অনন্ত সিংহ বা অনন্ত লাল সিংহ (জন্ম ১২ই ডিসেম্বর, ১৯০৩ – মৃত্যু ২৫শে জানুয়ারি, ১৯৭৯), চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের অন্যতম নায়ক এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিবিদ ছিলেন।
১৯০৩ সালের, ১লা ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ ভারতের আগ্রা অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। অনন্ত সিংহ-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সূর্য সেনের (মাষ্টারদা) সংস্পর্শে আসেন। অনন্ত সিংহ ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। সূর্য সেন তার অসাধারণ সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, কর্মোদ্যোগ দেখে মুগ্ধ হন। অচিরেই তিনি সূর্য সেনের একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন সহকর্মীর পদমর্যাদা লাভ করেন।
১৯২১ সালে তারই উদ্যোগে তার স্কুলের ছেলেরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য সচেষ্ট হন। একবার বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দ্যেশ্যে আসাম-বাংলা রেলওয়ে কোম্পানীর অর্থ লুঠ করার সময় তিনি ও তার সঙ্গীরা পুলিসকে পরাভুত করে পাহাড়ে পালিয়ে যান। ১৯২৪ সালে বিপ্লবী কাজকর্মের জন্যস গ্রেপ্তার হয়ে চার বছর কারাগারে থাকেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ব্যয়ামাগার স্থাপন করে বিপ্লবী সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য ও তরুণদের দলে আনার জন্য সচেষ্ট হন। তার এই অক্লান্ত পরিশ্রম, সংগঠননৈপুণ্য ও পরিকল্পনা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকে অনেকাংশে সফল করে তোলে। ঐ সময় চট্টগ্রাম শহর চারদিনের জন্য বৃটিশশাসনমুক্ত ছিল।ফেনী স্টেশনে ধরা পড়ার উপক্রম হলে অনন্ত সিংহ সাহসিকতার সাথে দুই হাতে গুলি চালিয়ে পুলিশ বাহিনীকে একাকী ছত্রভঙ্গ করেন ও কয়েকজন সহকর্মী সহ সেখান থেকে পালিয়ে এসে ফরাসী অধিকৃত চন্দননগরে আশ্রয় নেন। তার অন্যান্য সহকর্মীদের বিচার ও জেলে নির্যাতনের সংবাদে বিচলিত হয়ে কলিকাতা পুলিশ কমিশনারের কাছে এসে আত্মসমর্থন করেন। তিনি জেলের ভিতর সুড়ঙ্গ তৈরি করে বিস্ফোরক দিয়ে জেল উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, যদিও ডিনামাইট পাতার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। এই ঘটনার ফলে সরকার ভীত হয়ে বিপ্লবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। অনেকের মতেই এই আলোচনার ফলেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় কারও ফাঁসি হয়নি। বিচারে অনন্ত সিং-এর এবং অন্য এগারজনের দ্বীপান্তর হয়। ১৯৩২ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী প্রমুখের চেষ্টায় বন্দীদের আন্দামান থেকে স্বদেশে ফিরিয়া আনা হয়। অনন্ত সিংহ ১৯৪৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। উল্লেখ্য, তার বিপ্লবী কর্মকান্ডে সহায়তা করার জন্য তার জ্যেষ্ঠা ভগিনী ইন্দুমতী সিংহও জেল খেটেছেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ মামলায় অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, লালমোহন সেন, সুবোধ চৌধুরী, ফণিভূষণ নন্দী, আনন্দ গুপ্ত, ফকির সেন, সহায়রাম দাস, বনবীর দাসগুপ্ত, সুবোধ রায় (ঝুংকু) এবং সুখেন্দু দস্তিদারের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়।
জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি মার্কসবাদী দর্শন পাঠ করে তার দিকে আকৃষ্ট হন ও বাইরে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কিছুদিন তিনি চলচ্চিত্র ও মোটর গাড়ির ব্যবসা করে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন। তার প্রযোজিত অন্যতম চলচ্চিত্র যমালয়ে জীবন্ত মানুষ।
অনন্ত সিং তার জীবনের বহুমূখী অভিজ্ঞতা দিয়ে যেসব গ্রন্থ রচনা করেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ (দুই খন্ড), অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম (দুই খন্ড), মাস্টারদা, স্বপ্ন ও সাধনা, আমি সেই মেয়ে, কেউ বলে ডাকাত কেউ বলে বিপ্লবী প্রভৃতি।
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি অনন্ত সিংহ মৃত্যুবরণ করেন।