দ্বিতীয় পর্ব
ছৌ নৃত্যে যেসব পালায় মা দুর্গার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হল ” শুম্ভু – নিশুম্ভু ” বধ পালায়। পালার কথা পুরাণের হলেও এখানে পুরাণকে আনুপূর্বিক অনুসরণ করা হয় নি। পুরাণের কাহিনীর মূল কাঠামোটিকে যথাসম্ভব অক্ষুন্ন রেখে পালার কাহিনী বিন্যাস করা হয়েছে। কিন্তু, তাও সমাজের লোকচিন্তার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে , তা দেখা যায়।
সেই পালার কথা বলার পূর্বে ,ব্যাখ্যা করে নেব সেই পুরাণ কথাটি। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত মহাসরস্বতী দেবীর কথায় বলা আছে, পুরাকালে একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ কঠিন সাধনা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলে ব্রহ্মা তাঁদের বর দেন, কোনও পুরুষ তাঁদের বধ করতে পারবেন না৷ শুধু কোনও অ-যোনি সম্ভূত নারী তাঁদের বধ করতে পারবেন। অর্থাৎ এমন এক নারী, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেননি, তাঁর হাতেই এই দুই অসুর ভাই-এর মৃত্যু হবে। পৃথিবীতে এমন নারী কোথায়? আদ্যা শক্তি মহামায়াই সেই শক্তি। তিনিই দুর্গতির বিনাশিনী দুর্গা , তিনিই মহাকালের চক্রের চালনাকারিণী মহাকালী, তিনি পরম ব্রহ্ম স্বরূপ মহাশূন্যের শক্তি স্বরূপীনি , তিনিই সকল অশুভ নাশিনী। তাই তাঁর কোশিকা থেকেই উৎপন্না হলেন দেবী কৌশিকী। তিনি অপরূপা । তিনি কৃষ্ণাঙ্গী । তিনি সকল জ্ঞান ও বিদ্যায় পারদর্শীনী।
অশুভ মানসিকতা সম্পন্ন শুম্ভ নিশুম্ভ দেবীকে কামনা করে বসে। দেবী বলেন , যুদ্ধে যে জয়ী হবে সেই দেবীকে লাভ করবে। যুদ্ধ সূচিত হয়। দেবী কৌশিকী অযোনিসম্ভবা ছিলেন, সেই কারণে কৌশিকী দেবীই শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে দেবী কৌশিকীর শরীর থেকে হাজারো যোদ্ধৃ মাতৃকাকুল সৃষ্ট হয় এবং তাঁরাই সমগ্র অসুর সেনাকে বিনাশ করে দেন।
দক্ষস্য দুহিতা দেবী দক্ষযজ্ঞ বিনাশিনী |
রামস্য জানকী ত্বং হি রাবণধ্বংসকারিণী ||
চণ্ডমুণ্ডবধে দেবী রক্তবীজবিনাশিনী |
নিশুম্ভশুম্ভমথিনী মধুকৈটভঘাতিনী ||
ছৌ নাচের দুর্গা পালায় , দেবী কৌশিকী বা সিংহবাহিনী দশভূজা কেউই প্রবেশ করেন না। প্রথমে তাঁকে দেখা যায় দ্বিভূজা সাধারণ মানবী রূপে। সেখানে তাঁকে কৌশিকী নয় হিমালয় দুহিতা পার্বতী বলেই উল্লেখ করা হয়। তিনি হিমেল পর্বত পথে ভ্রাম্যমাণরতা । তাই পালার এই অংশে শিল্পীর নৃত্যের ভঙ্গি উদ্দাম হয় না। সংযত ভঙ্গিতে , ধীর ছন্দে নাচতে থাকেন। সুরের ছন্দও মোটেই দ্রুত হয় না। ধীর লয়ে সানাই বাজে। তার সঙ্গে সুর ,তাল ,লয় , ছন্দ মিলিয়ে বাজতে থাকে ধামসা মাদল , ঢোল –
গুড় গুড় গুড় ধা , গেড়েন ধা
গুড় গুড় গুড় ধা, গেড়েন ধা
গেদা গেদা ঘেন তা
তে তা খিটি তা।
ওদিকে দেবীর অলৌকিক সৌন্দর্য দেখে, তাঁর সঙ্গে অশুভ মনোভাবাপন্ন শুম্ভ নিশুম্ভ কুআচরণ করতে থাকে । তাই নৃত্য পালার মাঝে ঝুমুরের গানে শোনা যায় –
চিক্কুরাসুরের পুত্র দিগ্বিজয়ে যায়,
মা দুর্গাকে দেখে দৈত্য বিবাহ করতে চায়।
গায়ক ঝুমুরটি বলা মাত্রেই ঝড়ের বেগে শুম্ভ নিশুম্ভ আসরে প্রবেশ করে। শুভ নিশুম্ভ চরিত্রে অভিনয়কারী শিল্পীরা আসরে এসে তান্ডব নৃত্য শুরু করে দেন। নৃত্যের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের শৌর্যবীর্য, সাহস, ক্ষমতা প্রভৃতি ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কামনার অভিব্যক্তিও ফুটে ওঠে তাঁদের নৃত্য ছন্দে। দেবী দুর্গা রূপে অভিনয়কারী শিল্পী বুঝতে পারেন অভিসন্ধি। তিনি তখন বার বার অন্তর্হিতা হতে থাকেন। তারপর একেবারেই অন্তর্হিত হয়ে যান। এসময় মা দুর্গার নাচের ভঙ্গিতে আত্মরক্ষার ভাব মূলত প্রকাশ পায় ।অসুর রূপী শিল্পীরা তখন দেবীকে দেখতে না পেয়ে হতচকিত ও বিস্ময় বিমূর্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা তখন দেবীর অনুসন্ধান শুরু করেন। শম্ভু নিশুম্ভের উদ্দাম ও মাঝে মাঝে নৃত্যের ভঙ্গিতে ভাবটি সুন্দররূপে প্রকাশিত হয়। এই সময় বাজনার তাল ও সুর আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে –
উরর তা খেটে তাক্ , তিরি খিটিতা
তেতা গেদা গেড়েন , গেদা গেড়েন
উরর তাক তিরি খিটি তাক
উরর তাকে তিরি খিটি তাক
তেতা গেদা ঘেড়েন , গেদা গেড়েন।
দলের গায়ক তথা মূল ব্যক্তি ঝুমুর ধরেন –
হিমালয় যায় মাতা অস্ত্র সৃষ্টি তরে
হিমালয় পর্বতে মাতা দশভূজা ধরে।
দেবী নিজেই দশভূজা মূর্তি ধারণ করে ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর বাহন সিংহকে আহবান করে বলেন –
সিংহ সাজরে সাজরে
শুম্ভ নিশুম্ভ করিব নাশন।
সিংহকে নিয়ে দেবী দুর্গা সেখানে আসার আগেই পাঁচটি বাঘ এসে শুম্ভ-নিশুম্ভের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। দেবীর আদেশে সিংহ একলাফে এগিয়ে এসে দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে রনং দেহি মূর্তিতে দুর্গার আবির্ভাব হয় । শুম্ভু নিশুম্ভর সঙ্গে মা দুর্গার প্রচন্ড সংগ্রাম হয় । এসময় দুর্গার তান্ডব রণনৃত্য দেখে তাকে ভীমা ভয়ংকরী রুদ্রচন্ডী বুঝতে কোনোভাবেই ভুল হয়না । দ্রুততালে যুদ্ধের বাজনা বাজতে থাকে –
উরর তা খেটে তাকে
উরর তা খেটে তাক
তেরে খেটে তাক
তেরে খেটে তাক
গেড়েন , ধা ঘেন ধা , ঘেন ধা
গেড়েন ধা রেন ধা
গেড়েন ধা ঘেন তা, তেরে খেটে তাক্ তা।
গেড়েন ধা , গেড়েন ধা।
নাচের অন্তিম মুহূর্তে অসুরদের পরাজয় ঘটে । নৃত্য পালার একেবারে অন্তিম পরিণতি ঘটে বায়েনের ঝুমুর গানে –
অসুরের পরাজয়, সিংহের হইল জয় হে ….
ঢিমে তালে ঢোল , ধামসা বাজতে থাকে –
উরর ডেন তা ঘেন
উরর গেদা গেড়েন।
রর ডেন তা ঘেন
উরর গেদা গেড়েন।।
“মহিষাসুর বধ” পালা দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয় প্রায় অন্তিম মুহূর্তে । অবশ্য দুর্গার আগমনের পূর্বে পালার নাচ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় না। মহিষাসুর ব্রহ্মার দ্বারা প্রাপ্ত বর এবং আসুরিক শৌর্য বীর্য দ্বারা দেবতাদের নিকট হতে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিয়ে দেবগণকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করল। স্বর্গ হারা দেবগণ অশেষ দুঃখ কষ্ট , ক্লেশ ভোগ করলেন । তাঁরা শক্তি সঞ্চয় করে অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেও কৃতকার্য হতে পারলেন না। শেষে ব্রহ্মার নিকট মহিষাসুর বধের উপায় জেনে ভগবতী দেবী দুর্গার স্তব করলেন। আদ্যা শক্তি সন্তুষ্ট হয়ে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে স্বীকৃতা হলেন।বিভিন্ন দেবতাদের প্রদত্ত অমোঘ অস্ত্রে সুসজ্জিত দেবী যুদ্ধ যাত্রা করলেন। এই দুর্গা পালা পুরা কথা অবলম্বিত হলেও আনুপূর্বিক অনুসৃত হয় নি। লোকসংস্কৃতি স্বাভাবিক নিয়মে তা পরিবর্তিত হয়ে নাচে রূপায়িত হয়েছে…
পরাজিত দেবকূল সর্বশক্তিময়ী মা দুর্গার কৃপালাভের জন্য তাঁর আরাধনা করেন –
কোথা মাগো ভবানী , দৈত্যকুলনাশিনী
এ বিপদে রাখ মা জননী, ওমা ভবানী।।
ঢিমেতালে ও ধীর লয়ে সুর বাজতে থাকে –
তাক তাক তাক তেতা খেটে,
তাক তাক তাক তেতা খেটে
তাক তাক তাক তেতা খেটে।
অপরাজেয় মহিষাসুরের সঙ্গে দেবীর তুমুল সংগ্রাম শুরু হলো। যুদ্ধের তান্ডব নৃত্যের সঙ্গে উদ্দাম অঙ্গ চালানো ও পদক্ষেপে দর্শকদের মনে দারুণ উত্তেজনা ও উল্লাস। ঢোল ও ধামসার দ্রুততম তাল নৃত্যকে ক্রমশ অন্তিমের দিকে নিয়ে যায় –
গুড় গুড় ঝাঁ , ঝাঁ , গেড়ে ঝাঁ , তাক ঝাঁ , গেড়ে ঝাঁ,
তাক্ ঝাঁ , তাক্ ঝাঁ , তাক্ ঝাঁ , গেদা গেদা গেদা ঘিন গেড়েন।
গেদা গেদা গেদা , ঘেন , তা গেড়েন।
গুড় গুড় গুড় তাক্ , তাক্ তাক্ তাক্ , তেতে খেটে তা।
মহিষাসুর পরাজিত হলো। দেবী দশভুজার চরণতলে মহিষাসুরের বক্ষ ত্রিশূল বিদীর্ণ হল। হৃষ্ট চিত্তে দেবগণ স্তব করলেন দেবীর –
ওমা তারিণী ! তুমি মা জগৎ জননী,
দৈত্যকূলে বিনাশিলে হরের ঘরনি ।
পালা নৃত্যের পরিসমাপ্তির সুর বেজে উঠে সানাইয়ে , ঢোলে , ধামসায় –
গুড় গুড় দা ঘেন
গুড় গুড় গা ঘেন
গুড় গুড় দা ঘেন।
দা গেদা ঘেন ঝঁ
দা গেদা ঘেন ঝাঁ , দা গেদা ঘেন ঝাঁ ।
তা খেটে তা , তা খেটে তা, তা খেটে তা।।
পূর্ব এবং বতর্মান পর্বে উক্ত পালাগুলি ব্যতীতও আরো কিছু পালা ছৌ নৃত্যে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মা দুর্গাকে ভিন্ন রূপে ও ভিন্ন সাজে চরিত্রায়িত করা হয়। তার মধ্যে মিশে থাকে রাঢ় অঞ্চলের লোক সমাজ , চিন্তা ও বিশ্বাস। সেসব পালার বিষয় মহাভারত , রামায়ণ, মঙ্গলকাব্যাদি থেকে গ্রহণ করা হয়। যেমন – কিরাত অর্জুন পালা , শিবপুরাণ হতে ধুঁ ধুঁ রাসুর বধ পালা, রাবণ রাজা বধ পালা, বাণরাজার পালা ইত্যাদি। এগুলি নিয়ে বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ পুরুলিয়ার ছৌ – ছো নৃত্যে দুর্গা : নিমাই ওঝা