‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ তো আছে আপনার বাড়ির চালে, রান্না-বাগানে। প্রতিটি গৃহে এমন লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান হোক।

খনার বচনে আছে, “চাল ভরা কুমড়ো লতা/লক্ষ্মী বলেন, আমি তথা।” এই প্রবাদ আমাদের দেখিয়ে দেয়, ধান্যলক্ষ্মী আর শাকম্ভরী-লক্ষ্মীর অভিন্নতা। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে আমরা শাকম্ভরী-দুর্গার স্তোত্র পেয়েছি, দেবী সেখানে নিজের দেহ থেকে শাকসব্জি ও ফলমূল হয়ে অজন্মার হাত থেকে মর্ত্যলোককে বাঁচাচ্ছেন ও পুষ্টিবর্ধন করছেন। পুষ্টি -বাগান রচনা ভারতবাসীর কাছে কেবল প্রয়োজন নয়, তা সংস্কৃতির অঙ্গ।

ভূত চতুর্দশীতে( ভূত তাড়াতে) যে চৌদ্দ শাক আমরা খাই তার মধ্যে আছে ওল, কেঁউ, বেতো বা বাথুয়া, কালকাসুন্দে, সরিষা, নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চ বা শাঞ্চে, গুড়ুচি বা গুলঞ্চ, পটুক বা পটল বা পলতা পাতা, শেলূকা Cordia dichotoma , হিলমোচিকা বা হিঞ্চে, ভন্টাকী বা ঘেঁটু বা ভাট এবং সুনিষণ্নক বা সুষুনি।
মানভূম অঞ্চলে জীহুড় দিনে (আশ্বিন সংক্রান্তি) ২১ রকমের শাক রান্না করে খাওয়ার বিধি আছে। এই শাকগুলির নাম — ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দা, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শোলফা, গুলঞ্চ, ভাঁট, সুষনি, কলমি, কুদ্রুং, কুলেখাড়া, থানকুনি, ব্রাহ্মী, বাসক এবং কালমেঘ।

কার্তিক পুজোর সময় যে শস্য-সরা রচনা করা হয়। তাতে ছোলা, মটর, সরষে, গম, মাষ-কলাই-এর পাশাপাশি কচু ও সুশনি শাকের চারাও লাগানো হয়। এইভাবে ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’ ধারণা সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে আমাদের উদ্যান রচনা করতে শেখায়।

বাংলার কুমারী মেয়েরা কার্তিক মাস জুড়ে যমপুকুর ব্রত উৎযাপন করতো। বাড়ির উঠোনে চৌকো পুকুর কেটে তার পাশে লাগাতো কলমি, শুষনি, হিংচে, কচু, হলুদ। পুতুল বসতো পুকুরের পশ্চিম পাড়ে — কাক, বক, হাঙর, কুমির আর কচ্ছপ। পুকুরে জল ঢেলে বলা হত ছড়া
“শুষনি-কলমি ল-ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে…
কালো কচু, সাদা কচু ল-ল করে,
রাজার বেটা পক্ষী মারে।”
এই ব্রতের মাধ্যমে কুমারীদের শাক-সবজির বাগান তৈরিতে উৎসাহ যোগাতো।

কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে নিদয়ার সাধভক্ষণ অংশে নানান শাক রান্নার কথা আছে —
“আমার সাধের সীমা
হেলাঞ্চি কলমী গিমা
বোয়ালী কুটিয়া কর পাক।
ঘন কাটি খর জ্বালে
সাঁতলিবে কটূ তেলে
দিবে তাতে পলতার শাক।।
পুঁই-ডগা মুখী-কচু
তাহে ফুলবড়ি কিছু
আর দিবে মরিচের ঝাল।।”
এখানে হেলাঞ্চি বা হিঞ্চে শাক হল Enhydra fluctuans , Family : Asteraceae; কলমী Ipomea aquatica , Family: Convolvulaceae; গিমা Mollugo cerviana , Family: Aizozaceae; পুঁই Basella alba , Family: Basellaceae; কচু Colocasia esculenta , Family: Araceae; পলতা বা পটল শাক Trichosanthes dioica , Family: Curcurbitaceae.
কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে ‘নিদয়ার মনের কথা’ অংশে রয়েছে —
“বাথুয়া ঠনঠন তেলের পাক
ডগি ডগি লাউ ছোলার শাক।।”
এখানে বেতো বা বাথুয়া Chenopodium album , Family: Chenopodiaceae; লাউ শাক Lagenaria siceraria , Family: Curcurbitaceae; ছোলার শাক Cicer arietinum , Family: Fabaceae.

মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বলতে, গ্রাম-বাংলার সমৃদ্ধি বলতে বুঝতে হবে আহার ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। সমৃদ্ধি তখনই বলবো যখন গ্রামবাসী রোজ দুবেলা পুষ্টিকর খাবার পাতে পাবেন। কেউ দয়া করে ভিক্ষে দিয়ে সমৃদ্ধি আসে না।

অনেক বাস্তুতেই আলগোছে এক-আধ কাঠা জমি পড়ে থাকে, কখনও তারও বেশি। আবাস-সন্নিহিত জমিটুকুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করে কিচেন গার্ডেন বা ঘরোয়া সবজি বাগান গড়ে তোলা যায়। কখনও তার লাগোয়া দু’টো একটা ছোটো মাপের ফলগাছ লাগালে, তা এক পরিপূর্ণ পুষ্টি বাগান বা নিউট্রিশনাল গার্ডেন হয়ে দাঁড়াবে।
সবজি বাগানে বারোটি ছোটো প্লট বানিয়ে ফসল চক্র অনুসরণ করে সারাবছর ধরে সবজি লাগালে বাড়ির চাহিদা মিটবে। এই বাগানের বেড়াতেও উপযোগী লতানে সবজি তুলে দেওয়া যায়। বাগানে যদি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়, তবে বাংলার মানুষ কৃষির রাসায়নিক দূষণ থেকে রেহাই পাবে।কারণ সবজি আর ফলেই সবচাইতে বেশি সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয়। শহরতলীতেও যাদের গৃহ-সন্নিহিত এক চিলতে জমি আছে; অথচ তাতে ভালো আলো-বাতাস খেলে, তারাও রচনা করতে পারবেন পুষ্টি বাগান। বাগানের বর্জ্য, গৃহের তরকারির খোসা, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগানেই বানিয়ে নেওয়া যায় কম্পোস্ট সারের ভাণ্ড। গ্রামের মানুষ গোবর ও গোমূত্র ব্যবহার করে গোবর সার, তরল জৈবসার এবং কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মি-কম্পোস্ট বা কেঁচোসার বানিয়ে এই পুষ্টিবাগানে প্রয়োগ করতে পারেন।

অপুষ্টির অভিশাপ থেকে গ্রাম-বাংলাকে শাপমুক্ত করতে ছড়িয়ে দিন পুষ্টিবাগানের এই প্রস্তুত পাঠ। সবজি উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এখনো দেশের সমস্ত মানুষ আজও দৈনিক ন্যুনতম মাত্রায় সবজি তাদের ব্যঞ্জনে পায় না। অথচ সামান্য সচেতনতা ও প্রচেষ্টা থাকলে কি এতটা অপুষ্টির পরিমণ্ডল থাকা উচিত? পুষ্টিবাগানের তথ্য ও তার নিবিড় পাঠ বাংলার মানুষকে বাস্তু-বাগান রচনায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করবে। বাড়ির পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও গৃহকর্ত্রীরাই মিলেমিশে রচনা করবেন এই বাগান।

পুষ্টি বাগানের ফসল চক্র:
প্লট -১: জলদি ফুলকপি এবং সাথি ফসল রূপে পালং শাক (আষাঢ় থেকে আশ্বিন), আলু (কার্তিক থেকে ফাল্গুন), নটেশাক (চৈত্র থেকে আষাঢ়)
প্লট -২ : নাবি বাঁধাকপি (আশ্বিন থেকে মাঘ), ভিণ্ডি (ফাল্গুন থেকে আষাঢ়), মুলো (আষাঢ় থেকে ভাদ্র)
প্লট -৩: ফুলকপির সঙ্গে সাথি ফসল ওলকপি (আশ্বিন থেকে মাঘ), গ্রীষ্মকালীন বেগুন সঙ্গে সাথি ফসল নটে শাক (ফাল্গুন থেকে ভাদ্র)
প্লট -৪: জলদি বাঁধাকপি সঙ্গে সাথি ফসল পালং (ভাদ্র থেকে অঘ্রাণ), মটরশুঁটি (পৌষ থেকে বৈশাখ), বরবটি (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ)
প্লট – ৫: জলদি ফুলকপি সঙ্গে সাথি ফসল লালশাক (শ্রাবণ থেকে কার্তিক), পিঁয়াজ (অঘ্রাণ থেকে জ্যৈষ্ঠ), বরবটি (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ)
প্লট – ৬: ভিণ্ডি (শ্রাবণ থেকে অঘ্রাণ), আলু (অঘ্রাণ থেকে ফাল্গুন), বরবটি (চৈত্র থেকে আষাঢ়)
প্লট – ৭: টমেটো (কার্তিক থেকে ফাল্গুন), ভিণ্ডি (বৈশাখ থেকে ভাদ্র), মুলো (ভাদ্র থেকে কার্তিক)
প্লট – ৮: বরবটি (ভাদ্র থেকে কার্তিক), পেঁয়াজ (অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ), লালশাক (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ)
প্লট – ৯: লালশাক (কার্তিক থেকে অঘ্রাণ), টমোটো (অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ), উচ্ছে (বৈশাখ থেকে আশ্বিন)
প্লট – ১০: বেগুনের সঙ্গে সাথি ফসল পালং (আষাঢ় থেকে ফাল্গুন), নটে শাক ( চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ)
প্লট -১১: পেঁয়াজ (কার্তিক থেকে বৈশাখ), ভিণ্ডি (জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন)
প্লট -১২: লম্বালম্বিভাবে অনুচ্চ ফলের গাছ লাগানো হবে, যেমন আম্রপালি আম, এল-৪৯ পেয়ারা, গ্র্যান্ড নাইন কলা, করমচা, ডালিম।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.