কাছারির মাঠে কাল জীবনের প্রথম একটা বড় ম্যাচ খেলতে নামবে পুলক। এতকাল স্কুল বা কলেজের হয়ে অনেক ম্যাচ খেলেছে সে অনেক মাঠেই। মাঝমাঠের প্লেয়ার হিসেবে তার বেশ নামডাকও হয়েছে। পাড়ার অগ্রবাণী ক্লাব কিংবা তাদের বীণাপানি স্কুলের টিমে পুলক ছিল নিয়মিত ফুটবলার। কিন্তু সে সব তো একেবারেই সাদামাঠা খেলা। আগে যখন জেলায় জেলায় ইন্টার স্কুল ফুটবল হত, তেমনটা হলেও বাইরের কিছু লোকের নজরে পড়ত তার খেলা। সে সব বহুদিন আর হয় না। তার পাড়ার ক্লাবও সাবডিভিশন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনে শুধুমাত্র ক্রিকেট টিম হিসেবে নথিভুক্ত। ফুটবলে কোনও ডিভিশনেই সুতরাং নেই তার ক্লাব। টাকাপয়সা খরচ করে ফুটবলের আলাদা টিম গড়েনি অগ্রবাণী ক্লাব। ক্রিকেটের জন্যে অবশ্য অনেক পয়সা খরচ করে, নেট প্র্যাকটিস হয় নিয়মিত সিজনে, ফ্রেন্ডলি ম্যাচও খেলা হয় অনেক। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে তার ক্লাব তো একেবারে এ ডিভিশনের নামী টিম। ফলে ক্রিকেট নিয়ে যতটা হইচই বা বাড়াবাড়ি, ফুটবলে সেখানে একেবারে জিরো! পুলকরা বেলতলার মাঠে নিজেদের মধ্যে একটু বল পেটাপিটি করে কয়েকজন, মাঝেসাঝে এ পাড়া সে পাড়ায় ছুটকো ফ্রেন্ডলি ম্যাচ— ব্যাস, এটুকুই। এ নিয়ে কারও কোনও বাড়তি উন্মাদনা নেই। এসব ম্যাচকে কেউ এতটুকু গুরুত্বও দেয় না, খেলতে হয় তাই খেলা! তবে এ বছর পুলক অগ্রবাণী ক্লাবের দাদাদের সঙ্গে কথা বলে, অনুমতি নিয়েই মিলনী সঙ্ঘে নাম লিখিয়েছে। ওরা এই জেলার ফুটবলে এ ডিভিশনে খেলছে টানা প্রায় পনেরো বছর। রীতিমতো নামী দল জেলার। এরকম কোনও একটা দলে খেলতে পারাটা পুলকের অনেক দিনের ইচ্ছে, কেননা এখান থেকেই ভালো খেলে কলকাতার বড় দলগুলোয় অনেকেই সুযোগ করে নিয়েছে।
আর পুলকও মনে মনে সেই স্বপ্নটাই দেখে। ফুটবল ওর ধ্যানজ্ঞান। খুচরোখাচরা ম্যাচ খেলে এই স্বপ্নটা যে কোনওদিনই পূর্ণ হবে না, সেটা ও ভালোমতোই জানে। তাই বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত ক্লাবের দাদাদের শরণাপন্ন হয়েছিল সে। তাঁরাও রাজি হয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘ঠিক আছে, আমাদের যখন এখনই বড় কিছু প্ল্যান নেই ফুটবল নিয়ে, সত্যিই তো, তুই কেন শুধুমুধু কেরিয়ারটা এখানে থেকে নষ্ট করবি! দেখ, মিলনীতে খেলে যদি কিছু হয়! বাপী ঘোষ, তপন সেনরা তো ওখান থেকেই কলকাতার মাঠে ডাক পেয়েছিল!’ পুলক তাই এবার মিলনীতে নাম লিখিয়েছে। তার খেলা ওরা দেখেছে, পছন্দও হয়েছে। ওদের সেক্রেটারি বিশ্বনাথ মিত্র জানেন, মাঝমাঠে ওর এলেম আছে। সুযোগ পেলে ছেলেটা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। নিয়মিত খেলাবে বলে কথাও দিয়েছেন। কাল মিলনীর হয়ে ওর প্রথম খেলা। প্রথমেই জবরদস্ত প্রতিপক্ষের সামনে পড়েছে ওরা— উদয়ন সঙ্ঘ। ওরাও মিলনীর মতো অতীতের চ্যাম্পিয়ন টিম। ফলে ফিক্সচার দেখার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে পুলকের মনে একটা টানটান উত্তেজনা, সঙ্গে অবশ্য চাপা টেনশনও আছে।
দুই
কলেজে বাংলার ক্লাসটা কেটে মধুশ্রীকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিল পুলক। ইচ্ছে দুজনে বাবুর্চিতে কিছুটা নিভৃতে সময় কাটাবে। চাঁপাতলা মোড়ের দিকে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগোনোর সময় মধুশ্রীর সঙ্গে কালকের খেলা নিয়েই তার মনের কথাগুলো শেয়ার করছিল পুলক। যদিও মধুশ্রী এখনও পর্যন্ত কোনওদিন পুলকের খেলা দেখেনি। বস্তুত ফুটবলে তার তেমন ইন্টারেস্টও নেই। ওর পছন্দ সিনেমা। সে অবশ্য এই মফস্সল শহরের কোন্ মেয়েরই বা আছে! বরদাসুন্দরী কলেজে ইকনোমিক্সে এ বছর ভর্তি হওয়ার পর পরই পুলকের সঙ্গে মধুশ্রীর আলাপ। সবে মাস তিনেক হল। এর মধ্যে ফুটবলের সিজনও আসেনি, পুলকের খেলা দেখারও সুযোগ হয়নি মাঠে গিয়ে। ফুটবল মাঠে যাওয়ার অভ্যেসও অধিকাংশ মেয়ের মতো তারও নেই এমনিতে। যদিও মধুশ্রীদের পুলিস কোয়ার্টারের সামনেই বিশাল কাছারি মাঠ, ওদের ফ্ল্যাটের পশ্চিমের ব্যালকনি থেকেই দিব্যি খেলা দেখা যায় পরিষ্কার। কিন্তু ওখানে কী হচ্ছে, কারা খেলছে, কীসের ম্যাচ— এসব নিয়ে মধুশ্রী কেন, তার বাড়ির কারোরই বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কয়েক বছর আগে এ শহরে যে বড়সড় স্টেডিয়ামটা তৈরি হয়েছে তাদের কলেজের উল্টো দিকে বিশাল এলাকা নিয়ে, সেখানেও তো দিনে তো বটেই, রাতেও বড় বড় ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে মাঝে মাঝেই ফুটবল ম্যাচ হলেও সেখানে গিয়ে কোনও খেলা দেখেনি সে। তবে ওই মাঠে যে এখন কলকাতার নামী দল বা অন্য রাজ্যের কোনও কোনও দলও বিভিন্ন কম্পিটিশনে খেলতে আসে, সেটা মধুশ্রী জানে। একবারই ওই স্টেডিয়ামে গিয়েছে সে মা–বাপির সঙ্গে। সেটা কোনও ফুটবল ম্যাচ দেখতে নয় অবশ্যই, আয়লা দুর্গতদের সাহায্যে একটা জমজমাট ফাংশান হয়েছিল, বোম্বে আর কলকাতার নামীদামি আর্টিস্টরা গান গাইতে এসেছিল, বাংলা ও হিন্দি সিনেমার বেশ কয়েকজন নায়ক–নায়িকাও ছিল, সেটাই ছিল ওদের মূল আকর্ষণ। ফ্লাড লাইটের আলোয় গোটা মাঠটা সেই রাতে দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে চারদিক থেকে রঙিন আলো পড়ে জলসার মঞ্চটা ঝলমল করছিল, তার ওপর সিনেমা আর্টিস্টদের নাচগানে জমে উঠেছিল গোটা স্টেডিয়াম। সেটুকুই শুধু মনে আছে মধুশ্রীর। তবে ইদানীং পুলকের সঙ্গে তার ভাব–ভালোবাসা হওয়ায় ফুটবলে খানিকটা আগ্রহ জন্মেছে মধুশ্রীর। জীবনের প্রথম বয় ফ্রেন্ড যদি ফুটবলার হয়, ফুটবল খেলেই ভবিষ্যতে নাম করতে চায়, তাহলে তো আর বিষয়টাকে উপেক্ষা করা যায় না! তাই ফুটবলটা ঠিক কী জিনিস, খেলাটা কেমন হয়, কীভাবে হয়, সেটা জানতেই পুলকের পরামর্শে আজকাল টিভিতে সে একটু–আধটু ওই খেলাটা দেখতে বসে। পুলকের কাছেই শুনেছে বিশ্বকাপ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগের কথা। জেনেছে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, ফোরলান, রুনি, রোনাল্ডোদের নাম। এমনকি পেলে, মারাদোনা, জিদান, বেকেনবাওয়ারের নামগলোও মুখস্ত করে ফেলেছে। মধুশ্রী জানে, বল নিয়ে পায়ে পায়ে খেলতে খেলতে গোল করাটাই এ খেলার আসল লক্ষ্য। আর এই গোলই কোনও একটা দলকে জেতায়, হারায়। গোলকিপার, ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার, ফরোয়ার্ড এই পজিশন বা শব্দগুলোও তার জানা হয়ে গেছে পুলকের দৌলতে। মধুশ্রী এও জানে যে তার লাভার মাঝমাঠ বা হাফের প্লেয়ার, অন্যকে দিয়ে গোল করানো বা নিজে গোল করাটাই এই হাফেদের আসল কাজ যে কোনও ম্যাচে। এটুকুই পুলকের শান্তি।
তিন
বি কে সি রোড ধরে দুজনে হাঁটছিল চাঁপাতলার রেস্তোরাঁর দিকে। পাশাপাশি গা ঘেঁষে। মধুশ্রী আজ হাঁটুর সামান্য নীচ পর্যন্ত ঝুলের কেকটা হলুদ থ্রি–কোয়ার্টার জিনস পরেছে, সঙ্গে একটা লাল রঙের স্লিভলেস স্কিনটাইট টপ। রাস্তায় বেশ কয়েকটা ছেলে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে সরাসরি কিংবা আড়চোখে ঝাড়ি করছে, এটা লক্ষ্য করেছে পুলক। সে আসলে কালকের ম্যাচটা নিয়ে এত কথা বলছিল মধুশ্রীকে, এতটাই টেনশনে আছে যে ওর এই ড্রেসটা তেমনভাবে খেয়াল করেই দেখেনি। কিন্তু বারবার কিছু ছেলেকে ওভাবে হাঁ করে মধুশ্রীকে গিলতে দেখে এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল সে। নাঃ, সত্যিই এই পোশাকে ওকে বেশ স্মার্ট, রূপসী লাগছে। আসলে এই ধরনের ড্রেস ও ভালো ক্যারি করতে পারে, সেটা পুলক আগেও অনেকবারই লক্ষ্য করেছে। আজ মধুশ্রীর হাঁটুর নীচে দুটো পায়ের অনেকটা অংশই উন্মুক্ত। যেন মাখনের ডেলা দিয়ে কেউ ওর পা দুটোকে বানিয়েছে। কোথাও এতটুকু দাগ নেই, মসৃণ, নির্লোম। হাত দুটোও একইরকম মাখনের ডেলার মতো। স্লিভলেস টপ পরায় লম্বাটে, ছিপছিপে দুটো হাতই সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। সামান্য লো কাট, স্কিনটাইট টপ পরায় মরালের মতো গ্রীবা, একটু ভারী বুক চোখে পড়তে বাধ্য। এক ফালি সরু চাঁদের মতো প্লাক করা ভুরু, ভাসা ভাসা দুটি চোখ, সরু ঠোঁট, টিকালো নাক— সব মিলিয়ে মধুশ্রীকে বেশ সুন্দরীই বলতে হবে। তবে আরেকটু হাইট হলে নায়িকাদের মতো রূপটা আরও খুলত। নাঃ, ছেলেগুলোকে দোষ দেওয়া যায় না, তার নিজেরই তো ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার লোভ হচ্ছে। ওই ছেলেগুলো তো কমবেশি তারই বয়সী। সমবয়সী এরকম একটা সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে তো থাকতেই পারে! চেনা না হলে এই পোশাকে সুন্দরী মধুশ্রীর দিকে সেও নিশ্চয়ই হ্যাংলার মতো একইরকম তাকিয়ে থাকত। মধুশ্রীর অবশ্য এতে কোনও তাপউত্তাপ নেই এতটুকু। এরকম ছেলেপুলে, বুড়ো বুড়ো লোকেদের চোখ তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে এখন পুলককেও হাঁটা থামিয়ে তার দিকে অমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ওর গায়ে একটা কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, ‘হাঁ করে কী দেখছো বলো তো!’
— কেন, তোমাকে। দারুণ লাগছে কিন্তু। এক্কেবারে হিরোইনদের মতো! মধুশ্রীর আচমকা খোঁচা আর প্রশ্ন সামলে নিয়ে বলে পুলক।
মধুশ্রীর গলায় কপট রাগ, ‘তাই বলে এভাবে রাস্তার মধ্যে হাঁ করে গিলবে ওই অসভ্য ছেলেগুলোর মতো? যেন আগে কোনওদিন দেখোনি!’
এক গাল হেসে সোজাসাপটা জবাব দেয় পুলক, ‘আরে, ওদের দেখেই তো ভালো করে দেখতে শিখলাম। এতক্ষণ তো ভালো করে দেখিইনি তোমাকে।
— দেখবে কী, সারাক্ষণ তো শুধু কালকের ম্যাচ নিয়েই ঘেনিয়ে গেলে।
— এই দেখো, দেখলেও দোষ, আবার না দেখলেও দোষ!
— না, দেখলে দোষ নেই, কিন্তু সব ওই কালকের ম্যাচের পরে। বুঝেছো?
— মানে?
— মানে আবার কী! কাল জীবনের প্রথম একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে নামছো। দুটো বড় টিমের খেলা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে তাও বুঝলাম। প্রচুর লোক হবে মাঠে সেটাও শুনলাম।
— হ্যাঁ, তো? ঠিকই তো বলেছি।
— আমি কি একবারও বললাম যে তুমি ঢপ দিচ্ছো!
— না না, তা বলোনি। তবে...
— শোনো, কালকের ম্যাচটা জেতার পরেই আমরা ভালোভাবে সেলিব্রেট করবো, বুঝলে? তখন আমাকে যত পারো মন দিয়ে দেখো, কোনও আপত্তি করবো না। আগে কালকের ম্যাচটা জিতে তো দেখাও। আর আমি চাই, কাল তোমার গোলেই মিলনী ক্লাব ম্যাচটা জিতুক। বুঝেছো চাঁদু! যদি পারো, কাল থেকেই তুমি হবে আমার হিরো নাম্বার ওয়ান। ঠিক আছে?
— সে নয় বুঝলাম। কিন্তু বাকি হিরোগুলো কারা মধু?
— সে কত আছে! শাহরুক, সলমন, রাহুল, দেব! বলেই খিলখিল করে পুলকের গায়ের ওপর ঢলে পড়ল মধুশ্রী। হাসির দমকে তার লো কাট টপের ভিতর থেকে ঈষৎ ভারী বুক উথলে উথলে উঠছিল। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে পুলক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, কাল তাকে আগে মধুশ্রীর হিরো নাম্বার ওয়ান হতেই হবে, যেভাবেই হোক। তার পর অন্য কথা!
চার
ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা বিকেল চারটেয়। তার অনেক আগে থেকেই কাঠফাটা রোদের মধ্যে দু’দলের গাদা গাদা সমর্থক হাজির হয়ে গেছে মাঠের চারধারে। জেলার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী দল, তাই যেন একটা সাজ সাজ ভাব সবার মধ্যে। শুধু ক্লাব কর্মকর্তা বা ফুটবলাররাই নয়, দু’দলের সমর্থকদের মধ্যেও শুরুর আগেই ম্যাচের তাপ যেন ছড়িয়ে পড়েছে। এদিক–ওদিক জটলায় নানারকম আলোচনা, ম্যাচকে ঘিরে বিতর্ক চলছে। দু’দলের খেলোয়াড়েরা মাঠের একধারে ড্রেস করতে শুরু করেছে। কাউকে কাউকে ডেকে শেষ মুহূর্তের জরুরি কিছু নির্দেশ, পরামর্শ দিয়ে চলেছেন দু’দলের কর্মকর্তারা। এ সব দলের সেভাবে কোনও কোচ থাকে না, যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেন কর্মকর্তা, ক্যাপ্টেন আর সিনিয়র ফুটবলাররা মিলে। কে খেলবে, কে পরিবর্ত, খেলার স্ট্র্যাটেজি কী হবে— সবই এখন ঠিক করে নেওয়ার সময়। লক্ষ্য একটাই— চ্যালেঞ্জ।
দেখতে দেখতে দুই লাইন্সম্যানকে নিয়ে মাঠে ঢুকে পড়েছেন রেফারি। ততক্ষণে মাঠের চারধারে, সাইড লাইনের পাশে, গোলপোস্টের পেছনেও সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে সমর্থক ও সাধারণ দর্সকরা। কয়েকটা লাল প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে পড়েছেন দু’দলেরই কর্মকর্তারা মাঠের দুই বিপরীত প্রান্তে। সবার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে একটা যুদ্ধং দেহি ছাপ। এবার শুধু দু’দলের সৈনিকদের মাঠে ঢোকা আর রেফারির বাঁশি বাজানোর অপেক্ষা।
অনেকক্ষণ আগেই ড্রেস করে নিয়েছে পুলক, ক্লাবের মুরুব্বি আর দলের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে শলাপরামর্শ সেরে নিচ্ছিল সে। বিপক্ষের ১১ জন এইমাত্র মাঠে ঢুকে পড়েছে। এবার তাদের পালা। কর্মকর্তাদের নির্দেশমতো শুভক্ষণ দেখে তারাও এক এক করে পর পর মাঠে ঢুকে পড়ল। পশ্চিম প্রান্তের গোলপোস্টের দিকে দৌড়ে গিয়ে বল পেটানো, গেলে শট নেওয়া শুরু করে দিল তারা। পুব প্রান্তে বিপক্ষ দলের ছেলেরাও একই কসরতে ব্যস্ত। এই সময়েই পুলকের চোখ পড়ল, মাঠের উত্তর দিকের সীমানা বরাবর চওড়া একটা নিকাশি নালার গা–লাগোয়া টানা লম্বা পুলিশ আবাসনের পাঁচিলের ওপারে পাঁচতলা একটি বাড়ির তিনতলার ব্যালকনিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে মধুশ্রী। একা। পরনে নীলরঙা প্রিন্টেড একটা ফ্রক। ওই ব্যালকনি থেকে মাঠের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। মাঠের পুরোটাই প্রায় ওখান থেকে নজরে পড়ার কথা। পুলকও দিব্যি দেখতে পারছে মধুশ্রীকে। তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। পুলকও হাত নাড়ল তাকে উদ্দেশ করে। ফ্রকটায় ওকে কেমন পরী পরী লাগছে। আশপাশে চোখ ফেলে পুলক দেখে নিল, মাঠে হাজির লোকজন কেউ এখন কোনও মেয়ে দেখছে না। সবার নজর মাঠের মধ্যে। কখন খেলা শুরু করেন রেফারি তার অপেক্ষা। পুলক কিন্তু মধুশ্রীকে দেখে আজ একটু অবাকই হল। কাল তো একবারও বলেনি যে ওর খেলা দেখবে! পুলক বেশ পুলকিতই হল মধুশ্রীকে ওখানে দেখে। তার জন্যই জীবনে এই প্রথম ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য মধুশ্রী হাজির, ব্যালকনি থেকে হলেও! এর দাম সে দিতে পারবে তো? উফ, কী টেনশন! অন্য দিকে মন ঘোরাতে দ্রুত পুলক ছুটে গেল তার পজিশনের দিকে।
ইতিমধ্যে দু’দলের ক্যাপ্টেনকে সেন্টার লাইনের কাছে ডেকে নিয়েছেন রেফারি, টসের জন্যে। টসে জিতল উদয়ন সঙ্ঘ। তারা পুব দিকটাই বেছে নেওয়ায় কাউকেই আর বেশি দৌড়োদৌড়ি করে জায়গা বদল করতে হল না। এবার যে যার পজিশন নিয়ে নিলেই ম্যাচ শুরু হয়ে যাবে। নিজের পজিশনে দাঁড়িয়ে আরেকবার পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে মধুশ্রীদের ব্যালকনির দিকে তাকাল পুলক। তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল সে। মধুশ্রী যেন রেডিই ছিল। পুলক তাকানোমাত্র তার দিকে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল মধুশ্রী। পুলকের গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম গার্ল ফ্রেন্ডের চুম্বন, হোক না উড়ন্ত— এর দাম তাকে আজ দিতেই হবে। আজ মধুশ্রীর হিরো নাম্বার ওয়ান হয়ে তাকে দেখিয়ে দিতেই হবে। মনে মনে শপথ নিল পুলক।
প্রায় তখনই জোরে বাঁশি বাজিয়ে ম্যাচ শুরু করে দিলেন রেফারি। সঙ্গে সঙ্গে গোটা মাঠের দর্শক একটু নড়েচড়ে উঠল। পায়ে পায়ে নানা প্রান্তে ঘুরতে লাগল চামড়ার গোলাটা। দুটো দলই সমানে সমানে টেক্কা দিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। আক্রমণ, প্রতি–আক্রমণের ঢেউ যেন একটার পর একটা। কিন্তু হাফ টাইম পর্যন্ত কেউই সেই গেলাটাকে বিপক্ষের জালে পাঠাতে পারল না। ফলে একটু একটু করে উত্তেজনার পারদ চড়ছে দু’পক্ষের মধ্যে, মাঠের ভিতরে, বাইরে। এর মধ্যেই বেজে গেল হাফ টাইমের বাঁশি।
মাঠে খেলার সময় পুলক ভাবনায় গোল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হাফ টাইম হতেই তার ফের মনে পড়ল মধুশ্রীর কথা। ব্যালকনিটার দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানেই আছে মধুশ্রী। এত দূর থেকে তার মুখটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পুলকের যেন মনে হল, সেই মুখে যেন রাগের চিহ্ন। খুব খেপে আছে নিশ্চয়ই পুলকের ওপর। একটা আবদার করেছিল তার কাছে, কিন্তু ৪৫ মিনিটের পরিশ্রম কোনও ফল দেয়নি। শেষ পর্যন্ত ও পারবে তো? না পারলে? ভাবতেই পুলকের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা আশঙ্কার স্রোত নেমে গেল। আশঙ্কাটা তার মগজে জেঁকে বসেছে, টের পেল সে।
হাফ টাইমে তাদের ক্লাবের ক্লাবের সেক্রেটারি দীপেনদা পুলককে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ফার্স্ট হাফটা ভালোই খেলেছিস বাবু। কিন্তু মুভমেন্টগুলো ঠিকঠাক ফিনিশ হচ্ছে না তো! সুকান্তটা বড্ড ধ্যাড়াচ্ছে আজ। ওকে না দিয়ে তুই দীপঙ্করের দিকে বল বাড়ানোর চেষ্টা করবি। ওদের লেফট ব্যাকটা একটু উইক আছে। ওই জায়গাটা একটু ব্যবহার কর বাবু। গোল চাই, গোল। উদয়নকে অন্তত একটা গোল যেভাবেই হোক, মারতেই হবে। এটুকু মাথায় রাখিস শুধু।’
দীপেনদা বলবে কী! গোল তো পুলক করতেই চায়। গোল করে অন্তত একজনের হিরো হতে চায় সে আজ। দীপেনদাকে আশ্বস্ত করে বলে সে, ‘কিচ্ছু ভাববেন না দাদা। গোল আমি করবই। এটা চ্যালেঞ্জ।’ এক গাল হেসে তার পিঠ চাপড়ে দেন দীপেনদা, ‘হুঁ, এই তো মরদের মতো কথা!’
সেকেন্ড হাফে দু’দলের সাইড চেঞ্জ হওয়ায় এবার মধুশ্রীদের ব্যালকনিটা অনেক দূরে সরে গেছে। গোল করে এই দূরত্বটা সে ঘোচাতে পারবে তো? টেনশনের টানাপোড়েনের মধ্যেই রেফারির বাঁশি বেজে উঠল। খেলা শুরু। আবার যথারীতি দুটো দলই প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা রেখে প্ল্যানমাফিক মুভমেন্টের দিকে লক্ষ্য পুলকের। তার পায়ে শিল্প আছে, সকলেই স্বীকার করে। মিলনীর সে বড় ভরসা। পুলক শুধু গোলেই কনসেনট্রেট করল তার মন আর মগজ।
দ্বিতীয়ার্ধে উদয়নের কেউ যেন পুলকের সামনে দাঁড়াতেই পারছে না! একটা অদৃশ্য শক্তি যেন ভর করেছে তার ওপর। মিনিট পঁচিশ এভাবেই গড়িয়ে গেল। আর তার পরেই পুলকরা পেয়ে গেল একটা দুর্দান্ত সুযোগ। নিজেদের বক্সের ঠিক বাইরে পুলকের গায়ে পা চালিয়ে ফাউল করল উদয়নের লেফট ব্যাক। রেফারি ফ্রি কিকের নির্দেশ দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। ফার্স্ট বারের একটু কোনাকুনি খুব ভালো একটা স্পট। দু’দলের সমর্থকরাই রীতিমতো উত্তেজিত কী হয় কী হয়! দু’পক্ষের কর্মকর্তারা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন উত্তেজনায়।
রেফারির বাঁশি এবং গো–ওও–ও–ল! উদয়নের গোলকিপারকে একেবারে বোকা বানিয়ে ডানদিকের ক্রশ বারের কোনা দিয়ে বুলেটের মতো গতিতে পুলকের শটটা আছড়ে পড়ল জালে। গোলকিপার ঝাঁপিয়ে ছিল উল্টো দিকে। গোলের বড় বাঁশিটা বাজতে না বাজতেই গোটা মিলনী সঙ্ঘ যেন বিদ্যুৎ গতিতে মাঠের ভিতরে! হইহই করে নাচানাচি শুরু হয়ে গেছে সাপোর্টারদের। রেফারি হাত দেখিয়ে তাদের মাঠের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। মিলনীর কর্তারা সকলে ছুটে এসে হাত জোড় করে সকলকে মাঠ ছেড়ে যেতে অনুরোধ করছেন। খেলা শেষ হতে এখনও বেশ কয়েক মিনিট বাকি। শেষ হলে উৎসব হবে, তাঁরা বোঝাচ্ছেন মানুষকে। অন্য শিবিরে তখন শ্মশানের নীরবতা। খেলা আবার শুরু হতে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল উদয়ন সঙ্ঘের প্লেয়াররা। কিন্তু গোল শোধ করতে পারল না, মিনিট পনেরো পর রেফারি লম্বা বাঁশি বাজিয়ে ম্যাচ শেষ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভাঙা জলের মতো আবার মাঠের ভিতরে ঢুকে পড়ল মিলনীর কয়েকশো সাপোর্টার। তারা সবাই খুঁজছে তাদের হিরো পুলককে। তাকে একবার কাঁধে তুলে মাঠের মধ্যে চক্কর দিতে চায় তারা। কর্মকর্তারাও খুঁজছেন তাকেই। কিন্তু পুলককে আশপাশে পাওয়া গেল না। সকলের আড়ালে চুপিচুপি সে কখন চলে এসেছে মাঠের ধারের সেই কোয়ার্টারগুলোর কাছাকাছি। কিন্তু মধুশ্রী তো ব্যালকনিতে নেই! কোথায় গেল? তাহলে কি পুলকের গোলটা পর্যন্ত সে আর ভরসা করে অপেক্ষা করেনি! পুলকের ভারী মনখারাপ হয়ে গেছে।
শেষ বিকেলের আলো পড়ে আসছে। চারপাশে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে। সকলের আড়ালে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে পুলক। হঠাৎ তার ডান হাতটা ধরে কে যেন জোরে টান দিল! কে?
নীল ফ্রক পরা একটা উড়ন্ত পরী ততক্ষণে তাকে বুকে জাপটে ধরেছে। মাঠের কোণের বুড়ো আমগাছটার আবছা আঁধারে তাকে টেনে নিয়ে! তার পরেই পুলক তার ঠোঁটে একটা চাপ অনুভব করল। উড়ন্ত চুমুটা এখন জীবন্ত হয়ে তার ঠোঁট জোড়ায় চেপে বসেছে। পুলকের ঘামে ভেজা জ্যাবজেবে জার্সির ওপর দিয়ে বুকে লেপ্টে বসেছে মধুশ্রীর নরম বুকের ভার। এ ভার যেন তার কাছে কোনও ভার নয়, সেরা প্রাপ্তি! পাগলের মতো পুলককে আদর করতে করতে মধুশ্রী বলে ওঠে, ‘জিও মেরি হিরো নাম্বার ওয়ান!’