কলকাতার আদি গঙ্গার পাশে বাহান্ন পীঠের অন্যতম কালীঘাট। একসময় পার্শ্ববর্তী ওই জলপথ ছিল গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। পুরাকালে এই পথেই ভাগীরথী সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়। পরে গতিপথের পরিবর্তন ঘটে। একদিকে পুরাণের কাহিনি নিয়ে কালীঘাট আর অন্য দিক দিয়ে রাজধানী কলকাতার বুকে এমন জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র। যার ফলে নানা সময় নানা কারণে মানুষের ভিড় জমে। কালীঘাটের চৌকো পটের শিল্পীরাও আসলে হঠাৎ আসা একদল গ্রাম্য শিল্পী। তারা কুমোর-সূত্রধর ও কয়েকটি পটুয়া পরিবার। মূলত দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ও মেদিনীপুরের শিল্পীগোষ্ঠী।
কথিত, প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত রাজা বসন্ত রায় কালীঘাটের মন্দির নির্মাণ করেন এবং ১৭৯৮ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের সন্তোষ রায় এই মন্দিরকে নবরূপ দেন। এই সময় বেড়ে যায় ভক্ত সমাগমও। সে সময় জীবিকার সন্ধানে ছোটো ছোটো কয়েকদল গ্রাম্য শিল্পী নতুন ভাবে বাঁচার চেষ্টা চালালো। একই সঙ্গে পটুয়া-চিত্রকরদের জাতি-বর্ণ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা। শ্রমনির্ভর কুটীরশিল্পকে আশ্রয় করে জনবহুল কলকাতার বুকে ‘পাড়া’ অর্থে সহজ ঠিকানা তৈরির চেষ্টা। অর্থাৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা। লক্ষ্মীর সরা, মনসা ঘট, চিত্রিত হাঁড়ি, রঙিন প্রতিমা, খেলনা পুতুল, রথচিত্র অলংকরণ, চালচিত্র, ছোটো-বড়ো মন্দির নির্মাণের পাশাপাশি গ্রাম্যশিল্পীরা শুরু করেছিলেন ধাতু পাত্রের উপর সরল চিত্রের অলংকরণ। ১৭৭০ সাল নাগাদ বিদেশি চিত্রশিল্পীদের আগমন। ১৭৮৫ সালে ক্যালকাটা গেজেটে প্রকাশিত বিদেশিরা ছবি আঁকা ও শেখানো দুই চালাতে শুরু করে। টমাস ড্যানিয়েল প্রকাশ করেন বাস্তব জীবন ও প্রকৃতির দৃশ্য নিয়ে ৮৪টি ছবি। এস সি বেলনোস সাধারণ জীবনযাত্রার ছবি প্রকাশ করেন তার “Manners in Bengal” বইতে। নানা সময় আলোচনার বিষয় হয়েছে অজন্তা রীতি থেকে আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুচিত্রের চর্চা। এসব দেখে ছবির বাজার বুঝেছিল কালীঘাটের শিল্পীরাও। যার ফল ঘটে পটের পুজোয় পটের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ছবির জগতে একটি মিশ্ররীতি; তথাকথিত একটি আধুনিক রীতির জন্ম দিল কালীঘাটের শিল্পীরা তাদের আঁকা ছবিতে।
১৮৫৪ সালে কলকাতার গরানহাটায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর্ট স্কুল—ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট। ততদিনে কালীঘাটের পট দেখে বিদেশিরাও থমকে গেছে। কালীঘাটে ব্যাপক ভাবে পট তৈরির শুরুটা প্রায় ১৮৩০ সাল নাগাদ। সমাজ সচেতক রসিক হৃদয় থেকে ঠাকুর ভক্ত যাত্রী এবং ছোটোদের হৃদয়কে আনন্দে ভরিয়ে দিতো এ পট। এক ব্যতিক্রমী শিল্পমাধুর্য নিয়ে এ পট। বাজারি ছবির এ বিশেষ ঘরনা কালীঘাট অঞ্চলে বিক্রি হতো বলে এ ছবিগুলি নাকরণ হয়েছে ‘কালীঘাট পেন্টিং’। মোটামুটি একশো বছর টিকেছিল এ ধারা। আর্ট স্কুলের চর্চাকে কেন্দ্র করে বাজারে এলো নানা ধরনের আরও সস্তায় হেটো ছবি। উত্তর কলকাতার বটতলা এলাকার চোরাবাগান আর্ট স্টুডিয়োর লিথোগ্রাফি এসেছে ১৮৭৮ সালে। কাঁসারি পাড়াতেও এ চর্চা গুরুত্ব পেয়েছে। অন্নদা প্রসাদ বাগচী আর্ট স্কুলে পাশকরা ছেলেদের নিয়ে বউবাজারে তৈরি করেছিলেন ‘ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিয়ো’। পাথর খোদাই লিথোগ্রাফির পাশাপাশি কাঠ খোদাই মুদ্রণ চিত্র ছবির জগতে অন্য ভাবে ধরা ছিল। রঙিন এ ছবিগুলি ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এসে গেল উন্নত প্রযুক্তিতে ছাপানো পট। হারিয়ে গেলো কালীঘাট পটের উজ্জ্বল ধারা। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে হারিয়ে যাওয়া। অবশ্য দু-একজন শিল্পী শখের এ চর্চা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বেশির ভাগ শিল্পী বেছে নিলেন অন্য হাতের কাজ। ছবির বাজার খুঁজতে কেউ কেউ ছুটেছিলেন নবদ্বীপ-সহ নানা তীর্থে। কিন্তু এ ধারার চর্চা আর নতুন করে দানা বাঁধেনি।
কালীঘাট পটের শিল্পী প্রসঙ্গে বাঁশরী ঘোষের ছেলে ইন্দ্রমোহন ঘোষ এবং তার ছেলে নিবারণ ঘোষ (১৮৩৬-১৯৩০ সাল) ও কালিচরণ ঘোষ (১৮৩৮-৩৫ সাল)-এর কথা উল্লেখ করতে হয়। এই সদগোপ পরিবারটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার গড়িয়া থেকে কালীঘাটে এসেছিল। কালীচরণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করতেন বলরাম দাস। নীলমণি দাস, ভাবনা দাস ও ভাবনা দাসের ভ্রাতুষ্পুত্র গোপাল দাস ছিলেন কালীঘাটপটের শিল্পী। কালীচরণ ঘোষের সন্তানরা হলেন কুমুদিনী, বলরাম, কানাই। আর দুই শিষ্যের একজন রেঙ্গুন চলে যাওয়া পরানচন্দ্র দাস এবং অন্যজন নবদ্বীপে চলে যাওয়া বলাই দাস বৈরাগী। নিবারণ ঘোষ ও বলরাম দাসের শিষ্য ছিলেন কালীঘাট পটের স্বনামধন্য শিল্পী রজনী চিত্রকর (১৮৯২-১৯৬৮ সাল)। রজনী চিত্রকরের সন্তানেরা হলেন রমানাথ পাল, শ্ৰীশ পাল, শম্ভু পাল। এর মধ্যে শ্রীশ পাল এ চর্চাকে ধরে রেখেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে এ ধারার শেষ শিল্পী হিসেবে। তার সন্তানরা হলেন নিখিল, অলোক, নিতাই। মেদিনীপুরের সুতাহাটা, আখপুর খেজুরতলা থেকে এসেছেন কালীঘাটে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার আকুবপুর থেকে কালীঘাটে আসা কার্তিক চিত্রকরের বংশধারায় আছেন গদাধর, গৌরাঙ্গ, গণেশ, প্রভাস, নারায়ণ এবং নারায়ণের ছেলে ধরণীধর ও মেঘনাদ। মেঘনাদের ছেলে উনিশ শতকের উদয় চিত্রকর। ওই একই সূত্র ধরে ভূষণ চিত্রকর। প্রাক্ উনিশ শতকের শিল্পী ছিলেন চিন্ময়ীলাল চিত্রকর। সমসাময়িক জনপ্রিয় শিল্পী মাথুর। মেদিনীপুরের চৈতন্যপুর আকুবপুর থেকে কালীঘাটে আসেন প্রাক্ উনিশ শতকের বরেন্দ্র চিত্রকর। বরেন্দ্র চিত্রকরের পুত্র পঞ্চানন চিত্রকর পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে শিবের রূপ ফুটিয়ে তুলতেন এক টানে। জহর চিত্রকরেরও নাম করতে হয়। উনিশ শতকের কুমার চিত্রকরের ছেলে কবিরাম চিত্রকর, তার ছেলে দুলাল আর দুলালের ছেলে ভাস্কর চিত্রকর কালীঘাট পটের গঠনশৈলীকে অনুকরণ করে আধুনিকতার রং ছড়িয়েছেন কিন্তু তা কালীঘাট পটের সমতুল্য হলেও সুন্দর।ঠিক যেমন এখানকার অনেক প্রতিমা শিল্পী কালীঘাট পটের অনুকরণে তাদের মতো করে পট এঁকেছিলেন। অনুপ্রেরণার অভাবে এবং বাজার চাহিদার অভাবে সেগুলিও প্রায় হারিয়ে গেছে পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পীদের জনপ্রিয়তার আড়ালে থেকে। সেগুলিও আর এক ধরনের সুন্দর। বর্তমানে কালীঘাট শৈলীর পট তৈরিতে দক্ষতা দেখিয়েছেন মুর্শিদাবাদের ঝিল্লির রাশি পটুয়ার নাতি রামপুর হাটের কালাম পটুয়া। অনেক পটুয়া-চিত্রকর কালীঘাট পটের অনুকরণে পট আঁকার ঝোঁক দেখাচ্ছেন।
বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে দ্রুত তালে এবং মাত্র কয়েক টানে মোটা কালো দাগ টেনে পটের বিষয় ফুটিয়ে তোলা হতো। আঁকা এবং রং করা এসব নিয়ে সমবেত প্রচেষ্টার সঙ্গে শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অপূর্ব মেলবন্ধন। কালীঘাট পটের শিল্পীরা জানে কেমন কাগজে কী রূপ গতিতে রঙিন তুলি চালনা করলে ঘন-পাতলা রঙের বিন্যাস ঘটে। তাদের জানা জল দিয়ে কীভাবে তুলির রং কাগজের উপর ফেলতে হবে। দক্ষ রেখার টান বহুমাত্রিক রঙের অভাব দূর করে দেয়। তবুও দর্শকদের নজর কাড়তে বিশেষ করে বাজারে আসতে থাকা সস্তার নতুন ধরনের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে দু-একটি রঙের প্রয়োগ ঘটান শিল্পীরা। পাতলা জল রঙের কাজেই মূল আকর্ষণ। আলতা আর ভূষো কালি প্রায় সব ঘরেই থাকতো। নীল আর হলুদের অভাব নেই। প্রাকৃতিক উপকরণ থেকেই তৈরি হতো আঠা ও রং। ঠাকুর রং করার গুঁড়ো রংও মাঠ-ঘাট থেকেই সংগৃহীত। এ চাহিদা মেটানোর জন্য রাজস্থান এগিয়ে। জার্মানি থেকে রং আসা শুরু হয় ১৮৫০ সাল থেকে। পাট ব্যবহৃত কাগজ হিসাবে চীনা কাগজ বা শ্রীরামপুরের পাতলা সস্তার কাগজ ব্যবহৃত হতো। বলাবাহুল্য, বাংলায় ভাতের মাড় ও আঁশতুলো দিয়ে কাগজ তৈরি করতেন শিল্পীরা। এদের বাসভূমি ছিল হাওড়ার আমতার কাছে। ময়না, মুর্শিদাবাদের কৃষ্ণপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর, হুগলীর শ্রীরামপুর, মোগাইপাড়া, মদনা, নেয়ালা, সাহবাজার। সাধারণ কাগজই ছিল ছবি ফুটিয়ে তোলার মাধ্যম।
শীতল মনোরম হস্ত কৌশলে অপূর্ব ছন্দ ভাবের প্রকাশ। প্রায় বৃত্তের ব্যাসের অভগ্ন ছাঁচে মোটা কালো রেখার নিখুঁত লম্বা টানে ফুটে উঠতো নারীর শান্ত ভাব বা উত্তেজক কামনীয় রূপ। পুরুষ দেহে গতিশীল শক্তি বা ভগ্নরূপ। কাঁধে শাল, বকলস আঁটা জুতো, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, বাবরি চুল, পটলচেরা চোখ, ধনুকাকৃতির ভ্রূ নিয়ে ‘বাবু পট’ হলো মূল আকর্ষণ। এ পটে থাকে সৌখিন চেয়ার, হুঁকো, তন্বি মেয়ে, নাটকের মঞ্চ-সহ অনুসঙ্গিক নানা ধরনের বা চরিত্রের খণ্ড দৃশ্য। মূর্তির রেখাগুলির গভীরতা ফুটিয়ে তোলার জন্য মূর্তির পেছনে অন্ধকার পরিবেশ তৈরি করা হতো, যেন রাতের অন্ধকার। আর আলোর মধ্যে অন্তরঙ্গ লাবণ্য ও বাবু সংস্কৃতির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা বা যৌনতা। রানির মুকুট যেমন সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, তেমনি ইঁদুরের মাথায় বিবির পা বা সাপের মাথায় ব্যাঙের নাচন দৃশ্য বেশ হাসির উদ্রেক করে। নানা চরিত্র কালীঘাট পটের বিষয় হয়েছে। মন্দির দর্শনে আসা ভক্তদের জন্য তৈরি হয়েছে হিন্দু দেবদেবী ও পৌরাণিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কিছু পট। যেমন রাসলীলা, কৃষ্ণলীলা, শিব-পার্বতী, কালী, নরসিংহ অবতার, কাকের পিঠে কৌমারী। পটের বিষয় হিসাবে ধর্মকথার বাইরে ঐতিহাসিক বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন লক্ষ্মীবাঈ, শ্যামাকান্তের বীরত্ব, শের খাঁ ও বাঘের লড়াইসহ নানা ঘটনা। সামাজিক বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে সাহেব পাড়া ও দেশি পাড়ার নানা ছবি। যেমন সতীর দেহত্যাগ, মাছকাটা, বর-কনে, স্ত্রৈণ স্বামী, মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার, বাবু-ভণ্ডদের বেলাল্লাপনা, বিবি সুন্দরী, সাহেব, গোরা সৈন্য। নানা চরিত্র নিয়ে নানা ব্যঙ্গ দৃশ্য তুলে ধরে সমাজ সচেতনতার চেষ্টা। আর শিশুদের নজরে পড়ার জন্য তৈরি হয়েছে পশু-পাখির নানা ছবি। ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে সাপের ব্যাং শিকার, বিড়ালের মাছ বা পাখি শিকার কিংবা লব-কুশের হাতে বন্দি হনুমান। তৈরি হয়েছে শিয়াল রাজার গল্প-চিত্র। অর্থাৎ নানা বিষয়। তাই আজকের শিল্পীরা অনুভব করছেন বিশ্বের বাজারে কালীঘাট পটের দাম আছে এবং চাহিদাও আছে। পটুয়া চিত্রকরের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত কালীঘাট পটের দিকে চোখ রেখে তার রহস্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। বিদেশিরা মজা পান সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত কালীঘাট পটে রঙ্গ রসিকতায় ফুটিয়ে তোলা বাবু চরিত্রের অধঃপতন দেখে। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামেই আছে ৬৪৫টি কালীঘাট পট। পশ্চিমবঙ্গে আই সি এস গুরুসদয় দত্তের সংগ্রহটি বেশ উল্লেখযোগ্য। সেদিন নানা ধারার শিল্পীরা বাঁচার জন্য কালীঘাট পটে হিসাবে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল; আর একশো বছর কাটতে না কাটতেই চিত্রশিল্পের নানা ধারার সংমিশ্রণ ঘটায় কালীঘাট পটের শিল্পীরা বাঁচার জন্য আবার অন্য মাধ্যমের আশ্রয় নিলেন। আর আজ চিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা বাঁচার জন্য কালীঘাট পট তৈরির চেষ্টা করছেন কিন্তু তা মূলত অন্য ধারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
চূড়ামণি হাটি