ক্ষিতি জল পাবক গগন সমীর
পঞ্চ রচিত অতি অধম শরীর।
।”

বিজ্ঞান হোক কিংবা শাস্ত্র, উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দেখি পরিবেশের অন্যতম গঠনগত উপাদান জল। জলেই প্রথম জীবনের উৎপত্তি ঘটেছিল আর তাই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কোনো স্থানে প্রাণের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে সর্বপ্রথম লক্ষনীয় হয় জলের উপস্থিতি। আমরা সকলেই জানি যে পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ স্থান জুড়ে রয়েছে জলাভূমি, আবার মানবদেহের ও প্রায় ৭০ শতাংশ জল দ্বারাই নির্মিত। জল কে শুধুমাত্র গঠনগত নয়,পরিবেশ এবং মানবজীবনের কার্যগত একক বললেও ভুল হয় না। কঠিন হিমশৈল থেকে উৎপত্তি, জলরূপে প্রবাহ, আবার বাষ্পীভূত হয়ে পুনরায় জলরূপ ধারণ— এই জলচক্র নিজের মধ্যেই এক আশ্চর্য্যরূপ যার বিস্তার ভূতল থেকে হিমালয়, আবার সমুদ্র থেকে বায়ুমণ্ডল সর্বত্রই।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শাস্ত্র বেদেও আমরা জলের বর্ণনা পেয়ে থাকি। ঋগ্বেদে জলকে দেবতুল্য বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বর্ণিত জলদেবতাকে ‘অপো’-দেবতা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পবিত্রতা এবং শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে গঙ্গাদেবীকে মাতৃরূপে আরাধনা করা হয়। সমস্ত সনাতনী মঙ্গলাচারণ পদ্ধতিতে গঙ্গা জলের ব্যবহার যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে।
বিজ্ঞানে জল কে পদার্থরূপে গণ্য করা হয়, যার প্রতিটি অণু ২টি হাইড্রোজেন পরমাণু ও ১টি অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা গঠিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে সর্বত্রই জলের উপস্থিতি। আমরা সকলেই জানি জলের ওপর নাম জীবন। শুধুমাত্র জীবন গঠন নয়, জীবনের পরিচর্যা এবং রোগলক্ষণ প্রতিকারেও জলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় জলের এই বিশেষ ব্যবহার “জল চিকিৎসা” নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে এই জল চিকিৎসার অনুকরণে আধুনিক চিকিৎসায় হাইড্রোথেরাপির প্রবর্তন হয়, যার প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয় জার্মান বিশারদ লুই কুনহে-কে । জল চিকিৎসার উৎপত্তি ভারতীয় আয়ুর্বেদে, তার প্রমাণস্বরূপ আমরা আয়ুর্বেদের শ্লোকে পাই —
অজীর্ণ ভেষজ বারি, জির্নে বারি জলপ্রদম।
ভোজনে চামৃত বারি, ভোজনান্তে বিষ প্রদম
।।”
যারা প্রধানত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগে থাকেন তাদের জন্য জলপানের কিছু নিয়মাবলি অবশ্য উপযোগী। জল সবসময়ই ভোজনের পূর্বে পান করা শ্রেয়। আমরা যখন আহার করি তখন থেকে শুরু করে তার কিছু সময় পশ্চাৎ আমাদের পৌষ্টিক তন্ত্রে তার পাচন হয়। এই পাচন প্রক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় যা খানিকটা জ্বলন্ত উনুনে রান্নার মতো। এখন যদি জ্বলন্ত উনুনে রান্নার সময় তাতে জল ঢেলে দেওয়া হয় তাহলে জ্বালানি ব্যাহত হয় এবং ধোঁয়ার সঞ্চার হয় ও রান্না অপরিপক্ব হয়। ঠিক তেমনি পাচন চলাকালীন জল পানে পাচন ব্যাহত হয় ও হজমের সমস্যা হয়। এই কারণে বলা হয় ভোজনের কমপক্ষে ৪০মিনিট পর জলপান করা শ্রেয়। আবার ভোজনে আমরা যদি দুটি ভিন্ন ধরনের কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ ভাত ও রুটি একই সাথে গ্রহণ করি সেইক্ষেত্রে ২টির কোনো একটু সম্পন্ন করে দ্বিতীয় টি শুরুর পূর্বে অর্থাৎ দুয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ জল পান করা যেতে পারে।

হাইড্রো থেরাপির মূল পর্যায় হল সকালে খালি পেটে। নিয়মানুসারে সকালে ঘুম থেকে উঠে সর্বাগ্রে ১লিটার জল পান করা উচিত। তার সাথে লেবু ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া জল উষ্ণভাবে পান করলে অধিক উপকার পাওয়া যেতে পারে। এইরূপ জল পানের নূন্যতম ১ঘণ্টা পরেই প্রাতরাশ করা শ্রেয়। এইরকম জলপানের উপকারিতা হলো — ১) এটি আমাদের শরীরের বিপাক ক্রিয়া ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ফলে শরীরে মেদ হ্রাস পায় ও ক্ষুদা বৃদ্ধি পায়। ২) এই পদ্ধতিতে শরীরে জমে থাকা টক্সিন দূরীভূত হয়, যার ফলে ত্বক ও চুল ভালো হয়। ৩) এইভাবে জল পান করলে অন্ত্রের সঠিক শুদ্ধিকরণ হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। ৪) নিয়মিত এইভাবে জল পান করলে শরীর বিভিন্নভাবে পজিটিভ সংকেত দিতে থাকে অর্থাৎ মাইগ্রেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস জাতীয় রোগে সুফল পাওয়া যায়
এছাড়া নিয়মিত উষ্ণ জল পান করলে শরীরের মেদ হ্রাস পায়, বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জমে থাকা ভিসেরাল ফ্যাট এর হ্রাস প্রাপ্তি ঘটে, যা শরীরে এক নতুন জীবনীশক্তির সঞ্চার ঘটায়।
বিশুদ্ধ জল পানে যেমন জীবনীশক্তির সঞ্চার ঘটে তেমনি জল বিশুদ্ধ না হলে ত মৃত্যুরও কারণ হতে পারে । অপরিশোধিত জল পানের ফলে বিভিন্ন জীবাণু ঘটিত রোগ যেমন কলেরা, টাই ফয়েড, জিয়ার্ডিয়া প্রভৃতি রোগ সংক্রমণ হতে পারে। আমরা সবাই জানি ১৮১৭-১৮২৪ সালে সারা বিশ্বে কলেরা মহামারীর আকার ধারণ করেছিলএছাড়াও ২০১৫ সালে জল বাহিত রোগে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায়। এছাড়াও প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১ বিলিয়ন মানুষ জল বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। তাই ২০২০ সালের এই করোনা ভাইরাস জনিত ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা লাভ করার পর আশা করি জল নিয়ে সচেতন হতে শুরু করবেন
আগামী ৫ ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আসুন সকলে জল সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ জল পানের অঙ্গীকার করি। জল দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রণীত আইনের পালন করি এবং সঠিক নিকাশি
ও শৌচ ব্যবস্থার পালন করি; জলের অপচয় রোধ করে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরে সচেতনতার প্রসার ঘটাই। প্রতিটি মানুষের নাগরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আগামীর বিশ্ব পুনরায় স্বচ্ছ ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক।

ডা. সন্দীপ কির্ত্তনীয়া (Dr. Sandeep Kirtaniya)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.