ভোটটা এখন বাংলার মানুষের কাছে একরকম সম্বাৎসরিক পার্বণ হয়ে গেছে। বসন্ত না এলেও সে গুটি গুটি মার্চ এপ্রিল থেকে হানা দেয় আর মে অব্ধি জ্বালিয়ে যায়। পাব্বণই বললাম, হিঁদু নাম- চোখ পাকিয়ে বলতেই পারেন, সেকুলার দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপমা হিঁদু হবে কেন, ব্যাটা চাড্ডী সন্ত্রাসী। কিন্তু ভেবে দেখুন মশাই, এরকম মাল্টিডাইমেনশনাল মাল্টিপ্ল ভক্ত-ভগবান রিলেশনশিপ আপনি এই রিগ্রেসিভ হিঁদু ধর্ম ছাড়া আর কোথায় পাবেন! আর তা যদি মানতে নাও চান, একথাটা তো মানবেন যে মাননীয়া অনুপ্রেরণা সব জানেন, সব দেখেন। তাই তো বিজিগ্নেশদা থেকে বিচিত্রদীপ ছোকরা সকলেই লাল শালু দিয়ে তার পা দুবেলা মুছে দিয়ে যায়। এখন ভেবে দেখুন ভোট ব্যাটা যদি পাব্বণই না হত, যদি সে ব্যাটা দাওয়াত বা পার্টি বা নিদেন পক্ষে গণমানুষের কনভেনশন হত তাহলে কি আর মাননীয়ার ভাই-ভাইপোরা কথায় অকথায় ভোট পিছোতে চাইতো-অনেকটা ঐ দুগগো পুজোর ভাসান রদের মতো।
তাই বলি ভোট হলো পাব্বণ, -নিকষ, খাঁটি, কেওটিক হিঁদু পাব্বণ।
আর পাব্বণ যখন আসবে তখন হাটে বাজারে কাটাছেঁড়া-দরদাম-বিকিকিনি-লোকসান হবে না তাই কি কখনো হয়! তা, বিকিকিনিও ভালোই চলছে। বাজারী পত্রিকা তো বেশ ভালো দামেই নিজেকে বেচছে। বাকিরাও কিছু কম যায় না। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি চুপসে চিমড়ে; আটচল্লিশের তরুণ তুর্কি আর জাতিস্মরী ঠাকুমা নাকি চোকিদারের টুলের পায়া খুলে নিয়েছে, এবার উর্দিটাও নেবে নেবে; বুয়া-ভাতিজা নাকি এবার ৭১ কে ১৭ করবে; ওই উলটে দেখুন পালটে গেছে টাইপ আর কি। সব মিলিয়ে গল্প-উপন্যাস-পুলোয়ামা থ্রিলার-এমন কি ফোটো সেশন মায় ডিম্ভাত কিছুই বাদ নেই।
এবং সমীক্ষা। হলদে সবুজ ওরাং ওটাং সকলেই আজ সমীক্ষক, সকলেই আজ দশ হাজারী বিন্দুতে শত কোটির সিন্ধুকে মেপে নিয়ে চোঁয়া ঢেঁকুর তুলতে ব্যস্ত। গত বিশ বছরের ইতিহাস বলছে, পূর্বাভাসের সঠিক হওয়ার চেয়ে বেঠিক হওয়ার সম্ভাবনা শতগুণ বেশী। তবু চলছে সমীক্ষা, অজানা ভবিষ্যতকে জানার যে অদম্য আকাঙ্খায় মানুষ জ্যোতিষের কাছে যায়, রাশিফল পড়ে সেই একই মানসিকতায় গণমানুষ সমীক্ষা দেখে, ঘণ্টাখানেকে ঘন্টাকয়েক বসে থাকে, আর বিড়বিড় ক’রে কর গুণে অঙ্ক কষে। কেউ তৃপ্তির শ্বাস ফেলে ভাবে যে এবারে মোদীর গদি গেলো, নোটবন্দীতে শালা বহুত কেস খেয়েছি। কেউবা ভাবে এবার যদি আপা বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ না পায় তাহলে হয়তো একুশে সাড়ে-দশ পারসেন্ট ডিএ আসতে পারে। কেউবা ভাবে, রায়গঞ্জটা যদি এবারো থাকে তাহলে তো ঘুরে দাঁড়িয়েছি বলেঈ দেবো-ইত্যাদি, প্রভৃতি চলতে থাকে। তা আমিও কিছু কম যাই না। শুয়োরের মাংস আর শুয়োরের খামার দুটোতেই আমার বিস্তর আগ্রহ আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমি একদিকে জ্ঞানপাপী, আরেকদিকে টেকো। তো টেকো হওয়ার মূল অসুবিধা যে টেকোরা ন্যাড়া হতে পারে না ফলতঃ মাথায় চুল না থাকলেও তারা বেলতলায় বারবার যায়। এবং আমিও হাতে তেলের টাকা না থাকলেও প্রতিবার শামলা এঁটে সমীক্ষা করতে বসে যাই।
যেমন এবারেও বসেছি। আমার সমীক্ষার সঙ্গে অবশ্য নিউজ চ্যানেলের সমীক্ষার তফাত আছে। এই সমীক্ষার মূল উপাদান সাম্প্রতিক ভোট গুলোতে বাংলায় বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার ও তার ট্রেন্ড। এর মুখ্য সুবিধা মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নকে হিসাবের আওতায় আনা যায়। অন্যদিকে প্রধাণ দুর্বলতা প্রার্থীজনিত মানুষের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দকে এই হিসেবে সরাসরি আনা কঠিন। বস্তুতঃ এই পদ্ধতিকে বাজার চলতি জনমত সমীক্ষার প্রতিপূরক পদ্ধতি বলা যায়। বাজার চলতি জনমত সমীক্ষার হাল বাংলার মাঠে ঘাটে হিন্দু শরৎচন্দ্রের নতুন দার মতই মচমচে পাম্পসু; উন্নয়নের কাদায় চুপসে যায়। জনের মত ভোট বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মনের মত হয় না আর হলেও আদৎ ভোটকেন্দ্রে আঙ্গুলের মত হয়ে উঠতে পারে না অনেকসময়েই- সে আধা সামরিক এলেও নয়, পোনে সামরিক এলেও নয়। হ্যাঁ একথা ঠিক, বাংলার ভোট চালচিত্রে অনেক বদল হয়েছে, চুপচাপ সাদা থান পাঠানোর বদলে বেশ চড়াম চড়াম শব্দেই গুড়-বাতাসা-নকুলদানা বিলি হচ্ছে। তাও- তাও দু সপ্তার ফ্ল্যাগ মার্চে যে কিছুই অবস্থার পরিবর্তন হবে না, তা জনমত সমীক্ষা দেখে না দেখতে অভ্যস্ত।
এবং এইখানেই বিগত পরিসংখ্যান ভিত্তিক সমীক্ষার একটা আলাদা মাহাত্ম্য থেকে যায়। সেই সুবিধার কথা আলোচনার আগে বরং একবার দেখে নিই বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা এই উন্নয়ন ভারাক্রান্ত রাজ্যটির সম্পর্কে কি ভবিষ্যদ্বানী করেছে।
সারণী -১
মোটের উপর বিজেপির ৭-১১ টি আসন প্রাপ্তি সম্পর্কে প্রায় সকল সমীক্ষাই পূর্বাভাস দিচ্ছে। অন্যদিকে জনৈক স্পাইক মিডিয়াকে বাদ দিলে বামেদের পক্ষে মত পড়েছে ০-১, এবং যাদের সঙ্গে তাদের একটি অম্ল-মধুর পূর্বরাগী সম্পর্ক বিদ্যমান তাদের ভাগে আসছে ০-৪। বঙ্গীয় শাসকদল ৩১-৩৪ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবার এর বিপ্রতীপে দেখা যাক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কি বলছে। শাসক দলের নেত্রী ও তার পারিষদ বর্গ ৪২-এ ৪২ র দাবী জানাচ্ছে, যেখানে কেন্দ্রীয় শাসক দলটি ২০-২২ আশা করছে। বাম বা কং এর দিক থেকে আপাতত কোন দাবী নেই, তবে তারা তাদের জেতা আসন গুলি ধরে রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেছে অর্থাৎ ন্যূনতম ৬। এই পারস্পারিক দাবী আর জনমত সমীক্ষা যদি পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা দিক হয়ে থাকে তাহলে অন্যদিকে রয়েছে বিগত দশ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের উত্থান পতন। সেটা দেখে নেওয়া যাক সারণী-২ তে।
সারণী-২
এরপর ছোট করে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক কয়েকটা প্রাসঙ্গিক তথ্যে-
তথ্য-১) ২০১৪ তে বিজেপির ভোটের উত্থান এবং ২০১৬ তে হ্রাসপ্রাপ্তিঃ ২০১৪ তে বিজেপির ভোট পূর্ববর্তী ১০ বছরের গড় প্রাপ্তি ৪.১% চারগুণেরও বেশী হয়ে দাঁড়ায় ১৭%। ২০১৪ তে দেশব্যাপী চলা ‘মোদী ঝড়’ কে এর কারণ হিসাবে দেখানো হয়। সংশয় ছিল এই বৃদ্ধি সাময়িক। সংশয় অনেকাংশেই সঠিক প্রমাণিত হয় যখন ঠিক দু বছরের মাথাতেই বিজেপির ভোট প্রায় ৭% কমে। এই একই সময়ে বাম-কং এর মিলিত ভোট কমলেও তা খুবই সামান্য (৪১.২ থেকে ৩৯.৭%)
তথ্য-২) বিজেপির ভোটের পুনঃবৃদ্ধিঃ কিন্তু অচিরেই ২০১৭ তে ঘটা বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট দাঁড়ায় ২২.৩% । এমনকি উন্নয়ন বিধ্বস্ত বাংলা পঞ্চায়েতেও বিজেপির ভোট থাকে প্রায় ১৯%। অর্থাৎ ১৭-১৮ সালে বিজেপির গড় ভোট ১৬ সালে প্রাপ্ত ভোটের প্রায় দ্বিগুণ। ঠিক এই সময়েই বাম-কং এর মিলিত ভোট ৩৯.৭% (২০১৬) থেকে কমে এসে দাঁড়ায় ১৮% (২০১৭) এবং ১৩.৮% (২০১৮)।
তথ্য ১ ও ২ বিশ্লেষণ করলে বলা যায় বাংলার পরিস্থিতি বাম কং এর জন্য অশনি সঙ্কেত নিয়ে আসছে। যদিও বিভিন্ন বাজার চলতি পত্রিকা তথ্য-১ টিকে হাইলাইট করে বাংলায় বাম-কং এর ভোট ভিত্তি প্রায় ৪০% এবং বিজেপির মাত্র ১০% দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তথ্য ২ স্পষ্ট করে বলছে যে যদিও বং ভোটাররা ২০১৬ তে দোদুল্যমান ছিল এবং চিরাচরিত অভ্যাসে বাম-কং কেই আসল প্রতিপক্ষ মনে করেছিল কিন্তু তাদের ক্রমাণ্বয়িক নন-এক্সিস্টেন্স (সে যতই লং মার্চ-ফাটা পা হোক না কেন) এর ফলে মানুষ স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হয়েছে এবং বিজেপিই তাদের কাছে ক্রমজনপ্রিয় বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে।
(চলবে)http://a-review-on-seventeenth-lok-sabha-election-second-part
ড: অভিষেক অধিকারী।
সহকারী অধ্যাপক,আই আই টি