১৭, ইয়র্ক রোডের বাড়িটি কেবল দিল্লীবাসীদের জন্য নয়, সমগ্র ভারতের অদিবাসীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ স্বাধীন ভারতের প্রথম ‘মনোনীত’ প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু এই ১৭ নম্বর ইয়র্ক রোডের বাংলোবাড়িতে কয়েক বছর ধরে বসবাস করছিলেন। আর মাত্র ১৩ দিন পরেই ভারতের ‘মনোনীত’ প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।
১৭, ইয়র্ক রোডের বাড়িটিতে সাধারণ নাগরিক ও বিভিন্ম সংগঠনের কর্তাব্যক্তিদের আনাগোনা ও কর্মচাঞ্চল্য দ্রুত বাড়ছিল। এমনিতেই ইয়র্ক রোড এক ব্যস্ত রাস্তা ছিল অনেক দিন আগে থেকেই। ১৯১১ সালের আগে যখন বাংলার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির কারণে ব্রিটিশেরা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করবার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এডউইন ল্যুতিয়েন নামে এক ব্রিটিশ আর্কিটেক্টকে নতুন দিল্লী শহরের পরিকল্পনা করবার জন্য নিযুক্ত করা হয়। ল্যুতিয়েনের পরিকল্পনায় নতুন দিল্লীর স্থাপনা এই ইয়র্ক রোড থেকেই শুরু হয়। নেহরু যে ১৭ ইয়র্ক রোডের যে বাংলোয় থাকত, তার নির্মাণ ১৯১২ সালে সম্পন্ন হয়েছিল।
এই বাংলোতে দোসরা অগস্টের সকাল থেকেই লোকজনের ব্যস্ততা ও তৎপরতা চোখে পড়বার মত ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আর মাত্র ১৩ দিন বাকি ছিল, হস্তান্তরের অনুষ্ঠান পর্বের প্রস্তুতি তো মুখ্য ছিলই, এর সাথে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্রমাগত নেহরুর নজরে আনা হচ্ছিল। জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন থেকে শুরু করে মন্ত্রীপরিষদ এর গঠন প্রভূত বিষয়ের কর্মসূচী নেহরুর সামনে ছিল। এসত্ত্বেও ১৫ অগস্টের দিন কি পোশাক পরবেন, এসমস্ত আপাততুচ্ছ বিষয়েও নেহরুর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়েরা ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ইয়র্ক রোডের বাংলোয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার জন্য এসে বসেছিলেন, এই কারণে নেহরু সকাল সকাল জলখাবার গ্রহণ করে এক কর্মমুখর ব্যস্ত দিনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
অন্যদিকে, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভারতে যোগদানকারী রাজ্যগুলিও ঘটনাবহুল ছিল। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল নিজে ভারতের রাজ্যগুলি ও ব্রিটিশ অধীনস্থ করদ রাজ্যগুলির দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। এই কাজের জন্য উনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কুশলী আধিকারিক ভি কে মেননের ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সর্দার প্যাটেলের নির্দেশে ভিকে মেনন দোসরা অগস্ট ভারত সরকারের তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারি স্যর প্যাট্রিককে একটি পত্র দেন, যাতে উল্লেখ করেন ‘ভারতের আয়তন ও আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক দিয়ে বড় রাজ্যগুলি যেমন মহীশূর, বরোদা, গোয়ালিয়র, বিকানীর, জয়পুর ও যোধপুর ভারতে যোগ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু বর্তমানে হায়দ্রাবাদ, ইন্দোর আর ভোপাল এই বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি।’ এই স্বশাসিত রাজ্যগুলির নির্ণয় তখনও বিলম্বিত ছিল।
ভোপাল, জুনাগড় ও ইন্দোর এই স্বশাসিত রাজ্যগুলির ভারতে যোগদান করবার কোনো প্রকার ইচ্ছে ছিল না, এই বিষয়ে ভোপালের নবাব জিন্নাকে একটি পত্র লেখেন। জিন্না ও ভোপালের নবাব হামিদুল্লাহ দুজনের গভীর বন্ধুত্ব ছিল, নিজের পরম বন্ধু জিন্নাকে লেখা এই চিঠিতে নবাব বলেন, ‘আশি শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যাযুক্ত ভোপাল হিন্দু ভারতে একাকী ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, আমার রাজ্যও ইসলামের শত্রুরা ভোপালকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, কাল রাতেই আপনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন পাকিস্তানও কোনোরকম সাহায্য করবে না।’
১, কুইন ভিক্টোরিয়া স্থিত বাংলোয় বসবাসকারী রাজেন্দ্রপ্রসাদের ও ব্যস্ততার শেষ ছিল না। যদিও ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হওয়ার দেরি ছিল, কিন্তু বর্তমান নেতৃত্বের পিতৃপুরুষসম সমস্ত দিকে নকর রাখছিলেন। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল হস্তান্তরের সময় ওনার সঙ্গে শলা পরামর্শের জন্য না বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার জন্য ওনার কাছে লেকের আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিহার প্রদেশের মানুষ ছিলেন, তাই বিহার থেকেও প্রচুর মানুষ ওনার সাক্ষাতের জন্য ওনার বাড়িতে ভিড় জমাতো।
রাজেন্দ্র প্রসাদ এক পত্রে তৎকালীন রক্ষামন্ত্রী সর্দার বলদেব সিংকে এক পত্রে জানান ১৫ ই অগস্টের দিন পাটনায় স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উৎসবে সেনাবাহিনীকে যাতে সামিল করা হয়, তাতে উৎসবের গরিমা বৃদ্ধি পাবে।
সর্দার বলদেব সিং অকালি দলের সদস্য চিলেন ও রাজেন্দ্রপ্রসাদকে প্রভূত শ্রদ্ধা করতেন, তাই নিশ্চিত ভাবে রাজেন্দ্রপ্রসাদের অনুরোধ যে মানা হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না।
দোসরা অগস্ট সকালে সংযুক্ত প্রদেশে (যা বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) অন্য এক নাটকের সূচনা হয়েছিল। আগের দিন রাত্রিবেলা সংযুক্ত প্রদেশের হিন্দু মহাসভার নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, কারণ তারা নাকি সরকারের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট আ্যকশন’ করার শঙ্খনাদ করবেন এই অভিযোগে। ‘ডাইরেক্ট আ্যকশন’ ভারতীয় রাজনীতিতে কলঙ্কজনক শব্দ কারণ, ১৯৪৬ সালে ‘ডাইরেক্ট আ্যকশন’ এর নামে মুসলিম লিগের জিহাদী গুন্ডারা কলকাতায় পাঁচ হাজার হিন্দুকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল, সহস্র হিন্দুনারীকেও ধর্ষণ করেছিল এই নরপিশাচেরা।
কংগ্রেস কার্যসমিতি ডাইরেক্ট আ্যকশন ডে হত্যার স্মৃতি মাথায় রেখে দেশ বিভাজনে স্বীকৃত হয়, অথচ ‘ডাইরেক্ট আ্যকশনের’ মিথ্যা আরোপে হিন্দু নেতাদের গ্রেফতার করার ঘটনা সত্যিই অদ্ভুত, কারণ একমাত্র মুসলিম লিগই ডাইরেক্ট আ্যকশনের ডাক দিয়েছিল। সিঙ্গাপুরের ‘ইন্ডিয়ান ডেইলি মেইল’ নামে সংবাদপত্র গুরুত্বের সঙ্গে প্রথম পাতায় হিন্দু মহাসভার দশজন নেতার গ্রেফতারির খবর হিন্দু মহাসভার দশ দফা দাবীর সাথে প্রকাশ করে। এই ঘটনার জন্য হিন্দু মহাসভার কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
পূর্ব প্রান্তে কোহিমায় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিগ অব কোহিমা’ ঘোষণা করে নাগাল্যান্ড ভারতীয় গণরাজ্যে যোগদান করছে না। পরিবর্তে এক নির্দলীয় সরকার গঠন করা হবে যাতে নাগা জনজাতির এক স্বাধীন প্রদেশ গঠন করা হবে।
ঐ পনেরো দিন
এরকম উত্তেজক ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ভারতীয় সিনেমা দেশ বিদেশে মানুষের মনোরঞ্জন করতে থাকে। সিঙ্গাপুরের ডায়মন্ড থিয়েটারে অশোককুমার ও বীরা অভিনীত ‘আট দিন’ সিনেমায় ভিড় উপচে পরছিল। সাদাত হোসেন মান্টোর গল্প অবলম্বনে এই সিনেমাটি তৈরী হয়, সুরকার হিসেবে প্রথমবার সুর দেন এস ডি বর্মন।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দিল্লীস্থিত বাসভবন (যা বর্তমানে ডঃ এ পি জে আবদুল কালাম রোড) কর্মব্যস্ততার তুঙ্গে ছিল। ব্রিটিশ অধীনস্থ স্বশাসিত রাজ্যগুলির ভারতের সাথে সংযুক্তিকরণ ও সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্তান ও বাংলার দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এই দিন দুপুরে নেহরুর থেকে একটি পত্র পান সর্দারজী, যাতে নেহেরু লিখেছিল ‘….বলতে গেলে আনুষ্ঠানিকতার জন্যই আপনাকে এই পত্র দেওয়া। আমি আপনাকে আমার মন্ত্রীপরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যদিও এই পত্রের বিশেষ কোনো অর্থ নেই, কারণ আপনি প্রথম থেকেই মন্ত্রীসভার এক সুদৃঢ় এক স্তম্ভ…’
সর্দার প্যাটেল পত্রগ্রহণ করে পত্রের দিকে চেয়ে থাকলেন, তারপর মৃদু হেসে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে দাঙ্গা পরিস্থিতির সমাধানের জন্য নিজ সচিবের সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করেন।
দিল্লীর ব্যস্ততা থেকে দূরে কংগ্রেসের মধ্যের বামপন্থী মনোভাবাপন্ন যুবসম্প্রদায় মহারাষ্ট্রের আলন্দীতে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী দোসরা অগস্ট ও তেসরা অগস্ট শঙ্কররাও মোরে ও ভাউসাহেব রাওতের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পরে বামপন্থীদের বৈঠক ডাকা হয়েছিল। দুই মাস আগে থেকেই বামপন্থী ও সাম্যবাদীরা নিশ্চিত ছিল ভারত স্বাধীনতা পাচ্ছেই, এবং দেশের শাসনব্যবস্থা কংগ্রেসের হাতেই যেতে চলেছে, এই পরিস্থিতিতে সাম্যবাদী ও বামপন্থীদের দিশা কি হবে, তা নির্ধারণের জন্য এই বৈঠক দিল্লী থেকে দূরে স্থির করা হয়েছিল।
কংগ্রেসের জন্য কর্মরত কিন্তু বামপন্থী এরকম অনেক নেতা, তুলসীদাস জাধব, কৃষ্ণরাও ধুলুপ, জ্ঞানোবা জাধব, দত্তা দেশমুখ, র কে খাদিলওয়াল, কেশবরাও জেধের মত পরিচিত ও প্রবীণ নেতাও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে এক সংগঠন তৈরীর ভাবনা ছিল। কিন্তু এটা কেউ ভাবতে পারেনি, এই বৈঠক থেকেই ভবিষ্যতে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে কৃষক ও শ্রমিক অধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য এক নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেবে। দোসরা অগস্টের এই বৈঠকের নেতারা কেবলমাত্র কংগ্রেসের ভেতরে তাদের ভবিষ্যত নিয়েই চিন্তিত ছিলেন, দেশভাগ বা সীমন্তবর্তী এলাকার দাঙ্গা ও হিন্দুনিধন নিয়ে কোনো নেতাই মুখ খোলেনি।
মাদ্রাসের এগমোর এলাকায় ব্রিটিশেরা চলে যাওয়ার পর এলাকার আ্যংলো ইন্ডিয়ানদের কি হবে তাই নিয়ে একটি বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টি এস এস রাজন আ্যংলো ইন্ডিয়ানদের বলেন, যে তারা ভারতের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে শান্তিপ্রিয় ভাবে জীবন নির্বাহ করে এসেছেন, স্বাধীনতার পরেও কংগ্রেস তাদের প্রতি সজাগ লক্ষ্য রাখবে।
পুনাতে হিন্দুমহাসভার আয়োজিত এস পি কলেজের সভায় দেশভাগ, স্বাধীনতা ও বর্তমান পরিস্থিতির ওপর স্বয়ং বীর সাভারকর নিজ বক্তব্য রাখবেন। দেখতে দেখতে জনসভা এক বিশাল জনসভার রুপ নেয়, এবং বীর সাভারকর বলেন, ‘ আজ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দায় কেবল কংগ্রেসের নয়, দেশের সাধারণ মানুষও এর জন্য দায়ী, সাধারণ মানুষ অন্ধভাবে কংগ্রেসকে সমর্থন করবার জন্য কংগ্রেস এক শ্রেণীর মানুষকে তুষ্টিকরণ করে এসেছে, এবং তারাই দেশভাগের জন্য দায়ী’।
গান্ধীর দ্বিতীয় দিনের শ্রীনগর সফরে কোনো উল্লেখ্য ঘটনা না ঘটলেও সকালের প্রার্থনার পর শেখ আবদুল্লার স্ত্রী আকবর জাহান তার কন্যাকে নিয়ে বারবার আবেদন করতে থাকেন, কেন তার স্বামী শেখ আবদুল্লাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তির দরকার।
ন্যাশনাল কনফারেন্স দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গান্ধী অনেকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন, যার মধ্যে কিছু হিন্দু নেতাও ছিলেন। তেসরা অগস্ট গান্ধীর মহারাজা হরি সিং দেখা করবার সময় এগিয়ে আসছিল।
আজকের দিনে লাহোর, পেশওয়ার, চট্টগ্রাম, ঢাকা, অমৃতসর থেকে দাঙ্গার খবর অবিরত আসছিল! যত রাত বাড়ছিল ততই আগুন লেলিহান শিখা গ্রাস করছিল গ্রামের পর গ্রামকে। দোসরা অগস্টের রাত্রি অশান্তি ও বিভীষিকার রাত্রি ছিল।