“ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে। একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে।” যখন আশি বছরের জন্মদিনে (১৯৪১) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের স্বাধীনতোত্তর অনাগত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় চিন্তিত হয়ে তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটিতে উপরের অনুভবটি লিখছেন, তখন এই দেশের এক ক্রান্তদর্শী মহাপুরুষ রাষ্ট্রীয়তার নির্ভুল, ইতিবাচক ও চিরকালীন তত্ত্বের আধারে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের যোগ্য নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন, তিনি মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর। সকলের শ্রীগুরুজী। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রবন্ধেই যে দুর্মর আশা ব্যক্ত হয়েছিল, “আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্রলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই”… সেই আশারই যেন মূর্ত রূপ শ্রীগুরুজী। কী অদ্ভুত ভাবে কবিগুরুর চিন্তার আলোক একাকার হয়ে গেছে গুরুজীর চিন্তাচয়নে তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। দীর্ঘকেশী শ্মশ্রুগুম্ফ শোভিত, উন্নতনাসা, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সম্পন্ন সৌম্যকান্ত দুই মহাপুরুষের বহিরঙ্গে যেমন অদ্ভুত মিল, অন্তরে মিল যেন আরো গভীর! দুজনেই যেন সামগানে মুখরিত কোন তপোবনের বেদজ্ঞ ঋষি, কণ্ঠে উপনিষদের অমোঘ বাণী। যে বাণী লক্ষ কোটি ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করে দেশপ্রেমে, সাহস জোগায় লক্ষ্যপূরণে।
বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘দেশহিত’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, “এ কথা নিশ্চয়ই মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদের দেশের কোনও উদ্যোগ যদি দেশের সর্বসাধারণকে আশ্রয় করিতে চায় তবে তাহা ধর্মকে অবলম্বন না করিলে কোনও মতেই কৃতকার্য হইবে না। কোনও দেশব্যাপী সুবিধা কোনও রাষ্ট্রীয় স্বার্থসাধনের প্রলোভন কোনওদিন আমাদের দেশের সাধারণ লোকের মনে শক্তি সঞ্চার করে নাই।
অতএব আমাদের দেশের বর্তমান উদ্দীপনা যদি ধর্মের উদ্দীপনাই হইয়া দাঁড়ায়, দেশের ধর্মবুদ্ধিকে যদি একটা নূতন চৈতন্যে উদ্বোধিত করিয়া তোলে, তবে তাহা সত্য হইবে, দেশের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইবে সন্দেহ নাই।” শ্রীগুরুজীর বক্তব্যেও এই কথার অনুরণন শোনা যায়। তিনি বলছেন, “এই ভূমির সন্তান হিসাবে আমাদের সুবিকশিত সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বসবাস করছে। এই সমাজ হিন্দু সমাজ…. এই হিন্দুদের পূর্বপুরুষরাই মাতৃভূমির প্রতি প্রেম ও ভক্তির আদর্শ ও পরম্পরা সৃষ্টি করেছিলেন। জনগণের মনে আমাদের মাতৃভূমির সজীব ও পূর্ণাঙ্গ চরিত্রটিকে চির উজ্জ্বল রাখতে এবং দেবী সত্তা রূপে তাঁর প্রতি ভক্তিকে সদাজাগ্রত রাখতে বিভিন্ন কর্তব্য ও ক্রিয়াও তাঁরা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। মাতৃভূমির পবিত্রতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় আপন রক্ত দিয়েছিলেন তাঁরাই।” তাই তিনি আরেক বক্তব্যে বলছেন, “রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ যে হিন্দু সংগঠনের ব্রত গ্রহণ করেছে, সমগ্র মানব সমাজের জন্য পরম সুখের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দেবার এই আদর্শের অনুপ্রেরণাতেই তা গ্রহণ করেছে এবং যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের আত্মবিশ্বাসও ততই বাড়ছে যে, তথাকথিত প্রগতিশীল আধুনিক সমাজগুলিও একদিন এই পবিত্র ভূমির প্রাচীন অথচ সজীব জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।”
ভারতীয় হিন্দু সমাজ যে ক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে (১৯১০) পরেশবাবুর মুখে তার সাবধানবাণী শোনা যায়। যেন পরেশবাবুর মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “(হিন্দু) সমাজের ক্ষয় বুঝতে সময় লাগে। ইতিপূর্বে হিন্দু সমাজের খিড়কির দরজা খোলা ছিল। তখন এদেশের অনার্য জাতি হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রবেশ করে একটা গৌরববোধ করত। এদিকে মুসলমানের আমলে দেশের প্রায় সর্বত্রই হিন্দু রাজা ও জমিদারের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। এই জন্য সমাজ থেকে কারও সহজে বেরিয়ে যাবার বিরুদ্ধে শাসন ও বাধার সীমা ছিল না। এখন ইংরেজ অধিকারে সকলেই আইনের দ্বারা রক্ষা করছে, সে রকম কৃত্রিম উপায়ে সমাজের দ্বার আগলে থাকার জো এখন আর তেমন নেই। সেইজন্য কিছুকাল থেকে কেবলই দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষে হিন্দু কমছে, আর মুসলমান বাড়ছে। এরকম ভাবে চললে ক্রমে এদেশ মুসলমান প্রধান হয়ে উঠবে, তখন একে হিন্দুস্থান বলাই অন্যায় হবে। ভাগ্যের কি পরিহাস! এই উপন্যাস লেখার মাত্র আটত্রিশ বছরের মধ্যে হিন্দু সংখ্যালঘু হবার কারণে দেশের বিস্তীর্ণ অংশ হিন্দুস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান হয়ে গেল। শ্রীগুরুজী ভারত ভাগের যে ব্যাথা পেয়েছিলেন গুরুদেব তা পাননি। রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী ভারতবাসী গ্রহণ করেনি। ক্ষুব্ধ গুরুজীর আক্ষেপ ‘পাকিস্তানের সৃষ্টি এটাই প্রমাণ করেছে যে, আমরা এখনও ইতিহাস থেকে কোনও শিক্ষাই গ্রহণ করিনি এবং মারাত্মক দুর্বলতার কোনও প্রতিকারই করিনি। ব্রিটিশরা চলে যাবার সময় হিন্দুরা অত্যন্ত অসংগঠিত ছিল এবং জাতীয় নেতৃত্ব মনের দিক থেকে এতই হীনবল ছিল যে, মুসলমানদের ছোটখাট বিক্ষিপ্ত আক্রমণ এবং ব্রিটিশদের চক্রান্তের মোকাবিলা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরই পরিণামে ভারত বিভাগ। আজ স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরেও ভারতবর্ষে হিন্দুরা ক্ষয়িষ্ণু, পাকিস্তান সৃষ্টিতে উৎসাহী দেশবিরোধী শক্তিরা এখনও পুরোদস্তুর চালিয়ে যাচ্ছে দেশভাগের চক্রান্ত।
আসুন, দেশের এই দুর্দিনে শ্রীগুরুজীর আখ্যানে তাঁরই ভাষায় “আবার একবার আমাদের এই শিক্ষার পাঠ নিতেই হবে যে, উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, আমরা যে সম্প্রদায়, জাত বা ভাষার লোক হই না কেন, আমরা সবাই এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, একই মাতার সন্তান, আমাদের শিরায় শিরায় একই রক্তধারা প্রবাহিত। এই উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই কেবল আমাদের সংহত একাত্মবোধের প্রকাশ ঘটতে পারে। অর্থনৈতিক আপস, জোড়াতালির নীতি এই ধরনের একাত্মবোধ গড়ে তুলতে পারে না।” এবং এই সঙ্গেই ১৫৯-তম জন্মদিনে অন্তরের প্রণতি জানাই কবিগুরুর প্রতি।
তথ্যসূত্র:
১। রবীন্দ্র রচনাবলী
২। শ্রীগুরুজীর ‘চিন্তাচয়ন’
ডা. শিবাজী ভট্টাচার্য