ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের একশ বছর হলো। এই একশ বছরের বামপন্থার হিসাব নিকাশ করা শুরু হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আমাদের এর জন্য বিশেষ সময় ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। আমাদের নিজেদের কাজ এগোনোর জন্য যতটুকু দরকার ততটাই এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া ভাল। যাঁরা বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত আছেন তাঁরা নিজেদের উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবেন, সে ব্যাপারে আমি বলবার যোগ্য নই। আমি একেবারে কিছুটা সংকীর্ণ মনোভাব নিয়েই এই আলোচনার কথা বলব, কারণ পশ্চিমবঙ্গবাসীদের হাতে একেবারেই সময় আর নেই। পশ্চিমবঙ্গবাসীদের প্রয়োজন এখন এমন কিছুর চর্চা যা পশ্চিমবঙ্গকে ইসলামী দখলের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। বাকী সব কিছু অপেক্ষা করতে পারে।
বামপন্থীদের ব্যর্থতা ও দেশে বিদেশে তাদের অপকর্ম নিয়ে আলোচনার থেকে আমাদের কাজে দিতে পারে বামপন্থীদের সাফল্য কাহিনীগুলি থেকে শিক্ষা নেওয়া। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বামপন্থী ভাবধারা ছাত্র যুবদের যেভাবে আকৃষ্ট করেছিল তা শিক্ষণীয়। বাঙলায় চল্লিশের দশক থেকেই বামপন্থী ভাবধারা বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। দেশ স্বাধীন হবার পর পঞ্চাশের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সংস্কৃতির নেতৃত্ব বামমনোভাবাপন্নদের হাতে চলে যেতে থাকে। শিক্ষিত ছাত্র ও যুবকেরা বামপন্থীদের চিন্তাভাবনায় আকৃষ্ট হতে থাকে। এই ছাত্র যুবকেরা পরে অনেকেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে বামপন্থী চিন্তাকে সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এটা সম্ভব হয়েছিল, এখনো অনেক স্থানে হচ্ছে, কারণ বামপন্থীরা যুবকদের সামনে একটি কল্পিত সুন্দর সাম্যের সমাজের স্বপ্ন দেখায়। তরুণ মন সামনে একটি লক্ষ্য দেখতে পায়। এটি অনেকটাই ইসলামী মৌলবাদীদের সঙ্গে সমতুল্য যেখানে প্রত্যেক পুরুষকে বেহেস্তের স্বপ্ন দেখান হয়। বামপন্থীরা এটি করে অনেক সুচারু ও আধুনিক ভাবে। এর জন্য তাঁরা সমাজের প্রতিভাধর মানুষদের আমন্ত্রণ করে, তাদের সাহায্য করে এবং বেশীরভাগ সময় এসব কাজ তাঁরা সরাসরি পার্টির নামেও করে না। সবাই চিরকাল বামপন্থায় থাকেন না, কিন্তু যতদিন থাকেন তাঁরা বামপন্থী ভাবধারাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে যান। চৈতন্য-রবীন্দ্রনাথের বাঙলায় সাহিত্য-সঙ্গীত- চারুকলাকে বামপন্থীরা ধীরে ধীরে দখল করে নিল।
পাশাপাশি দেশ জুড়ে শিক্ষার বিষয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ইসলামী শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে হিন্দুবিরোধী এক আবহ তৈরী করল। ইতিহাস জগত থেকে মুছে ফেলা হল রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকারদের। পাকিস্তানের আঁতুড়ঘর আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরী হতে থাকল ভারতের ইতিহাস। ১৯৬৯ সালে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হল আর ১৯৭১-৭৭ সালে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হলেন মার্ক্সবাদী ইসলামী নুরুল হাসান। ভারতের ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার জগত ধীরে দখল করে নিল বামপন্থীরা। সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরা ছাড়া কোথাও নির্বাচনে সামান্য গুরুত্ব না থাকা সত্ত্বেও দেশের শিক্ষা সংস্কৃতির চাবিকাঠি এখন বামপন্থীদের হাতে।
আমরা কী করছি?
বামপন্থীদের এইসব সাফল্য থেকে আমরা কি এখনো কোন শিক্ষা নিয়েছি? বামপন্থীরা ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেই কলকাতা শহর থেকে সব ব্রিটিশদের মূর্তি সরিয়ে ফেলে। লেনিন মার্ক্সের নামে রাস্তা হয়। ২৫ বছর গুজরাতে ক্ষমতায় থেকেও হিন্দুত্ববাদীরা আমেদাবাদ শহরের নাম পাল্টে কর্ণাবতী করতে সাহস পায় নি। গুজরাতে অন্ততঃ ঐতিহাসিক প্রমাণ সহ ৫০টি মসজিদ আছে যেগুলি মন্দির ভেঙে সেখানে তৈরী হয়েছিল। হিন্দুত্ববাদী সরকার এই মসজিদগুলিকে অপসারিত করার কোন প্রচেষ্টা নেয় নি। অন্ততঃ এই মসজিদগুলির সামনে এর ইতিহাস সংক্রান্ত নোটিশ বোর্ড লাগিয়ে এইগুলি জনসাধারণের ব্যবহার ও দর্শন বন্ধ করতে পারত। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা রাজ্য সরকারের দায়িত্বে থাকে। সুতরাং গুজরাতে মাদ্রাসা শিক্ষার স্বীকৃতি সরকার বন্ধ করলেই তা বন্ধ হয়ে যেত। এমনকি মাদ্রাসায় ও স্কুল স্তর পর্যন্ত আরবী শিক্ষা সহজেই বন্ধ করা যায়। এসব কিছুই হয় নি। ফলে আমেদাবাদের রাস্তায় নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের সময় মুসলমানেরা পুলিশকে রাস্তায় পেটাতে কোনও ভয় পায় নি। একই অবস্থা ২০ বছর ধরে রাজত্ব করা মধ্যপ্রদেশে। অথচ ইচ্ছে থাকলে যে করা যায়, তা প্রমাণ হয়েছে প্রয়াগরাজ নাম ফিরিয়ে আনা বা ফৈজাবাদ জেলার নাম অযোধ্যা করার মধ্য দিয়ে।
গুজরাত বা মধ্যপ্রদেশ সরকার ভারতে ইসলামি অত্যাচার ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের একটি মিউজিয়াম, একটি ইতিহাস কেন্দ্র তৈরী করতে পারত, যেখানে সারা দেশের তরুণ ঐতিহাসিকরা গবেষণা করতে যেতে পারতেন। গত ছ’ বছরে কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা তৈরী হয় নি যা এক নতুন হিন্দু ভারতের স্বপ্ন দেখাবে। এই হিন্দু ভারত পুরানো মন্ত্রতন্ত্র তিলক-টিকির ভারত নয়, পাঁচ হাজার বছরের সমৃদ্ধ সভ্যতার আধুনিক সংযোজন। কেবল ক্ষমতা দখলের জন্য বিরোধী দলের নেতাদের ভাঙ্গিয়ে আনা, সিনেমা টিভির লোক নিয়ে এসে দলের উচ্চ পদে আসীন করা হচ্ছে। নতুন স্বপ্ন দেখানোর না আছে চিন্তাভাবনা, না আছে সেই ইচ্ছা। পশ্চিমবঙ্গেও এইটিই চলছে।
ভারতের অন্য প্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি মূল পার্থক্য রয়েছে। এটি হচ্ছে বামপন্থী চিন্তার এবং ইসলামী মৌলবাদীদের যৌথ কর্মক্ষেত্র। (কেরালাও অনেকটাই তাই তবে কেরালার সীমান্তে কোন পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নেই)। ফলে যা চলছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব কতদিন থাকবে তা বলা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে হলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু যুবকদের নতুন এক পশ্চিমবঙ্গের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সেটা রাজনৈতিক হিন্দুত্বের কাজ, নির্বাচনী বক্তৃতার নয়। এর জন্য প্রয়োজন নতুন ভাবনা, নতুন কথা, নতুন প্রতীক। বাঙ্গালীর কয়েক হাজার বছরের আত্মপরিচয়কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বামপন্থীরা কেবল মাঠের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে নি, তাঁরা চিন্তার লড়াইটাও জারী রেখেছিল, মাঠের লড়াইয়ের কমরেডদের চোখে কিছু স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। আমাদের মাঠের মানুষদের অনেকের চোখে কেবল গদীর স্বপ্ন আছে, অন্য কোন স্বপ্নের কথা কেউ তাদের বলে নি।
মোহিত রায়