গল্প : পিথু বুড়ি – নবনীতা বসুহক

আমাদের গ্রামে লম্বা, ঢেঙ্গা একজন বুড়ি থাকত। সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা গায়ের পিথুর গায়ের  রঙ ছিল মিশকালো। মুখ রামকিঙ্করের ভাস্কর্য এর মত, খোদাই করা। যেন প্রাচীনকাল থেকে উড়ে আসা এই যুগে অবস্থান করা কোন আদিম মানবী। পিথু বুড়ির বয়স কেউ বলত ষাট, কেউ বলত সত্তর, আবার কেউ বা বলতো পঁচাত্তর বছর। জাতিতে ছিল সে সাঁওতাল। এমনিতেই পিথু  বুড়ির বাড়ি ছিল সাঁওতাল পাড়ার এক কোণে। অল্প বয়সে পিথুর স্বামী মারা গেছে। ছেলে শম্ভু যখন মারা গেল একটা অ্যাক্সিডেন্টে তখন পিথু বুড়ি শোকে পাথর হয়ে গেল। এদিকে শম্ভুর বউ পিথুকে মোটে দেখতে পারত না, খেতে দিত না। বুড়ির নাতিরাও তাই। দুজন নাতবৌ— তারা শাশুড়ির মতোই পিথুকে পরিত্যক্ত করে রেখেছিল, পিথু বুড়ি তখন আরো কোনো চালা ঘর বেঁধে একা থাকত, ওর বাড়ির নিচে ছিল তেঁতুল গাছ। পিথু মাটির উনুনে একা রাঁধে, জার্মান সিলভারের সানকিতে খেয়ে, একা একা কাঠ সংগ্রহ করে। শুয়োর আর মুরগি পুষে ওর দিনাতিপাত হয়। কখনো ঝোপঝাড় থেকে মেটে আলু তোলে কখনো দোকান থেকে শিশিতে একশো সরষের তেল, পাঁচশো আলু নিয়ে আসে। একা একাই সেসব কাজ করে। গ্রামের কেউ তার সঙ্গে আলাপ জমায় না। খেঁজুরে আলাপ তো নয়ই। ও নিজেও চুপচাপ হয়ে গেছিল। পিথুও কারও সঙ্গে সেধে কথা বলে না। যখন কালবৈশাখী ঝড় আসে, দোকান থেকে পিথু বুড়ি গজগজ করে বাড়ি ফেরে। আবার মাঠ ফেরত গরুগুলো যেগুলো আসত ধুলো উড়িয়ে কাঠ কুড়াতে গিয়ে পিথুবুড়ির সামনে পড়লে গজ গজ করে! 

পিথু বুড়ির সাঁওতালি ভাষা আমি বুঝিনা। গ্রামের সাঁওতালরা বোঝে হয়তো। বলে, উয়া ডাইনি। ও ভূতের সঙ্গে কথা বলছে। 

ডাইনি আবার কি! 

কাকার ছেলে রিন্টু বলে, জানিস না! ও অমাবস্যার গভীর রাতে ভূত নামায়। তারপর নাচে। ওদের পাড়ায় সবাই দেখেছে। 

তাই আবার হয় নাকি? ভূত কি নামানো যায়? 

শম্ভু মারা যাবার পর সে নাকি ভূত নামায়। ঝাড়ফুঁক করে। পিথু বুড়ির গল্পটা ক্রমশই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের লোকেরা কেউ পিথু বুড়ির দিকে চোখ মেলেও তাকায় না। বাচ্চারা তো নয়। আমায় একদিন কাকিমা বলল, শনিবার স্কুল ছুটি হলে তোমার বাগান ঘোরা আর হবে না। 

কেন? 

পিথু বুড়ির চোখ সর্বত্র। ও নজর দেবে! 

নজর আবার কি!

কাকিমা কথাটা মাকে বলল। এসবে মার বিশ্বাস তেমন নেই। মাকে কাকিমা বলল, মুন্নাকে পিথুবুড়ির তেঁতুলতলায় যেতে বারণ করবেন মেজদি।

আমি তো যাইনা।

তোকে আমি যেতে দেখেছি। আর আমাদের পেছনের বাগানেও যাবি না। ওখানে পিথুবুড়ি কাঠ কুড়োতে আসে।

কাকিমা, নজর মানে কি?

খারাপ দৃষ্টি। ও তোর ভালটা নিয়ে মন্দটা ঢুকিয়ে দেবে।

মা আমায় সবসময় চোখে চোখে রাখতে লাগল। পাছে পিথুবুড়ির নজর লেগে যায়।

স্কুলে যাবার সময় পিথুবুড়ির গল্প বলল কাজল। বলল, তুই জানিস পিথুবুড়ি ডাইনি।

হ্যাঁ। কাকিমা বলছিল। ডাইনি কিরে?

ওরা তুকতাক করে। গভীর রাতে ভূত নামায়। ল্যাংটো হয়ে নাচে!

কেউ দেখেছে?

আমি দেখিনি। তবে ওদের পাড়ার সুবান আমাদের বাড়ি দিনমজুর খাটে, ও বলছিল।

সুবান তো পিথুবুড়ির নাতি। ওর নাতি তো ওকে দেখতে পারে না!

তোদের বাড়ির কাছে বাড়ি, দেখিস সাবধানে থাকিস। দুপুরে টো টো করে ঘুরবি না। বিশেষত শনি, মঙ্গলবার। 

মঙ্গলবার তো স্কুল থাকে। শনিবার বাড়ি ফিরে কখনো বাগানে যাই, ওদের তেঁতুলতলায় যাই। মা আর যেতে দেয়না, জানিস তো!

রত্রিবেলা আমাদের গ্রাম নিশ্চুপ হয়ে যায়। দূরে মাঝে মাঝে ট্রেন যাবার ঝমাঝম আওয়াজ কানে বাজে। ওপারের মিলের সাইরেন শোনা যায় নিশীথ রাতে। কারখানার শ্রমিকদের ছুটি আর যোগদানের তিনটে শিফটের সাইরেন। মাঝে মাঝে শোনা যায় হুক্কা হুয়া করে শিয়ালের ডাক অথবা খুব কম বিড়ালের ডাক। আবার কখনও কখনও অলৌকিকতা জাগিয়ে দিয়ে কুকুর ডাকে নিশুতি রাতে। ঘোর অমাবস্যার রাতে বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজও কেমন ছমছম করে। কখনও। হঠাৎ রাতে শোরগোলের আওয়াজ। জানলা দিয়ে দেখি হ্যারকেন আর টর্চ নিয়ে বেড়িয়েছে মানুষজন, তাদের গন্তব্য সাঁওতাল পাড়ার দিকে। মা বাবা, আমি, রিন্টুসহ আমাদের যৌথপরিবারের অনেকেই বেরিয়ে পড়লাম। মা বলল, তোকে যেতে হবে না।

কেন?

কী হয়েছে আগে জেনে আসি, তারপর তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে। 

আমি একা একা বাড়িতে থাকতে পারব না। আমার ভয় করছে!

আচ্ছা চল। মা ডাকল কাকিমাকে, নীতা তোমাদের পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে এস।

কাকা ও কাকিমা, আমি, মা রিন্টু সহ অনেক লোক জন রাস্তা জুড়ে। তাদের মধ্যে বউ মেয়ের সংখ্যা নেহা‌ৎ কম নয়। সবাই অত রাতে খুব ব্যাগ্র। মুখে কথা—পিথু বুড়ি ধরা পড়েছে।

সকলের সমস্বর—কিভাবে ধরা পড়ল? এতদিন ধরা পড়েনি কেন? কে ধরল।

কাকিমা বলল, সবাই আগে গিয়ে দেখি, তারপর বোঝা যাবে। কী করে ধরা পড়ল, কে ধরল, কিভাবে ধরল, না গেলে তো বুঝব না।

পিথুবুড়ি নাকি ডাইনি। তার অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের সময় তাকে হাতে নাতে ধরা হয়েছে। সে নাকি যজ্ঞ করছিল আগুন জ্বেলে, আর শোঁ শোঁ করে বাতাস বয়ে আনছিল। সেই বাতাস নাকি ভূত। জটলার মধ্যে যখন প্রবেশ করলাম, মধ্যমণি পিথুবুড়িকে নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা, আলাপ আলোচনা চলছে। 

সে বিড়বিড় করছে! সাঁওতালি ভাষায় বকছে! একটা সাঁওতাল বউকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও কি বলছে গো? 

ও উয়ার ছেইল্যার  নাম নিচ্চে গো। ওর নাকি আজ ছেইল্যা এসেছিল। উ দেখছ না মাথা নাড়ছে! উয়ার ছেইল্যা নাকি বলেছিল বউকে টাইট দেবে। তাই সন্দেহ করে ওর বউ লোক ডেকেছে—

পিথু বুড়ি মাথা চাপরাচ্ছে আর বলছে, আমার ছিলার সঙ্গে আজই পথথ্‌ম দেখা হয়েছিল, উয়ারা সব নষ্ট করে দিল। আর কথা হবে না উয়ার সঙ্গে।

সাঁওতাল পাড়ার মাতব্বররা ধমকে উঠলে, তোমায় পাড়া থেকে, এ গ্রাম থেকে বার করে দুব।

খ্যান খ্যান স্বরে পিথুবুড়ি কাঁদছে। চারদিকে অন্ধকার। সকলে ডাইন দেখছে। বাবা বলল, তুই আর মা বাড়ি যা।

মা বলল, সুষেণ ঠাকুরপো না?

কাকিমা বলল, ও সেজদি সুষেণদা গ্রাম পঞ্চায়েত—তাই এসেছে।

এর পর ডাইন বিচার নিয়ে দুটো দল হয়ে গেল। সাঁওতাল পাড়া চাইছে ডাইনির মুন্ডিত মস্তক করা হোক। আর সুষেণ কাকা বলছে, এখন পিথু বুড়ি এ গ্রামের লোক। তার বিচার হবে পঞ্চায়েতে। যে যার ঘরে ফিরে যাও। কাল দরকার হলে জেলা পরিষদে জানানো হবে।

পঞ্চায়েত সাঁওতাল পাড়ার বিচার পাড়াতেই হবেক। তুমি কে হে। ডাইন সমানে ক্ষতি করে যাবেক। কাল কেন এক্ষুিন মাথা ন্যাড়া করে, ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে উয়াকে তাড়াইবক।

সুষেণ কাকা জোর গলায় বলল, তাই যদি করিস, তোদের সব সুবিধা বন্ধ করে দেব। যাও পিথু ঘরে যাও।

পিথু বুড়ি বলল, ঘরে গিয়া কি হবেক পঞ্চায়েত? আমার ছিলা তো কুনদিন আসবেক না। ঘরে গেলেই ছেলের বউ বিষ দেবেক। 

ছেলের বউ বলল, ডাইনের কথা শুন। ডাইনকে আমার বিষ দিতে বইয়ে গেছে।

ঝামেলা মিটল না। অামরা প্রায় রাত তিনটেয়  বাড়ি ফিরে এলাম। যে যার বাড়ি শুতেও চলে গেলাম। পরদিন সকালে আবার শোরগোল। সাঁওতাল পাড়া থেকে ঢাক বাজছে। আবার সবাই মিলে গেলাম। লুঙ্গিপরা খালিগায়ে পুরুষ সাঁওতােলর দল পিথু বুড়িকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে! আমি, রিন্টু, কাজল ছুটে ওদের ছাড়িয়ে দেখতে লাগলাম। পিথু বুড়ির  সাদা কাপড় মাটিতে লুটোচ্ছে! সাদা কাপড়ে এক পৃথিবী ধুলো আর মলিনতা। মাথায় ঘোল ঢালা। চোখ মুখ মারধোরের ফলে ফাটা ফাটা, রক্তে ক্ষতবিক্ষত। পিথু বুড়ি চলছে ধীর গতিতে। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে এক মাঠের মাঝে তাকে নাকি ফেলে রেখে আসা হবে।

সুষেণকাকাকে কেউ খবর দিয়েছে। ভটভটি নিয়ে চলে এসেছে —সুষেণকাকা। ওদের বলল, তোদের সবাইকে জেলে ভরে দেব।

ডাইনের শাস্তি হবেক না?

পঞ্চায়েত বিচার করবে।

হ। পঞ্চাযেত বিচার করবেক।

মধুজেঠু আসছিল সাইকেল করে। বলল, সুষেণ কী হয়েছে?

এই যে পিথুবুড়িকে নির্বাসন দিচ্ছে।

সে কি! শোন সুষেণ পিথু নিঃসঙ্গ। ওর দীর্ঘস্থায়ী ডিপ্রেশন হয়েছে। ওর চিকি‌ৎসার দরকার। তুমি ব্যবস্থা কর।

কথা শোনে এই সাঁওতালগুলো?

যাকগে, তুমি কিছু একটা ব্যবস্থা কর। —বলে মধুজেঠু শোরগোল কাটিয়ে ঠিক চলে গেল। বাবা অফিস যাচ্ছিল। শোরগোলের দিকে …. চলে গেল। আমরা খেজুরতলা আবধি ছিলাম। বাবার এক ধমকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলাম।

বাড়ি এসে আবার স্কুল গেলাম। বাড়ি ফিরে শুনলাম, সাঁওতালরা পিথুবুড়িকে ওর ঘরে ঢুকতে দেবে না। সুষেণকাকা ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে খড়ের চালা করে মাঠের মাঝে। পঞ্চায়েত থেকেই নাকি ওকে খাবার দেওয়া হবে!

পিথু বুড়ি এখন গ্রামে থাকে না। তাকে আর দোকানে যেতে, চাল কিনতে, সরষের তেল আনতে, মেটে আলু তুলতে, কাঠ সংগ্রহ করতে দেখা যায় না। চারদিক ধান জমির শূন্যতার মাঝে পিথু বুড়ি ‘ডাইনি’ হয়ে একা একা থাকে। আগেও থাকতো। কিন্তু এখন আরও শূন্যতা। আরো একাকীত্ব। পিথু বুড়ির চালা ঘরটা পার হবার সময় লোকে তাড়াতাড়ি করে পার হয়। সুষেন কাকা বাবার কাছে এসে বললেন, মেজদা কেমন আছেন? বাবা বললেন, বস সুষেণ বল দেশের কি অবস্থা? 

আর বসার উপায় আছে— এখনই দৌড়াতে হবে?

বাবা বলেন, পিথু কি গ্রামের বাইরেই থাকবে!

ওর নাতিরা চায়না, ও এখানে থাকে। ওর ছেলের বউ খুব বদমাশ। মা বললেন, একটা বুড়ো মানুষ মাঠের মাঝে থাকতে পারে? কি অন্যায়টাই না হল!

সুষেণকাকা বললেন, পিথুতো বিধবা। কুড়ি বছর ওর স্বামী মারা যায়। ক’বছর আগে ছেলেটাও গেল। মাথা খারাপ হয়ে গেল ওর। মধুদা এখন চিকিৎসা করছে। সামনে ভোট, ভোটটা কিন্তু দেবেন আমাকে।

সুষেণকাকা চলে যাবার পর মা বাবাকে নিভৃতে বললেন, পিথু বুড়ি অমাবস্যার দিন জামা-কাপড় খুলে ফেলতো কেন?

বাবা ফিসফিস করে বলেন, যা আমার কানে যায়, ওটা ওর পারভারশন। স্বামীকে contacting for হয়তো! ছেলের বউটা বদমাশ, খেতে দেবে না— তাই ডাইনি রটিয়ে দিল।

পিথু তো অনেকদিন তুকতাক  করত। হঠাৎ করে ওর বউ সাত বছর বাদে ওকে তাড়ানোর জন্য খেপল কেন? 

কেন আবার? পিথুর ঘরটা ওর দরকার। ছোট ছেলে সুবানের বিয়ে দেবে।

সুষেণ ঠাকুরপো কি আর পিথুকে গ্রামে ফেরাতে পারবে?

সামনে ভোট। সাঁওতালপাড়ার অতগুলো ভোট কি হাতছাড়া করবে? তাই আড়ালে রেখে দিল। 

ও যে ডাইনি নয়, সে প্রমাণ তো হল না।

অনেকে বিশ্বাস করে ও ডাইনি।  অথচ পিথুর মত অসহায় মানুষ এই গ্রামে আর একটিও নেই। সাতেপাঁচে নেই, সন্তান হারিয়ে শোকে পাথর। বিশ্বাস করত অমাবস্যায় ওর স্বামী ও ছেলে ওর কাছে আসে। আর এই অপরাধে পিথু নির্বাসিত। চোখ বুজলেই দেখি, পিথুর মাটিতে লোটানো আঁচল—যে আঁচল ময়লা, ধুলো আর অপমানে ভরে গেছে। পিথু বুড়ি উদাসীন পৃথিবীর মত সহ্য করছে সব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.