তখনই জেনেছিলাম রাখীফুলের কথা। যে বাড়িতে ঝুমকোলতার ফুল ফোটে ভাইবোনকে হাত ধরে সেই বিকেলেই নিয়ে যায় দিদি। বেড়ার উপর ঝুমকোলতার ছড়ানো সবুজ চাদর, মাঝেমাঝে উঁকি মারছে এক একটি স্বর্গের ফুল, ভারী মিষ্টি তার গন্ধ। “ফুলগুলি যেন কথা,/ পাতাগুলি যেন চারি দিকে তার/ পুঞ্জিত নীরবতা॥” আগ্রহে, উৎসাহে, আতিশয্যে ফুল নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে ছিঁড়েই ফেলি কোনও একটা। ফুল্লরার মালিক বলেন, ছিঁড়তে নেই বাবা, ফুল গাছেই যে ভালো লাগে! কিন্তু আমার যে দেখতেই হবে ফুলের প্রতিটি অবয়ব! কেমন তার নরম দলের উপর পুংকেশর-গর্ভকেশরের মনোরম নিখুঁত ছবি আঁকা রয়েছে! স্রেফ এঁকেই সাজিয়ে দিয়েছেন বনমালী! ছোড়দিরও এ ফুল ভারী পছন্দ ছিল। ও নিজের মেয়ের নাম পরে রেখেছিল ‘রাখী’। আমি রাখীফুল দেখছি তো দেখছিই! দীর্ঘ অবলোকনের পর বোন্টুকেই দিয়ে দিতাম সেই মহার্ঘ ফুল। ছোট্ট-মিষ্টির মুখ নিমেষে আনন্দ ভরে ওঠে। এ ফুল ওকেই তো মানায়! দাদা-দিদির পরিবারে ও মিষ্টি এক ফুল।
রাখী-মরশুমেই ফোটে এই ফুল। ইংরেজিতে ফুলের নাম Passion Flower বা Passion Vine. উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Passiflora. দেখতে এক একটা রাখীরই মতো। এই ফুলের আদলেই হয়তো প্রথম রাখীটি তৈরি হয়েছিল। কেবল হাতের গয়না নয়, এই ফুলের অনুকরণে তৈরি হয়েছে কানপাশাও, তার নাম ঝুমকা; আর তা থেকেই গাছের নাম হয়ে গেল ‘ঝুমকো লতা’। রাধা-কৃষ্ণ নামের সঙ্গে এই ফুল জড়িয়ে আছে, জড়িয়েছে পঞ্চ-পাণ্ডবের নামও। ফুলের নাম ‘কৃষ্ণকমল’, ‘রাধিকা নাচন’, ‘পঞ্চপাণ্ডব’।
রাখীফুলের নানান প্রজাতি; কোনোটি নীল (caerulea), কোনোটি বেগুনি (incarnata), কেউ বা লাল (racemosa) কিংবা রক্তাভ লাল (coccinea), আবার কোনোটি গোলাপি (kermesina)। এটি Passifloraceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত; আদিনিবাস সম্ভবত পুরাতন পৃথিবী (Old World অর্থাৎ Afro-EurAsia)। ৫০০টির মতো প্রজাতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে; তার অধিকাংশ মেক্সিকো সহ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় লভ্য, হয়তো তা ছড়িয়েছে পুরাতন বিশ্ব থেকেই; কিছু ছড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং ওসিয়ানিয়ায়। ফুলের সৌকর্যে মাতোয়ারা হয়ে এই ফুলটি এদেশ-ওদেশ ছড়িয়ে গেছে এবং নতুন জলবায়ুতে তা দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে।
গাছটি শক্তপোক্ত লতানে, বহুবর্ষী, তাতে রয়েছে আকর্ষের মতো আরোহী, যা বড়গাছ বেয়ে উঁচুতে যেতে চায়, পেতে চায় প্রভাতের সূর্য। রোদ ঝলমলে স্থান পছন্দ করে এরা, ছায়া-নিবিড়তা না-পসন্দ। প্রাচীরজুড়ে, বেড়ার ধারে চড়িয়ে দিলে ডগমগে পাতার যৌবন ডালে ডালে নাচিয়ে প্রভাতী সূর্যকে যেন নিত্যদিন রাখী পরায়; গ্রীষ্মের শেষ থেকে সারাবর্ষা, কখনও তা ছাপিয়ে যায় শরৎ-হেমন্তের প্রভাতবেলা। রবি ঠাকুরের সেই বালক-বেলার কবিতাটিই আমার মনে পড়ছে, আপনার মতই— “হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে/ ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে/ বাদল বেলার কথা,/ হারিয়ে পাওয়া আলোটিরে/ নাচায় ডালে ফিরে ফিরে/ ঝুমকো ফুলের লতা।” কবিতাটিতে উদ্যানবিদ রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, এ রোদ-পিয়াসী ফুল।
রাখীবন্ধনকে অন্যতর তাৎপর্যে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমে গিয়ে বিধুবাবুর কাছে শুনলাম তার ইতিহাস। এক বর্ষাস্নাত রাখীবন্ধন উৎসবে ‘হিন্দুমহাসভা ধাম’-এর দোতলার বারান্দায় বসে তিনি অবনীন্দ্রনাথ ও রাণী চন্দের ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থ থেকে পাঠ করে শোনালেন, রাখীবন্ধনের উৎসবের কথা। এক্ষণে তারই কিয়দংশ পরিবেশন করলাম— “রবিকাকা একদিন বললেন, রাখীবন্ধন-উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখী পরাতে হবে। উৎসবের মন্ত্র অনুষ্ঠান সব জোগাড় করতে হবে, তখন তো তোমাদের মতো আমাদের আর বিধুশেখর শাস্ত্রীমশায় ছিলেন না, ক্ষিতিমোহনবাবুও ছিলেন না কিছু একটা হলেই মন্ত্র বাতলে দেবার। কী করি, থাকবার মধ্যে ছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর, রোজ কথকতা করতেন আমাদের বাড়ি, কালো মোটাসোটা তিলভাণ্ডেশ্বরের মতো চেহারা। তাঁকে গিয়ে ধরলুম, রাখীবন্ধন-উৎসবের একটা অনুষ্ঠান বাতলে দিতে হবে। তিনি খুব খুশি ও উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, এ আমি পাঁজিতে তুলে দেব, পাঁজির লোকদের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে, এই রাখীবন্ধন-উৎসব পাঁজিতে থেকে যাবে। ঠিক হল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখী পরাব। এই সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানে যাব— রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। কী বিপদ, আমার আবার হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে না। কিন্তু রবিকাকার পাল্লায় পড়েছি, তিনি তো কিছু শুনবেন না। কী আর করি— হেঁটে যেতেই যখন হবে, চাকরকে বললুম, নে সব কাপড়-জামা, নিয়ে চল্‌ সঙ্গে। তারাও নিজের নিজের গামছা নিয়ে চলল স্নানে, মনিব চাকর একসঙ্গে সব স্নান হবে। রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে— মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম— যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল—
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
এই গানটি সে সময়েই তৈরি হয়েছিল। ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চার দিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হল— সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল এক গাদা রাখী, সবাই এ ওর হাতে রাখী পরালুম। অন্যরা যার কাছাকাছি ছিল তাদেরও রাখী পরানো হল। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখী পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিস ঘোড়া মলছে, হঠাৎ রবিকাকারা ধাঁ করে বেঁকে গিয়ে ওদের হাতে রাখী পরিয়ে দিলেন। ভাবলুম রবিকাকারা করলেন কী, ওরা যে মুসলমান, মুসলমানকে রাখী পরালে— এইবারে একটা মারপিট হবে। মারপিট আর হবে কী। রাখী পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তে হতভম্ব, কাণ্ড দেখে। আসছি, হঠাৎ রবিকাকার খেয়াল গেল চিৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখী পরাবেন। হুকুম হল, চলো সব। এইবারে বেগতিক— আমি ভাবলুম, গেলুম রে বাবা, মসজিদের ভিতরে গিয়ে মুসলমানদের রাখী পরালে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার না হয়ে যায় না। তার উপর রবিকাকার খেয়াল, কোথা দিয়ে কোথায় যাবেন আর আমাকে হাঁটিয়ে মারবেন। আমি করলুম কী, আর উচ্চবাচ্য না করে যেই-না আমাদের গলির মোড়ে মিছিল পৌঁছানো, আমি সট্‌ করে একেবারে নিজের হাতার মধ্যে প্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। রবিকাকার খেয়াল নেই— সোজা এগিয়েই চললেন মসজিদের দিকে, সঙ্গে ছিল দিনু, সুরেন, আরো সব ডাকাবুকো লোক। এ দিকে দীপুদাকে বাড়িতে এসে এই খবর দিলুম, বললুম, কী একটা কাণ্ড দেখো। দীপুদা বললেন, এই রে, দিনুও গেছে, দারোয়ান দারোয়ান, যা শিগগির, দেখ্‌ কী হল— বলে মহা চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলেন। আমরা সব বসে ভাবছি—এক ঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টা বাদে রবিকাকারা সবাই ফিরে এলেন। আমরা সুরেনকে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কী, কী হল সব তোমাদের। সুরেন যেমন কেটে কেটে কথা বলে, বললে, কী আর হবে, গেলুম মসজিদের ভিতরে, মৌলবী-টৌলবী যাদের পেলুম হাতে রাখী পরিয়ে দিলুম। আমি বললুম, আর মারামারি! সুরেন বললে, মারামারি কেন হবে— ওরা একটু হাসলে মাত্র। যাক্‌, বাঁচা গেল। এখন হলে— এখন যাও তো দেখি, মসজিদের ভিতরে গিয়ে রাখী পরাও তো— একটা মাথা-ফাটাফাটি কাণ্ড হয়ে যাবে।”
দুর্গাপুজোর দিন গোনা ছাড়া, বাকি উৎসবগুলো হঠাৎ করেই চলে আসত আমাদের জীবনে। কত রকমের পাল-পার্বণ, তিথি পুজো! এক পুজো যায়, তো আর পুজো আসে। মা ব্রত রাখেন। এ বাড়ি, ও বাড়ি যাই; যে বাড়ি যে পুজোর জন্য বিখ্যাত, যাওয়া চাই-ই সেখানে। আমরা কচিকাঁচারা তন্নতন্ন করে খুঁজি? কী? এখন মনে হয়, ‘বাংলার সংস্কৃতি’, ‘বাংলার শিকড়’।
রহড়া খড়দায় ঝুলনের আয়োজন তখন সব বাচ্চারাই করত। আমি আর বোনও ঝুলনা সাজাতাম— মস-ফার্ন, বালি-সুরকি, ঝামা ইটের পাহাড় জমিয়ে, অর্ধচন্দ্রের উপর রাধাকৃষ্ণের মৃন্ময় মূর্তি টাঙিয়ে। সেই পূর্ণিমার বিকেলেই ডান হাতের কব্জিতে বোন্টু পড়িয়ে দিত সুদৃশ্য এক রাখী। বিকেল থেকে রাত অবধি আগলে রাখতাম অলংকার। তারপর যত্নে কাগজের বাক্সে তুলে রাখতাম রাখী, আশ্বিন সংক্রান্তিতে আবার পড়ব বলে। রাখীর জোগান দিতেন দিদি আর ছোড়দি, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে। এ দোকান, ও দোকান ঘুরে বেছে বড়সড় রাখী খুঁজে আনতেন দিদি-ছোড়দি। প্রথমে স্পঞ্জের পাতলা চক্রের ভিত্তি, তার উপর ভেলভেটে চুমকি বসানো এক টুকরো গোল কাপড়, মাঝে মানানসই প্লাস্টিকের ছোটো জল-শিউলি ফুল— পুরোটাই সুতো দিয়ে সুন্দর করে কেন্দ্রে গাঁথা। আমাকে আর দাদাকে পড়ানো হত রাখী। দিদি শাঁখ বাজাতেন, ছোড়দি চন্দনের টিপ।
বোন ছোট্ট মানুষ, তারও যে একটা রাখী চাই! আহা বলতেও পারে না। ফ্যালফ্যাল করে রাখীর দিকে চেয়ে থাকে পড়ানোর পর, এক এক করে চুমকি গোনে। আদর করে আর একটি রাখী এবার দিদিই পড়িয়ে দেন বোন্টুর হাতে। ওটাও কেনা থাকে। দিদি জানে, বোনের কষ্ট হবে। তারপর প্রত্যেকে একটি করে রসগোল্লা খাই; পাঁচ ভাই-বোন, পঞ্চপাণ্ডব।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.