কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ভণিতায় নিজের জন্ম সম্পর্কে বলছেন, “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাসে”, মানে সেই বছরেরই দিন যেদিন মাঘ মাসের শেষ দিনটি ছিল রবিবার এবং শ্রীপঞ্চমী তিথি বা সরস্বতী পুজো। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জ্যোতিষ গণনায় তা নির্ণয় করেছেন ১৩৮৬ থেকে ১৩৯৮ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে কোন এক মাঘী পঞ্চমীতে অর্থাৎ কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালীর স্বাদ বাঙ্গালি পেয়েছে অন্তত ছ’শো বছর আগে। অনুমান করা যায় তার আগে থেকেই বাঙ্গলার প্রবুদ্ধ-মহলে রামায়ণের সংস্কৃত কাব্যের চর্চা ছিল যথেষ্ট এবং লোককথায় তার অবিসংবাদিত বিস্তারও ছিল।
লোকায়ত-মানসে এমনি শক্ত ভিত্তি না থাকলে কৃত্তিবাস এমন জনপ্রিয় ও লোকপ্রিয় রামায়ণ কাব্য লিখতে প্রেরণা পেতেন না। আর এমনি এক কবিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত “এ বঙ্গের অলঙ্কার” বলবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আশ্চর্যের বিষয় হল, রামায়ণ-বিরোধিতা করতে গিয়ে হিন্দু বিরোধী ভ্রান্ত-সেকুলারি সমাজ শ্রীরামকে অবাঙ্গালির দেবতা বলে দেগে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে তুলসীদাসী রামচরিতমানস লেখা হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেক পরে। সম্ভবত রাম জন্মভূমি-বাবরী মসজিদ বির্তকে বাঙ্গালিকে সামিল না করার ‘সেকুলারি-চালাকি’ করেছিলেন কিছু ‘অসত্য কথা-বলা ইতিহাসবেত্তা’-রা। রাম যে বাঙ্গালির আরাধ্য দেবতা ছিলেন, তা নানান সময়ে আলোচনা করেছি। শ্রীরামকৃষ্ণের কুলদেবতা শ্রীরামচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দের রাম-উপাসনা, রানী রাসমণির রঘুবীর-সাধনাকে বাঙ্গালি ভুলে গেছে। বাঙ্গালি কীভাবে ভুলে যায় মহামন্ত্র, “হরে রাম হরে রাম/রাম রাম হরে হরে/ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ/ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।”
যারা বলেন রাম বাঙালির দেবতা নন, তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, “বাঙ্গলা দেশে যে এক সময়ে সমস্ত জনসাধারণকে একটা ভক্তির প্লাবনে প্লাবিত করিয়া তুলিতেছিল; সেই ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী মূর্খ, ধনী দরিদ্র, সকলেই, এক আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হইয়াছিল — বাঙ্গলা রামায়ণ, বিশেষভাবে, বাঙ্গলাদেশের সেই ভক্তিযুগের সৃষ্টি। বাঙ্গলাদেশে সেই যে, এক সময়ে, একটি নবোৎসাহের নব-বসন্ত আসিয়াছিল, সেই উৎসবকালের কাব্যগুলি বাঙ্গালির ছেলে যদি শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ করে, তবে দেশের যথার্থ ইতিহাসকে সজীবভাবে উপলব্ধি করিতে পারিবে।” (যোগীন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত ‘সরল কৃত্তিবাস’ গ্রন্থের ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩১৫, যে বইয়ের প্রচ্ছদে দেওয়া আছে, “অমৃত-মধুর এই সীতা-রাম-লীলা।/শুনিলে পাষাণ গলে, জলে ভাসে শিলা।।”)
ভাবুন কবে থেকে বাঙ্গালি রাম-নামে জারিত।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।