অপরাজেয় প্রতিজ্ঞার শেষ যাত্রা

স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর দেহ কাঁধে করে শ্মশানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “যতীন হলো এযুগের দধীচী… অত্যাচারী ইংরেজ সরকারকে পরাজিত করবার জন্য নিজের অস্থি দিয়ে গেলো।”

আটজন বেশ মোটাসোটা পালোয়ান লোককে সঙ্গে নিয়ে, জেল সুপার, ডাক্তার, জেলের সেলে মধ্যে ঢুকলেন। কিছু বুঝতে না বুঝতেই ওই আটজন লোক, সাতদিন ধরে না খাওয়া দুর্বল মানুষটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল |

দুজন দুটি হাত, দুজন দুটি পা এবং দুজন পুরো শরীরটা চেপে ধরল। এছাড়াও একজন মাথা ও অন্যজন চিবুক ধরে জোড় করে হা করাল। সেই সুযোগে ডাক্তার একটি সরু নল দিয়ে দুধ ঢালতে শুরু করলেন। আর কোনো উপায় না দেখে ওই মহান মানুষটি তাঁর আমরন অনশনকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে জোরে জোরে কাশতে থাকলেন, এটা ভেবে যে, যদি কোনোভাবে ওই দুধ ভর্তি নলটি খাদ্যনালী থেকে সরে গিয়ে শ্বাসনালীতে চলে যায় , তারফলে কিছুটা দুধ ফুসফুসে চলে গেলে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, যেমন ভাবা তেমন কাজ, আরও জোরে জোরে কাশতে থাকলেন, ফলে কিছুটা দুধ ফুসফুসে ঢুকেও গেল, এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ফলে তাঁর আমরন অনশন বজায় থাকল।

৪৮ ঘন্টা ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর, মানুষটির জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলতেই তিনি লক্ষ করলেন-

তাঁকে প্রলুব্ধ করার জন্য তাঁর সেলে নানা ধরনের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকে নলটি জোড়পুর্বক খাদ্যনালী থেকে শ্বাসনালীতে ঢুকে যাওয়ায় তাঁর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না |তিনি বুঝতে পারলেন সারাজীবন তিনি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না।

স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর পাশে রাখা রয়েছে একটি শ্লেট আর পেনসিল | জেল সুপার বললেন,

— আপনার কি খেতে ইচ্ছা করছে ওই শ্লেটে লিখে দিন। আপনার যা ইচ্ছা তাই খেতে পারেন।

যে মানুষটি ছোটোবেলা থেকে খাদ্যরসিক ছিলেন, পকেটে পয়সা থাকলেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে খেতে যেতেন, সেই মানুষটিই নয় দিন অভুক্ত থেকেও তাঁর সামনে পরে থাকা তার পছন্দের খাবারগুলির দিকে তাকিয়ে শুধু একবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন। কোনো কিছুই মুখে তোলেননি |

জেল সুপার তার ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন, তাকে কিছু বুঝিয়ে-সুজিয়ে খাওয়ানোর জন্যে। কিন্তু তাঁর অদম্য জেদ, তাঁর ইচ্ছা শক্তি, আর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কাছে সবাই হার মানল। এইভাবেই চলতে থাকল তাঁর আমৃত্যু অনশন |

আস্তে আস্তে তাঁ শরীর সবদিক থেকে ভেঙে পরছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন, একটু একটু করে পক্ষাঘাত তাঁর শরীরকে গ্রাস করে ফেলছে। যেদিন ওই পক্ষাঘাত হৃদযন্ত্র স্পর্শ করবে সেদিন তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। ভয় পেয়ে জেলার তাঁকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে রাজী হয় কিন্ত বেঁকে বসেন পাঞ্জাবের গভর্নর মোরেন্সী।

পরের দিন জেল সুপার, ডাক্তার ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে তার সেলে ঢুকলেন। তখন তাঁকে ঘিরে ব্যারিকেড করে শুয়ে রয়েছেন তাঁর সহযোদ্ধারা। ডাক্তার বললেন- “কোনো ভাবেই উনাকে উত্তেজিত করা যাবেনা, তাহলেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাবে।” তাই জেল সুপার আর কোনো চেষ্টাই করেন নি।

পরের সাতদিন গোটা ভারতবর্ষের মানুষ দারুন উদবেগ ও উৎকন্ঠায় দিন কাটাতে থাকলেন। অবশেষে এলো সেই ভয়ংকর দিনটা- ১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর | শনিবার | ঠিক দুপুর ১টা ০৫ মিনিটে অমর বিপ্লবী যতীন দাস ৬৩ দিন অনশনের পর লাহোর জেলে মাত্র ২৪ বছর বয়সে চির নিদ্রায় ঢলে পড়লেন।

১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯। লাহোর বোস্টাল জেলের ভেতরে ডাক্তার আর অফিসারদের ভিড়। স্তব্ধ হয়ে এসে দাড়ালেন বন্ধুরা – বিজয় কুমার সিংহ, জিতেন্দ্র নাথ সান্নাল ও অজয় ঘোষ। সূর্য একটু একটু করে উঠছে। ১৩ জুলাই থেকে ইংরেজ বিরোধী যে বিস্ময়কর অনশনের শুরু ১৩ সেপ্টেম্বর ৬৩ দিনের মাথায় বেলা ১:০৫ মিনিটে হ’লো তার চির সমাপ্তি।

রক্ত গোলাপের স্তুপে ঢেকে দেওয়া হল যতীন্দ্রনাথ দাসের নশ্বর দেহ। রাজবন্দীরাই বহন করে নিয়ে গেলেন জেল গেট পর্যন্ত। বাইরে পাঞ্জবের নেতৃবৃন্দ অপেক্ষা করছেন সাথে বিপুল জনতা। প্রতিটি মানুষের চোখে জল, শহীদের অপরাজিত আত্মাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। বিকেল চারটেয় শহীদের দেহকে বহন করে এক অভূতপূর্ব শোভাযাত্রা শহরের পথে অগ্রসর হ’লো। প্রায় এক লাখ লোকের বিশাল শোক মিছিল যা প্রায় এক মাইল লম্বা।

যতীন দাসের দেহ নিয়ে ’লাহোর এক্সপ্রেস’ বিকেলে দিল্লি পৌছলে দিল্লি শহর ভেঙে পড়লো স্টেশানে। ফুল আর ফুলের মালা দিয়ে আগত অগনিত মানুষের মুখে ধ্বনিত হল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ .. ‘যতীন দাস জিন্দাবাদ’। দিল্লি থেকে রাত্রি আড়াইটের ট্রেন কানপুরে পৌছলে বিপুল জনতার সাথে বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ’রা যতীন দাসের দেহের সামনে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।

শোকে স্তব্ধ হয়ে ছিল কলকাতা। দক্ষিণ কলকাতার সমস্ত দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত। ছাত্ররা কালো পতাকা হাতে দলে দলে মিছিলে বেড়িয়ে পড়লো। সমস্ত বাংলা জুড়ে মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ল। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমস্ত কর্মসূচি বাতিল করে কলকাতায় দ্রুত ফিরে এসেই বি.পি.সি.সি.-র সভাপতি হিসেবে ১৫ সেপ্টেম্বরকে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য ডাক দিলেন।

শহীদ যতীন দাসের দেহ এলো বাংলায়। হাওড়া স্টেশানের অবস্থা তখন আরোও উত্তাল। দুর্বার জনস্রোত প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে নিচের ইয়ার্ডে ছড়িয়ে গেছে। স্টেশানে তিল ধারনের জায়গা কোথাও ছিল না। শুধুমাত্র একটুখানি ঘেরা জায়গায় (স্বেচ্ছা সেবকদের দ্বারা ঘেরা) খালি পায়ে অপেক্ষা করছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী, নেলী সেনগুপ্তা, প্রমূখ বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ। প্রথমে তাঁর দেহ টাউন হলে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পিতা বঙ্কিমবিহারী দাস বলেছিলেন, “আমার সন্তানের জন্য আমি গর্বিত। আমি আজ সবচেয়ে ভাগ্যবান পিতা।”

সুভাষচন্দ্র বসু নিজের কাঁধে তুলে নিলেন খাটের একদিক। শহীদ যতীন দাসের শবদেহ বহন করে যে বিরাট জনতার শোকযাত্রা কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, একমাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের শবদেহ বহনের সময়েই এরূপ জনসমাগম ঘটেছিল। সরকারী রিপোর্ট অনুসারে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক সমবেত হয়েছিল। শোকযাত্রার সামনে মহিলা ও বালিকাদের দল গাইতে গাইতে চলেছিল, ‘রক্তে আমার লেগেছে যে আজ সর্বনাশের নেশা …’

শ্মশানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিশিষ্ঠ নেতৃবর্গ। নতুন করে আবার ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়া হল তাঁর দেহ। শঙ্খধ্বনি ও বিউগলের সঙ্গীত বেজে উঠলো। নতজানু হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু শহীদ যতীনদাসের পদধূলি নিয়ে নিজের কপালে লেপন করলেন, বীরের আত্মত্যাগ ও প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তাকে তিনি গ্রহণ করলেন। চন্দনকাঠের চিতা ওপর যখন তাঁর দেহ তোলা হল, তখন পিতা বঙ্কিম বিহারী দাসের বানী পাঠ করলেন শ্রীহেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত –
”ওঁ নারায়ণ! যে বিশ্বাসঘাতকতায় মগ্ন হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, তারই প্রায়চিত্ত স্বরূপ আমি আমার আদরের পুত্রকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। অশ্রুজল ভিজিয়ে আমার খেঁদুকে তোমার পায়ে সমর্পণ করলাম। তার এই আত্মবিনাশের মধ্য দিয়ে সমগ্র ভারত যেন জেগে ওঠে।”

আসল নাম – শ্রী যতীন্দ্রনাথ দাস, লোকমুখে যতীন দাস
পিতা – শ্রী বঙ্কিম বিহারী দাস,
মাতা – শ্রীমতী সুহাসিনী দেবী
জন্ম – ২৭ অক্টোবর ১৯০৪,
ডাক নাম – খেঁদু (বাবা ডাকতেন),
বীরগতিপ্রাপ্ত – ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৯।

সূত্র: @মৃত্যুঞ্জয়ী যতীন দাস: লোকেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত (মধ্যে – অগ্নিযুগ – সম্পাদনা শৈলেশ দে),
@শহীদ যতীনদাস: শ্রী রণজিত রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.