সুখ কখনও হয় না নিরন্তর দেবতাদেরও। তাঁদেরও জীবনে বারেবারেই নেমে আসে অ-সুখের কালােরাত্রি। স্বর্গের অধিবাসী হয়েও সেখানকার সিংহাসন হাতছাড়া হয় সুরেন্দ্রর। দেবরাজ্য দখল করে অসুররা। আর তাদেরই ভয়ে স্বর্গ ছেড়ে পালান দেবতারা। দীন-দুঃখীর মতােই ঘুরে বেড়ান পথেঘাটে। কখনও বা লুকিয়ে পড়েন পাহাড়ে কন্দরে।

সেবারও হলাে তাই। স্বর্গহারা দেবতারা তখন সাধারণ মানুষের মতােই দিশেহারা। কী করবেন বুঝতে পারেন না তাঁরা। সেই বুঝতে না-পারার যন্ত্রণাতেই কেমন যেন উদ্যমহীন অলস জীবন তখন তাঁদের। অক্ষমের মতাে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলা।

সন্তানদের এই দুঃখে বিচলিত হন দেবমাতা অদিতি। প্রতিকারের আশায় তিনি করেন সূর্যের আরাধনা। এর আগে মহামায়ার মহাশক্তি স্বর্গভ্রষ্ট দেবতাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেও এবার তিনিও যেন নিষ্ক্রিয়। আর তাই সর্বশক্তিমান সূর্যের আরাধনা করতে থাকেন অদিতি।

দেবমাতার সেই সুকঠোর তপস্যায় তুষ্ট সূর্যদেব। প্রবল তেজে প্রদীপ্ত সূর্য আবির্ভূত হন অদিতির সামনে। বলেন, তােমার তপস্যায় তুষ্ট আমি। বলাে, কী তােমার প্রার্থনা। তােমাকে অদেয় এমন কিছুই নেই আমার।

অদিতি বলেন, আমার সন্তানরা স্বর্গহারা। প্রবল শক্তিতে অসুররা কেড়ে নিয়েছেন স্বর্গের প্রাণময় সিংহাসন। তাদের ভয়ে সন্তানরা আমার যাপন করছে দীন ভিক্ষুকের জীবন। তাই বিতাড়িত করুন অসুরদের স্বর্গ থেকে। সেখানে আবার প্রতিষ্ঠিত হােক আমার সন্তান দেবতারা। দয়া করে কৃপা করুন।

সূর্য বলেন, তাই হবে। আমি বিতাড়িত করবাে অসুরদের ওই অমরলােক থেকে। আর তারই জন্য আসবাে আমি তােমার সন্তান হয়ে। সেই রূপেই স্বর্গ করবাে অসুর-মুক্ত।

সূর্যের এহেন বরে সুখী মাতা অদিতি অচিরেই হন গর্ভবতী। এবার প্রতীক্ষা অজাতক মার্তণ্ডের জন্য। তারই মঙ্গলের জন্য শুরু হলাে উপাসনা। নানা কৃচ্ছ সাধনে ক্লিষ্ট হতে থাকেন তিনি।

গর্ভবতী অদিতির ক্রমাগত উপবাস এবং নানা কঠোর তপস্যায় বিচলিত প্রজাপতি কশ্যপ। স্ত্রীকে ডেকে বলেন, এ কী শুরু করেছ তুমি! এভাবে উপােস করতে থাকলে তােমার গর্ভস্থ সন্তানের যে ক্ষতি হবে। এমনকী তােমার গর্ভপাতও হতে পারে। তাই এমন তপস্যা থেকে বিরত হও। তােমার অন্য সন্তানদের কল্যাণের কথা ভেবে, তাদের দুর্দশা দূর করার জন্যই তােমার সুস্থ সবল পুত্র প্রসব করা দরকার।

স্বামীর কথায় হাসেন অদিতি। বলেন, মিথ্যেই ভাবছাে তুমি। এসব উপােস ও ব্রতে আমার অজাতক সন্তানের কোনও ক্ষতিই হবে না। বরং এসবই হবে তার পুষ্টির কারণ। তাই দুশ্চিন্তা ছাড় তাে তুমি।

অদিতির কথায় চুপ করেন কশ্যপ। মনে অবশ্য একটু খুঁতখুঁতুনি থেকেই যায়। কিন্তু মা অদিতির এমন বিশ্বাস এবং দৃঢ়তা দেখে ভাবেন, তাকে আর এসব নিয়ে বিরক্ত না করাই ভালাে। নিবৃত্ত হলেন কশ্যপ। তবুও উদ্বেগ যায় না। সেইভাবেই অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি পুত্রের জন্মের জন্য। অবশেষে আসে সেই শুভদিন। মাতৃগর্ভ থেকে অবতীর্ণ হন সূর্য। সুস্থ, সবল এবং অনুপম তার রূপ।

জন্মমাত্রই পূর্ণরূপ। অপেক্ষা না করে দেবতাদের নেতা হয়ে এগিয়ে আসেন অসুর দমনে। তাঁর নেতৃত্বে দেবতারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন অসুরদের। আবার তাঁরা হন স্বর্গবাসী। সেইসঙ্গে কৃতজ্ঞ দেবতারা নানাভাবে অর্চনা করেন সূর্যকে। আর সেইসময় থেকেই নরলােকেও শুরু হয় সূর্য-উপাসনা। সেই উপাসনারই এক সার্থক রূপ মিত্রসপ্তমী।

আসলে শুক্লা সপ্তমী তিথিটি হলাে সূর্যের দিন। নানা নামে সূর্য এক এক মাসে এক এক সপ্তমীতে করেন অবস্থান। গ্রহণ করেন সকলের পূজা। ভানু সপ্তমী, রথ সপ্তমী, মিত্র সপ্তমী ইত্যাদি হলাে এক এক মাসে সূর্যের এক এক রূপে অর্চিত হওয়ার দিন। সূর্যকে বলা হয় বিষ্ণুরই এক অবতার।

বিভিন্ন পুরাণেই সূর্যের আবির্ভাবের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। মৎস্য, ভবিষ্য, মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি পুরাণে আছে সূর্যের উদ্ভবের কাহিনি।

মার্কণ্ডেয় পুরাণের কাহিনি, সৃষ্টির সেই প্রথম কালে চারদিক ছিল তমসাবৃত। আলাের চিহ্ন ছিল না কোথাও। এমনই এক মুহূর্তে উৎপন্ন হয় পরমকারণ, ক্ষয়রহিত এক সুবৃহৎ অণ্ড। সেই অণ্ডের মধ্যে তখন অবস্থান জগতের স্রষ্টা পদ্মযােনি ব্রহ্মার। একসময় তিনি প্রকাশিত হলেন সেই অণ্ড ভেদ করে। আবির্ভূত ব্রহ্মার মুখ থেকে নির্গত হলাে মহানাদ ‘ওঁ’। সেই ওঙ্কার থেকে পর্যায়ক্রমে উৎপন্ন হয় ‘ভূ’, ‘ভুবঃ’ এবং ‘স্বঃ’। এই তিন ব্যাহৃতিই হলাে সূর্যের স্বরূপ। ওঁ থেকেই পরমসূক্ষ্ম রূপ সূর্য বা রবির আবির্ভাব। সূর্যের সেই সূক্ষ্মরূপ থেকেই ক্রমে স্থূল থেকে স্থূলতর হয়ে প্রকাশিত হলাে ‘মহঃ’ ‘জন’, ‘তপঃ’ এবং ‘সত্য’ রূপে। ওঙ্কার থেকেই বিবস্বানের স্থূল ও সূক্ষ্ম ভেদে সপ্তরূপের উদ্ভব। এমন রূপ সত্ত্বেও ভগবান ভাস্কর কখনও প্রকাশিত, কখনও বা অপ্রকাশিত।

অনন্ত তেজোময় আদিত্যের প্রভাবে চারিদিকের সব জল শুকিয়ে যেতে থাকলে বিব্রত হন ব্রহ্মা। জল ছাড়া তাে সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাই তিনি নানাভাবে স্তব করতে থাকেন সূর্যের—তাঁর ওই বিপুল তেজোরাশি সম্বরণের জন্য।

ব্রহ্মার স্তবে তুষ্ট ভাস্কর তাঁর পরম তেজ সম্ববরণ করে স্বল্প তেজোময় হলেন। আর সেই তেজকে অবলম্বন করেই ব্রহ্ম সমাধা করলেন তাঁর সৃষ্টি কর্ম।

সেই সৃষ্টি পর্বেই ব্রহ্মার পৌত্র কশ্যপ বিয়ে করেন প্রজাপতি দক্ষের অদিতি প্রভৃতি তেরটি মেয়েকে। অদিতি সূর্যকে পুত্র রূপে পাওয়ার বর পেয়ে নানা কঠোর তপস্যা করতে থাকলে তাঁর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে কিছুটা রাগের সঙ্গেই বলেন, তুমি কি এইভাবে নিত্য উপােসী থেকে তােমার গর্ভকে ‘মারিত’ অর্থাৎ নষ্ট করবে? উত্তরে অদিতি বলেন, এই গর্ভ ‘মারি’ নাই অর্থাৎ নষ্ট হবে না, বরং এই হবে বিপক্ষের বিনাশের কারণ।

এরপরই জন্ম হয় তেজোময় ভাস্করের। সে রূপ দেখে বিদ্বান কশ্যপ তার স্তব করতে থাকলে ভেসে আসে আকাশবাণী— তুমি এই গর্ভকে ‘মারিত’ বলেছিলে, তাই তােমার এই পুত্রের নাম হলাে ‘মার্তণ্ড’।

এই মার্তণ্ডই স্বর্গজয়ী অসুরদের বিনাশের কারণ হন। তারপর মার্তণ্ডই আপন রশ্মিতে চারদিক আলােকিত করে কদমফুলের মতাে দীপ্তশালী হয়ে সূর্যের কাজ করতে থাকেন।

পুরাণ ও শাস্ত্রমতে সূর্যের রয়েছে অসংখ্য নাম। এক এক নামে সূর্যের অবস্থান এক এক মাসে একথা বলা হয়েছে আগেই। মার্গশীর্ষ অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে সূর্যের অবস্থান মিত্র রূপে। মানববন্ধু তিনি করেন সকলের অশেষ কল্যাণ। আর তাই সূর্যের প্রিয় তিথি শুক্লপক্ষের সপ্তমী অগ্রহায়ণ মাসে চিহ্নিত মিত্র-সপ্তমী নামে। সারা দেশের অসংখ্য মানুষ এই দিনে উপাসনা করেন সূর্যের। পালন করেন মিত্র-সপ্তমী ব্রত।

এই ব্রত পালনের অঙ্গ হিসেবেই শুক্লা সপ্তমীর সকালে সূর্যোদয়ের আগে কোনও নদী বা জলাশয়ে স্নান করে ষােড়শোপচারে করা হয় সূর্যের পূজা। নিবেদন করা হয় নানারকম ফল-মিষ্টি এবং অন্যান্য দ্রব্য। ব্রতীরা এদিন উপবাস করেন। উপবাসকালে শুধুই ফল খান। পরদিন অথাৎ অষ্টমীতে মিষ্টি খেয়ে ভঙ্গ করা হয় ব্রত। এই ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে ব্রতীরা দীর্ঘায়ু হন এমনই বিশ্বাস। এই ব্রতের অন্যতম অঙ্গ সূর্যস্নান। বলা হয়, এই দিনে দীর্ঘক্ষণ সূর্যরশ্মি ও তাপ গায়ে লাগানাে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। এতে শরীর ও মন হয় পরিশুদ্ধ। শাস্ত্রমতে, মিত্রসপ্তমী ব্রত করলে সম্পদ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়।

বঙ্গদেশে মিত্রসপ্তমী ব্রত পালনের চল তুলনায় একটু কম। কিন্তু সারা ভারতে এই ব্রত আজও পালন করা হয় সমান উৎসাহ এবং উদ্দীপনায়।

আধুনিক বিজ্ঞানও সুস্বাস্থ্য এবং নানা রােগ থেকে মুক্তির নিদান হিসেবে রােদ গায়ে লাগানাের কথা বলছে। হিন্দুশাস্ত্র কিন্তু বহুশত বছর আগেই এমন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সূর্যস্নানের বিধান দিয়েছে মানব কল্যাণে।

নন্দলাল ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.