পরিবেশ সচেতনতার বহুমুখী বিস্তারণ আজ সংবেদী মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে বেশ নাড়া দিয়েছে। ৫ ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে যে সুরে পরিবেশ কর্মীরা গান বেঁধেছে, ২৬ শে জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবসে ক্রমক্ষীয়মান ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের কান্না থামানোর চেষ্টায় সেই গান প্রবোধ দিয়েছে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলকে আশ্রয় করে থাকা জীবকূলকেও। তারাও আজ বলছে, ‘আমরা বাঁচতে চাই।’ পৃথিবী থেকে বাদাবন আমরা তাই বিনাশ হতে দিতে পারি না। সুন্দরবনের সুন্দরীবৃক্ষের মতো পৃথিবীর প্রাকৃতিক হেরিটেজ রক্ষা করবোই, তারই শপথ নেবার দিন ২৬ শে জুলাই৷ তারই কর্মময় পরিকল্পনা রচনার দিন এবং মাঠে নেমে বর্ষা-কজ্জল দিনে ‘ওয়ার্ল্ড ম্যানগ্রোভ ডে’র নামে লবণাম্বু উদ্ভিদের চারা জোয়ার-ভাটায় সম্পৃক্ত কর্দমাক্ত নদীকূলের নোনামাটিতে লাগানোর মরশুম।

পৃথিবীতে যত বিচিত্র মাটি আছে, তার মধ্যে ‘সোঁদরবন’-এর নোনামাটি অন্যতম। এ অরণ্যের স্থানীয় নাম ‘বাদাবন’, ভদ্রজনের ভাষায় ‘সুন্দরবন’। সেই বনেরই সুন্দরী গাছ; অথবা গরাণ, বীণা, গড়িয়া গাছ — লবণাম্বু উদ্ভিদের নানান বৈচিত্র্য। একসময় এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘গঙ্গারিডি’। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটায় পরিপুষ্ট। নদীর মাধ্যমেই এর নোনাভাব। বাষ্পীভবনের সঙ্গে সঙ্গে লবণ মিশ্রিত কৌশিক জল স্বাভাবিক টানে মাটির উপর আসে, তারপর প্রখর সৌরতাপে শুকিয়ে সাদা লবণের আস্তরণ পায়। চারদিক নোনায় নোনায় চকচক করে উঠে ভূগোল। যেন রোদ ঝলমলে রূপোর দেশ! যেন আলোয় আলোয় চোখ যাবে ঝলসে! সেই কবে মেগাস্থিনিস, পেরিপ্লাস প্রমুখ পরিব্রাজকের দল এসেছিল ভারতবর্ষে, তার কথাই অনুভূতিতে আসে! সেই অরণ্যঘেরা চন্দ্রদ্বীপবন। সেই চন্দ্রবন। তাই-ই কালক্রমে সুন্দরবন। বাঙালির বহির্বাণিজ্যের শেষ দরজা। মধ্যযুগে সেই বাণিজ্যে প্রথম আঘাত পেল আরবসাগরের জলদস্যুদের দ্বারা। জলে থেকে তো কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা চলে না! তখন বণিকেরা পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্য গুটিয়ে পূর্বের সঙ্গে বাণিজ্য খোলা রাখলো। কিন্তু সে সুখও সইলো না। মধ্যযুগে ষোড়শ শতকে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের পর্তুগীজ আর মগদস্যুদের পীড়নে বাঙালি বণিকেরা পিছু হটল বাণিজ্য থেকে। সুন্দরবনের নাম হলো ‘মগের মুল্লুক’। দস্যুতায়, লুঠপাটের কুখ্যাতিতে সুন্দরবনের সমৃদ্ধি কোথায় হারিয়ে গেলো! ঘন অরণ্যে হারিয়ে গেল সাবেক জনপদ, নগর-গ্রাম-লোকালয়। নোনতা মাটিতে হ্যালোফাইট সবেগে উঠলো জেগে। বন উত্তরে এগিয়ে আসছে তো আসছেই! সোঁদরবনের পরশ লাগলো কলকাতাতেও। সেই লবণাক্ত গড়িয়া গাছে ভরা এলাকাই তো আজকের গড়িয়া। এমনই বনে ঘেঁষা, বনের উপান্তে কলিকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুরের সমৃদ্ধ লোকালয়ে ১৬৬০ সালে বাণিজ্যের ঘাঁটি নতুন করে গাড়লেন জব চার্ণক৷ এক নতুন লুণ্ঠনের গল্প।

২৬ শে জুলাই হচ্ছে Day of the Conservation of the mangrove ecosystem (ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ দিবস) অর্থাৎ World Mangrove Day (বিশ্ব লবণাম্বু উদ্ভিদ দিবস). এই দিনটি পালিত হচ্ছে INESCO-র উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে, অর্থাৎ এটি অষ্টম বছরে পদর্পণ। ২০১৫ সালের ৬ ই নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৩৮ তম অধিবেশনে দিনটি পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাবক দেশটি হচ্ছে ইকুয়েডর। দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে —
১. একটি অনন্য, বিশিষ্ট, এবং ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র হিসাবে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে চেতনা বৃদ্ধি করা।
২. বিশ্বব্যাপী ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম রক্ষার জন্য তা সংহতভাবে ব্যবহার করার জন্য চিরায়ত ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া।
ম্যানগ্রোভ অরণ্য থেকে বাঁচবার বহু সামগ্রী আসে। অরণ্য আমাদের রক্ষাও করে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, সুনামি, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে এই অরণ্য আমাদের মায়ের মতো রক্ষা করে। আর রক্ষা করে প্রবালদ্বীপ, সমুদ্রঘাসের কেয়ারি, এবং জাহাজ চলাচলের লেন বা পথ যা পলি পড়ে এবং ভূমিক্ষয়ে বুজে যাওয়ারই কথা ছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আটকায় এই অরণ্য। বহু জৈববৈচিত্র্য টিকে আছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আশ্রয়ে। এই অরণ্য কত যে দেশীয় পাখি, কত পরিযায়ী পাখি, সরীসৃপ, মাছ, উভচর ইত্যাদি প্রাণির সংরক্ষণ, আমরা ভাবতেই পারি না। ম্যানগ্রোভ শেষ হয়ে গেলে, এরা কোথায় যাবে? বিশ্ব আজ উষ্ণবাসরে পরিণত হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তো ম্যানগ্রোভের অরণ্য নতুন করে সৃজন করা দরকার। এত অধিক মাত্রায় নির্গত কার্বন শোষণ করবে কে! আজ তাই প্রতি বর্ষায় সাধ্যমতো নোনাজলের নদী, খাল, খাঁড়ি, মোহনায় লবণাম্বু উদ্ভিদের চারা লবণাক্ত মাটির কেয়ারিতে তৈরি করিয়ে রোপণ করা দরকার। জলাজঙ্গলের লোকায়তিক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে এই অরণ্য আবারও তৈরি হোক। বনকাটার পূর্ববর্তী প্রজন্মের পাপ যেন আমাদেরই ক্ষয় করতে হবে হ্যালোফাইটের গাছ লাগিয়ে।

সুন্দরবন বাঁচানো, তার পরিধি বিস্তার সবচেয়ে আগে করতে হবে। প্রতিবছরই ঝড়োহাওয়া থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচায় সুন্দরবন। নদীবাঁধ ভেঙ্গে যায়। বাঁধ ভাঙ্গলে নোনাজল জমিতে প্রবেশ করে চাষের দফারফা করে। তাই নদীবাঁধ বাঁচাতে নদীর পাড়ের ম্যানগ্রোভ গাছের ফালি রচনা করিয়ে দিতে হবে। রাজ্যের সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নজর পড়ুক বাদাবন রক্ষার জন্য। সমস্যাটা সবাই বুঝলে, সমাধান সম্ভব জানলে, সুন্দরবন বাঁচানো যাবে৷

তথ্যসূত্র
১. বাদাবনের নোনামাটি আর নোনা সংস্কৃতি, মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কল্যাণ চক্রবর্তী (২০১৪), ‘কৃষি ও লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থের অন্তর্গত, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৪৯-৫৩
২. সুন্দরবনের ফার্ণ বৈচিত্র্য ও লোকায়ত ইতিহাস, মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০২৪ (তৃতীয় সংস্করণ), ‘বাংলার জৈববৈচিত্র্য ও লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থের অন্তর্গত, কবিতিকা, মেদিনীপুর, পৃষ্ঠা১৩৪-১৩৮

রুমন সাহা এবং কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.