ভোররাতের হানায় ভারতীয় বায়ুসেনা গুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরস্থ জঙ্গি ঘাঁটিগুলি। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসী ভারতীয় বায়ুসেনা ও মোদী সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এতদিনকার রক্ষণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি ছেড়ে মঙ্গলবারের ঊষালগ্নে ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত পেরোনোর প্রয়োজনীয় কাজটি করলো। সারা বিশ্ব বুঝে গিয়েছে একতরফা মার খাওয়ার যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে দুষ্টের দমনের যুগে প্রবেশ করলো ভারত। তবুও কারও কারও মনে প্রশ্ন উদিত হতে পারে যে পুলওয়ামার মতো বড়ো আক্রমণ না হলেও পাকিস্তান তো বরাবরই ভারতের ওপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে একবার সার্জিকাল স্ট্রাইক ছাড়া ভারত সরকার গত পাঁচ বছরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর কোনও বড়ো পদক্ষেপ করলো না কেন?
উত্তরে বলা যায়, নতুন পররাষ্ট্রনীতির প্রজ্বলিত প্রদীপ আজ সকলের চক্ষুগোচর হচ্ছে কিন্তু প্রদীপের সলতে পাকানো হয়েছে গত পাঁচ বছর ধরেই। তবে রণদামামার বজ্রঘোষে নয়, সলতে পাকানোর কাজটি হয়েছিল অর্থনীতি ও কুটনীতির নীরব মঞ্চে।
পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে আন্তর্জাতিক আর্থ-কুটনৈতিক রণক্ষেত্রে ভারত সরকার গত পাঁচ বছর কী কী পদক্ষেপ করেছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রায় পাঁচ বছর আগে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসার কিছু মাস পরেই ২০১৪ সালের শেষ দিকে ইরানে চাবাহার বন্দর তৈরি শুরু করে এবং ২০১৭ সালের নভেম্বরে চাবাহার বন্দর চালু হয় ভারতের নিয়ন্ত্রণে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রোজেক্ট ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকার অনুমোদন করেন, তারপর এগারো বছর ধরে কিছুই হয়নি, সৌজন্যে কংগ্রেস।
তার আগে পর্যন্ত সমুদ্রোপকূলবিহীন চারিদিক থেকে স্থলভূমিবেষ্টিত দেশ আফগানিস্তানের সমস্ত আন্তর্জাতিক ব্যবসা পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে হতো। পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানিস্তানে পৌঁছাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। করাচি বন্দর ছিল বহির্জগতের সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম আর তাই পাকিস্তানের একক নিয়ন্ত্রণে ছিল আফগানিস্তানের ব্যবসা। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয় একচেটিয়া অধিকার বা মেনোপলি। এই মোনোপলির মূল্য আফগানিস্তানকে চোকাতে হতো কড়ায় গণ্ডায়, চড়া হারে, নিজেদের অর্থনীতির শোষণ ও পাকিস্তানের অর্থনীতির সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে। এক কথায় পাকিস্তানের কাছে আফগানিস্তান ছিল সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
তুলনায় বেশি পরিবহণ খরচসাপেক্ষ হলেও চাবাহার বন্দর একটা বিকল্প পথ খুলে দিল আফগানিস্তানের সামনে, আর করাচির বদলে চাবাহার ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের লাইফ লাইন হয়ে উঠলো। ঘোরি থেকে আবদালি যুগে যুগে ভারতবিদ্বেষী লুটেরাদের জন্মদাতা আফগানিস্তান তাই আজ ভারতের বন্ধুদেশ।
২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ব্যবসা ছিল ২৭০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থাৎ প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকার। অর্থনৈতিক মহলের আন্দাজ ছিল আগামী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে এটা ৫০০ কোটি ডলারে অর্থাৎ প্রায় ছত্রিশ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে। কিন্তু ২০১৮ ক্যালেন্ডার বর্ষে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের ব্যবসা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলারে অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার ছশো কোটি টাকায়। অর্থাৎ যা আশা করেছিল তার মাত্র দশভাগের একভাগ। স্বাভাবিকভাবেই বাকি বাণিজ্য হচ্ছে চাবাহারের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে। এতে সমৃদ্ধ হচ্ছে ভারতের অর্থনীতি, ক্ষতি হচ্ছে পাকিস্তানের। এছাড়াও আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ভারতের পাঁচটি শহর (দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, অমৃতসর, কলকাতা) থেকে ওই দেশের পাঁচটি শহরের সরাসরি এয়ার কার্গো সার্ভিস শুরু হয়েছে গত পাঁচ বছরে। আফগানিস্তানের অসুস্থ মানুষেরা এর আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের পেশোয়ারে চিকিৎসার জন্য যেতেন, এখন তাদের গন্তব্য বদলে গেছে।
পুলওয়ামার ঘটনার পরে ভারত পাকিস্তানকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে ভারতে হওয়া পাকিস্তানের যাবতীয় রপ্তানি উচ্চ শুল্কের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তান থেকে ভারতে বছরে ৫২ কোটি ডলারের বা ৩৮০০ কোটি টাকার রপ্তানি হয়ে থাকে। এছাড়াও উচ্চ শুল্ক হারের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে খাদ্যদ্রব্যসমূহ ভারত থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হতো সেগুলির দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে পাকিস্তান থেকে ভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য আমদানি হয় না। ফলে বাণিজ্য বন্ধের কারণে ভারত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়নি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যেখানে পাকিস্তানের জিডিপি বছরে ২৭৭৭২০ কোটি ডলার (২০১৭-১৮), সেখানে আফগানিস্তানের সঙ্গে ৫০০ কোটি ডলারের ব্যবসা (জিডিপির ১.৮ শতাংশ) মার খেলে আর পাকিস্তানের বছরে ২৪৮২.৪ কোটি ডলারের মোট রপ্তানি থেকে ভারতে হওয়া ৫২ কোটি ডলারের রপ্তানি (মোট রপ্তানির ২ শতাংশ) বন্ধ হলে পাকিস্তানের ক্ষতি হলেও নিশ্চয়ই পতন হবে না। এখানেই স্বাভাবিক অর্থনীতি এবং যুদ্ধকালীন অর্থনীতির পার্থক্য। আফগানিস্তান যেমন সমুদ্রে যাবার জন্য পাকিস্তানের বা চাবাহারের ওপর নির্ভরশীল সেরকমই পাকিস্তানও পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাবার ব্যাপারে আফগানিস্তানের ওপরে নির্ভরশীল। স্বাভাবিক সময়ে বাণিজ্যের কারণে স্থলপথের খুব একটা প্রয়োজন না হলেও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে (দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হলে) রসদ আনার জন্য এই স্থলপথ খুবই প্রয়োজনীয়। আজকের ভারতবন্ধু আফগানিস্তান এই স্থলপথ পাকিস্তানকে ব্যবহার তো করতে দেবেই না, বরং প্রয়োজনে পাকিস্তানের পশ্চিমদিকে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার ব্যাপারে ভারতকে নিজের দেশের জমি ব্যবহার করতে দেবে। চিকিৎসা ও বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারে আগেকার মতো পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল থাকলে যা আফগানিস্তান করতে পারতো না, বরং পাকিস্তানকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকতো। এছাড়াও যুদ্ধের সময় রসদ হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বর্তমানে সে বাবদে পাকিস্তানকে বেশি খরচ তো করতে হবেই এছাড়াও বর্তমানে পাকিস্তান সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ না হওয়ায় ভারত কোনও পূর্বঘোষণা ছাড়াই পাকিস্তানে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যর রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধও করে দিতে পারে।
এখন মনে হতে পারে যে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে পাকিস্তানকে বাদ দেওয়া এতদিন পরে হলো কেন? আরও আগেই তো একাজ করা যেত? উত্তরে বলা যায় কোনও দেশকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে কোনও কারণ দর্শাতে হয়। পুলওয়ামার ঘটনা গোটা বিশ্বের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে কেন পাকিস্তানকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।
এছাড়া, যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার বহু আগে যদি ভারত পাকিস্তানকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে বাদ দিত তাহলে ইতিমধ্যে পাকিস্তান নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যজনিত সমস্যার অন্য কোনও বিকল্প সমাধান (অপেক্ষাকৃত বেশি খরচসাপেক্ষ হলেও) করে ফেলতো। তাই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঠিক আগে পাকিস্তানকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাকে সাময়িক ভাবে সম্পূর্ণ অসহায় করে ফেলেছে ভারত।
অর্থনীতি এবং কুটনীতির আবিষ্কর্তা চাণক্য বা কৌটিল্যর একটি কথা আছে— ‘যুদ্ধ রণক্ষেত্রে হওয়ার বহু আগে রাজার চিন্তাক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত হবে।’ বর্তমান সরকার এই আপ্তবাক্যটি স্মরণে রেখে গোলা বারদের যুদ্ধ শুর বহু আগেই যে আর্থ-কুটনীতির যুদ্ধ শুরু করেছেন তা দেশবাসীকে নিশ্চিন্ত করবে।
অম্লানকুসুম ঘোষ