বড় দুর্যোগের সময়। সারা পৃথিবী আজ বাস্তবিক রোগাক্রান্ত। কারণ একটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জীবাণু। ঠিক জীবও বলা যায় না। এমনিতে জড়, শুধু সংখ্যাবৃদ্ধির তাগিদে জীবদেহে বাসা বাঁধলেই জীবের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। বেচারা জানেও না, নিজের আরএনএ অণু একটি সজীব কোষে সঞ্চারিত করলে সেই কোষটির কী দুর্দশা হতে পারে। আবার জীবনচক্র পূর্ণ হলে নিজেরাই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সজীব কোষের আশ্রয় থেকে উৎখাত হলে সে আবার জড় বই কিছুই না।
ভাইরাস। নিজের প্রোটিন অণুটি প্রতিরূপ তৈরি করে সংখ্যা বাড়াতে থাকলে আশ্রয়দাতা প্রাণীটির যে প্রাণ সংশয় হতে পারে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। থাকবে কী করে? মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রই তো নেই। শুধু প্রকৃতির তৈরি এক অমোঘ শৃঙ্খলায় বংশবৃদ্ধির বা সংখ্যাবৃদ্ধির সহজাত তাগিদে কী বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলে নিজেরাই জানে না। সবটাই কি শুধু প্রকৃতির নিয়ম-নিগড়ে বাঁধা? জীব ও জড়ের মাঝামাঝি পলকা ঘেরাটোপে আবদ্ধ এই নিউক্লিক অ্যাসিড অণুগুলো তো এটাও জানে না, মানুষ নামে প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি খোদার ওপর খোদগারি করে তাদের কতখানি অপ্রতিরোধ্য করে স্বজাতি হননের কাজেই ব্যবহার করছে।
মামুলি হাঁচিকাশি ঠাণ্ডা লাগার জন্য দায়ী করোনা ভাইরাসের দু’ হাজার উনিশ সালের সাম্প্রতিকতম প্রতিবর্ত (mutated) সংস্করণ কোভিড-১৯ দু’ হাজার বিশ সালটিকে বিষময় করে তুলেছে। আগেই বলেছি, দোষটা এই অবোধ অদৃশ্য জীবগুলির নয়, মানুষের। উ্ৎস চীনের উহান শহর, বিস্তার চীনের অন্যান্য শহরগুলিকে পাশ কাটিয়ে সারা বিশ্বময়। হিসাব খুব সহজ। কম্পিউটারেও ভাইরাস হয় জানেন সবাই। ভাইরাস যার তৈরি, ভ্যাকসিনও তার কাছেই উপলভ্য। একটি বাণিজ্যচক্র। এখানেও তাই। বরং আরও বেশি। জীবাণুযুদ্ধে সারা বিশ্বের জনসংখ্যা থেকে আর্থনীতিকে পঙ্গু করে এই গ্রহের অধীশ্বর হওয়ার সাম্রাজ্যবাদী উন্মাদনা। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু বোমা ফেলে জাপানের দুটি শহরের আপামর শিশু-নারী-পুরুষ নিশ্চিহ্ন করে দেয়, প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য রোপন করে পঙ্গুত্বের বীজ। আর আজ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দী সেই সাম্রাজ্যবাদী নিষ্ঠুর খেলাটাই খেলল একটু ভিন্নতর প্রহরণে; কিন্তু নিশানা করে নিল শুধু যুযুধান রাষ্ট্রকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে।
তবে সৃষ্টিছাড়া ব্যতিক্রম দেখাল একটি সম্প্রদায় ও চীনের ভাবশিষ্যরা, এবং তা এই ভারতবর্ষেই। সারা বিশ্ববাসী যখন এই মারণ ভাইরাস থেকে বাঁচার পথ খুঁজছে, সেখানে একদল ধর্মান্ধ ব্যক্তি নিজেদের মানবতা বিরোধী বিকৃত ধর্মীয় দর্শনের বশবর্তী হয়ে মারণ রোগকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে; আর তার জন্য নিজেদের দেহকেও রেহাই দিচ্ছে না, বরং দেহকেই অস্ত্রাগার করে তুলছে, আত্মঘাতী বোমারুর মতো। সরকারি নির্দেশ অমান্য করে ক্রমাগত ধর্মীয় ও তার আবডালে রাজনৈতিক জমায়েত করা থেকে চিকিৎসায় অসহযোগিতা, চরম অসভ্যতা তথা নোংরামির যে অভূতপূর্ব নজির তারা তুলে ধরেছে, আমাদের পোড়া দেশে সে সবের সমর্থকও বা সেসব আড়াল করে সরকারি উদ্যোগকে কামিলালিপ্ত করার মতো নেতিবাচক অপদার্থেরও অভাব নেই। যারা নিজেদের অসুখ সারানোর বদলে চূড়ান্ত অশ্লীলতা ইতরোমো করে রোগের সংক্রমণ অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়, তাদের চিকিৎসা করা ও তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মান ও জীবন বিপন্ন করা যে মানবিকতা নয় অধর্ম, তা উপলব্ধি করলেও পালন করার উপায় আমাদের সুযোগসন্ধানী ব্যালট গণতন্ত্র দিচ্ছে না।
ভারত সরকার বিপদের আঁচ পাওয়ার পর যথাসম্ভব তৎপরতায় করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর থাবা থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, দেশের প্রতিটি জনগণ ও বিরোধী দলগুলো তাতে সহযোগিতা করলে, বা অন্তত ব্যাগড়া না দিলে ভারতবর্ষ পৃথিবীর কাছে একটা সদর্থক উদাহরণ হয়ে থাকতে পারত। যা কিছু অসুবিধা, সদিচ্ছা থাকলে তা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করাই যেত। কিন্তু মহামারীর বিরুদ্ধে জেতা ম্যাচ আমারা হেরে গেলাম স্বদেশবাসীরই অন্তর্ঘাতে। ফলত কোভিড-৭৮৬ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সৌজন্যে লকডাউনের ঘোষিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও বিপদ কাটছে ভাবার মতো আশাবাদী হওয়ার উপায় নেই। মাঝখান থেকে প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবন জীবিকা ত্রাণের ওপর ভেসে আছে; অর্থনীতি ডুবে যাচ্ছে, তালা খোলা না হলে যা রসাতলে চলে যাবে।
তবে সবকিছুরই একটা জীবনচক্র আছে। স্বাভাবিক হোক বা যড়যন্ত্র, মহামারীরও সময়সীমা আছে। ভাইরাস তো চীন, পাকিস্তান, আইসিস, জামাত বা নকশাল নয়; কালের নিয়মে ঠিকই বিদায় নেবে। সেই আশাবাদ সঙ্গে নিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪২৭-এর শুভক্ষণে শুরু হোক ঋতম আন্তর্জালক বন্দরের সাহিত্য বিভাগ “কাব্য ও কথা-বার্তা”র পথ চলা।
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়