়েদের কাছে শস্য বিক্রিতে বাধ্য থাকবে না l কৃষকরা তাঁদের ক্রেতা চয়ন করতে পারে l এই আইনের ফলে পারিতোষিক দিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত APMC ফড়েদের একাধিপত্য শেষ হয়ে গেল চিরদিনের মত l একসময় টেলিকম, এয়ারলাইন্স এ জনসাধারণের যেমন সরকারি পরিষেবা নেয়া গতি ছিল না, তেমনই আজও কৃষকদের এদের বিক্রি করা ছাড়া গতি নেই l নব্বইয়ের দশকে যেমন যাদবপুর বা শিবপুরের প্রথম সারির ছাত্রদের DCL, এম এন দস্তুরের এর মত কম বেতনের চাকরি ছাড়া গতি ছিল না, চাষীদেরও আজ সেই অবস্থাl যদি সরকার নিয়ম করে যে রাজ্যের ইঞ্জিনিয়াররা রাজ্যের পাটকল বা কাগজকল বা অবসান সিন্ডিকেট ছাড়া আর কারো কাছে তাদের শ্রম বিক্রয় করতে পারবে না? মানবে যাদবপুর? যদি রাজ্যের ডাক্তারদের  বলা হয়, তুমি রাজ্যের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নার্সিংহোমে বা বাইপাসের পাশের বেসরকারি হাসপাতাল (তথা কসাইখানা) বাদে কোথাও চাকরি করতে পারবে না বা প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবে না, তারা মানবে? যেসব অনিলজীবি/পার্থজীবি শিক্ষক গত চারদিন কৃষিকদের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছেন, তাঁদের যদি প্রাইভেট টিউশন বা টিভি চ্যানেলে বসা বন্ধ করে সরকার,  তারা মানবেন? তাহলে, চাষীরা কেন শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত পারিতোষিক দান করে লাইসেন্স পাওয়া কিছু ফোঁড়েদের কাছে তাঁদের রক্ত ঘামে উৎপাদিত ফসল বেঁচতে বাধ্য থাকবে? একজন ডাল চাষী কেন সরাসরি তার ডাল হলদিরামকে বেচবে না? কেন সে তার টমেটো ম্যাগি বা কিসেনকে সরাসরি বেচার অধিকার নেই? কেন সে তার ভুট্টা কর্নফ্লেক্স কোম্পানিকে বেঁচতে পারবে না? সরকার রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষকদের  বিদেশে বা ভিন্ন রাজ্যে যেতে বাধা দিতে পারব ? তাহলে রাজ্যের চাষী কেন বিহার, আসামে কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সঠিক দাম পেলে তাঁদের বেঁচতে পারবে না? দেশের 70% মানুষের কেন খোলা বাজারের অধিকার থাকবে না? 
 
তিন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং : এই নামটি শুনেই প্রতিটি বাঙালী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠবেন, কারণ আমরা যে বিদ্যালয়ে  অর্থনীতির পাঠ নি, সেখানে এটাই শেখানো হয়, যে একজন ছোট চাষী ITC, ওয়ালমার্ট  বা ট্রেসকোর সঙ্গে দরদাম করবে কিভাবে? উত্তম, চাষীরা সমবায় বানাবে l গুজরাটে আমূল কিভাবে করলো? এখানে গুনগত মান সম্পূর্ণ বাজায় রেখে একটা সমবায় যদি বিশ্বের একনম্বর দুগ্ধশালায় পরিণত হয়, তবে কৃষকরা ওয়ালমার্টের সঙ্গে দরদাম করতে পারবে না কেন? অথচ বাংলায় বিধানচন্দ্র রায়ের রাষ্ট্রায়ত্ত হরিণঘাটা সম্পূর্ণ উঠে গেছে l সেই জমিতে আজ IISER, কল্যাণী দাড়িয়ে এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে সারাজীবন কাজ করে আজ পেনশন নিচ্ছে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে l 
 
1991 থেকে আজ, দেশের মানুষের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে l দুধ,দৈ, ডিম, সোয়াবিন ইত্যাদি খাদ্যের চাহিদা বেড়েছে l কিন্তু কৃষিক্ষেতে সংস্কার না হাওয়ায়,ভারতের খাদ্যের মূল্য আমেরিকা, ইউরোপের চেয়ে বেশী এবং এদেশের কৃষক বিশ্বের দরিদ্রতম l কারণ চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য থাকতে দিচ্ছে না রাজনৈতিক নেতা, বাবু ও ফড়েদের অশুভ আতাত l আমাদের চাষীরা শুধু সরকার নির্ধারিত ফসল নয়, ভেষজ পদার্থ ও ওষুধ তৈরির কাঁচামালও বানাবে l সেচ, গ্রামীণ পানীয় জল, হিমঘর ও তার সরবরাহ প্রকল্পে অন্ততঃ 10 ট্রিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রায় বিনিয়োগ আসবে আগামী কয়েক বছরে l গ্রামের মানুষকে পরিযায়ী হয়ে আজকের মত দুর্দশার সম্মুখীন হতে হবেনা l 

বামপন্থী কিছু কৃষকসভা বলছেন, ‘ Support Price ‘ এর কি হবে?  উত্তর একটাই l  সফটওয়্যার শিল্প মূলত স্পেশাল ইকোনমিক জোনে খোলা হয় যেখানে বহুদিন দেশের শ্রমিক আইন বলবৎ ছিল না l ( 2015 তে এই নির্মলাজিই চালু লাগু করিয়েছেন) l কিন্তু কোনদিন বেতন নিয়ে কোন অভিযোগ শুনেছেন না আপনাদের গোপালন ভবনের দরজায় কেউ এই অভিযোগ নিয়ে কড়া নেড়েছে? অন্য পেশার ন্যূনতম তিনগুন বেতন পেত এরা l  কোনদিন আমূল কোম্পানির কোন গোয়ালা দাম পায়নি বলে আপনাদের পত্রিকা অফিসে অভিযোগ করেছে? আগামী দিনে ভারতবর্ষের চাষীরাও করবে না l কৃষকসভার অফিসে তালা মারতে হবে l অন্য জীবিকা খুজুন l 

লেখক: কৌটিল্য 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.