করোনা অতিমারির প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও নীতিগত ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন যে একটি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ধারণা — চলতি করোনা সংকট সেদিকেই নিশ্চিত রূপে ইঙ্গিত করছে। দ্বন্দ্ব-মুক্ত পৃথিবী বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব। সামাজিক প্রেক্ষিত ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম বিশ্বের উন্নত আর তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জন্য হাস্যকরভাবে একই হারে ফিসক্যাল ডেফিসিট অর্থনৈতিক নীতির সামগ্রিক দেউলিয়াপনার দিকেই ইঙ্গিত করে। কারণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রচুর পরিমাণে মূলধন প্রয়োজন এবং রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা উৎপাদন করতে না পেরে, আমরা যদি শুধুমাত্র বিদেশ থেকে আসা মূলধনের উপর নির্ভর করি, সে ক্ষেত্রে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে নৃতত্ত্ববিদ্যার পশ্চিমী সংস্করণ ‘one size fits all model’ কে বলপূর্বক অর্থনীতির আঙিনায় ঢোকানো হয়েছিল যার প্রধান ও প্রাথমিক শর্তই ছিল সমস্ত দেশ গুলিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, দর্শন এবং অনন্যতা পরিহার করে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ। ২০০৫ সালে জি-টোয়েন্টি নেশনস্ এই নীতির অসারতা কে তুলে ধরে এবং এর সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিটি দেশের তাদের নিজস্বতা অনুযায়ী উপযুক্ত আর্থিক নীতি থাকা উচিত বলে ঘোষণা করে। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য, এই একই কথা নব্বইয়ের দশক থেকে রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়িজী বারংবার বলে এসেছেন কিন্তু দেশের স্বঘোষিত পেশাদার বুদ্ধিজীবিরা যারা আধুনিকতা ও পশ্চিমীকরণকে হাস্যকরভাবে তাদের চিন্তাভাবনার দৈনতা দিয়ে একে অপরের পরিপূরক ভেবে থাকেন, সেই সব কেপ্ট্ বুদ্ধিজীবিরা দত্তপন্থজীর তত্ত্বকে চূড়ান্ত অবহেলা ও তাচ্ছিল্য করেছেন।
বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে আদর্শগত লড়াইয়ে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে এবং অর্থনীতিতে নতুন দিশা দেখাতে অপারগ এইসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা বিশ্বায়ন, পাশ্চাত্যকরণ এবং কিছু ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় তত্ত্বকে সামনে রেখে নির্লজ্জ চাটুকারিতা করে গেছেন। বাস্তবিক অর্থেই আজ সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট অর্থনীতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে বাতিলের খাতায়। চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিমী ধাঁচের বিশ্বায়ন, ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতিও প্রায় শেষের পথে। ঠিক এখানেই পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ভাবশিষ্য একাত্ম মানব দর্শনের একনিষ্ঠ ছাত্র রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়িজী’র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে Third way বা তৃতীয় পন্থার প্রাসঙ্গিকতা। Third way পুস্তকটির প্রকাশনার পর ভারতীয় তথা বিশ্বের ism-less বৌদ্ধিক জগতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দেয়। যেখানে মানসিক সত্তা বিসর্জিত আদ্যন্ত বস্তুবাদী পশ্চিমী অর্থনৈতিক দর্শনকে সন্দেহাতীতভাবে অসার প্রমাণিত করা হয়েছে। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনগুলি মানসিক পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক ভিত্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জনমানসে অনুসৃত হয়, নতুবা নয়। ভারতীয় সনাতনী ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ গুলি পশ্চিমী প্রকোষ্ঠ ভিত্তিক খন্ডিত মূল্যবোধের থেকে যে অনেক উন্নত তা আমরা ক্রমশ উত্থিত জাতীয় চেতনার দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হচ্ছি।
বস্তুগত উপাদান ও মানসিক উপাদান একই মুদ্রার দুই পিঠ। শুধুমাত্র কোন একটির উপর অত্যধিক অসম গুরুত্ব আরোপ করলে সমাজ জীবনে ভারসাম্যতা নষ্ট হয়ে বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বর্তমান বিশ্বে সর্বত্র মানবজাতির নিদারুণ যন্ত্রণা এরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাশ্চাত্য ধারণা অনুযায়ী জাতীয়তাবোধ ও আত্মনির্ভরতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সাথে সম্পূর্ণ বেমানান, যা অত্যন্ত বিপদজনক চিন্তন। হ্যাঁ, শুধুমাত্র বস্তুকেন্দ্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদ ঘৃণিত সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হতে পারে কিন্তু ভারতীয় একাত্ম মানববাদী দর্শনের একীকরণের মানসিকতা এক সমৃদ্ধ বিশ্ব রাষ্ট্রের উত্থানের কথা ভাবে, যা প্রত্যেকটি জাতির সংস্কৃতি, চিরন্তন মানবতাবাদ এবং বস্তুবাদ সহ সব কিছুকেই একসাথে গ্রহণ করতে সমর্থ; যেখানে অ-বস্তুগত মূল্যবোধ বস্তুবাদী মূল্যবোধের সাথে সূক্ষ্মভাবে মিশে থাকে। নিজ ঋদ্ধ সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে অন্ধভাবে পশ্চিমী অনুকরণ করতে গিয়ে আমরা বারংবার রেল বগির আগে ইঞ্জিন না জুড়ে, তার পেছনে ইঞ্জিন জুড়ে বৃথায় সভ্যতার চাকাকে ঠেলে চলেছি। এই মুহূর্তে আমাদের অবজেক্টিভ রেভোলিউশন কে বাদ দিয়ে সর্বাগ্রে সাবজেক্টিভ রেভোলিউশনের পথ বেছে নেওয়া উচিত।
করোনা পরিস্থিতি এবং বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান মৌলবাদী হিংসা ভারতবর্ষের সামনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে; যার জন্য দরকার জাতীয় পুনরুত্থান। সর্বাগ্রে প্রয়োজন আধুনিকতার নামে অন্ধভাবে পশ্চিমী সভ্যতা কে অনুকরণ বন্ধ করা। আমাদের সুপ্রাচীন ঋদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতি নজর ঘোরালেই সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব। যে সত্যের কোন দল নেই, শ্রেণি নেই, কোন বর্ণ নেই, কোন সম্প্রদায় নেই, নেই কোন জাতি; যা সত্যিই সর্বজনীন। কণাদ এর পারমাণবিক তত্ত্ব, কপিল মুনির দ্বন্দ্ববাদ, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করার আর্যভট্টের তত্ত্ব, বৃহস্পতির মেটেরিয়ালিজম্ এর উপর তত্ত্ব, পতঞ্জলি কর্তৃক বস্তুর সংজ্ঞা, বৈদিক মুনি-ঋষিদের দ্বারা সময়, স্থান এবং আপেক্ষিকতা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত ব্যাখ্যা গুলি আজও আধুনিকতার চরম নিদর্শন। এই বিষয়ে H.G. Chernyshevsky এর পর্যবেক্ষণ টি শিরোধার্য — “The principles explained & proved by the present day sciences were already found and taken to be true by the Greek philosophers, and much earlier, by the Indian thinkers.” চিরন্তন সত্য যা অস্বীকার করার কোনো উপায়’ই নেই, তা হ’ল হিন্দু বিজ্ঞান ও সভ্যতা আরব ও পারস্য হয়ে ইউরোপে পৌঁছেছিল এবং এর ফলেই ইউরোপে অন্ধকার দিনগুলি শেষ হয়ে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়।
বর্তমান সমস্যা সংকুল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নের হিন্দু সংস্করণ’ই একমাত্র পাথেয় হওয়া উচিত। ‘এক সমৃদ্ধ বিশ্ব রাষ্ট্র’ ই হল একমাত্র মুক্তির উপায়। এটিই প্রকৃত বিশ্বায়ন। কারণ প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমী শিল্পায়ন ও অর্থনীতির নির্বোধ আক্ষরিক অনুকরণ আমাদের উপহার দিয়েছে– গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে মানব প্লাবন, পরিযায়ী শ্রমিক, পরিবার প্রথা ভেঙে পড়া, গ্রামে চাষের জমি বহু বিভক্ত হওয়া, শহরাঞ্চলে অপর্যাপ্ত আবাসন, বস্তি, পানীয় জলের অভাব, শিল্পে দুর্ঘটনা, নিরক্ষরতা, মানব জীবন থেকে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়া, লিঙ্গ অনুপাতে ভারসাম্যহীনতা, আন্তর্জাতিক মৌলবাদ, পৈশাচিক জিহাদ ও সন্ত্রাস, দূষণ এবং চূড়ান্ত আর্থিক দুর্নীতি। চলতি বিশ্বায়ন এবং শিল্প-অর্থনীতি একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও আর্থিক কারচুপির প্রতিকার করতে, ক্রমাগত পরিবেশের শোষণ এবং ধ্বংস রুখতে, সমাজে সমতা আনতে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিদ্বেষ বাদ দিয়ে সহযোগিতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আনতে, ওয়েজ-এমপ্লয়মেন্টের পরিবর্তে সেল্ফ-এমপ্লয়মেন্ট কে সার্থকতা দিতে ব্যর্থ পর্যবসিত হয়েছে।
দেশহিতের ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত সনাতনী ঐতিহ্যে আস্থাশীল সাধারণ মানুষেরা আন্তর্জাতিকতার বিরুদ্ধে নয় বরং তারা চান জাতীয় স্বাবলম্বীতা; প্রতিটি জাতির আত্মসম্মান এবং ঐতিহ্য ও কৃষ্টি যেন বিশ্বমঞ্চে উপযুক্ত সম্মান পায়। প্রত্যেকটি দেশের অগ্রগতি ও বিকাশের মডেলটি সেই দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। চাপিয়ে দেওয়া সরলরৈখিক অর্থনীতি বহুমাত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসম্বন্ধ বিষয়। সুতরাং বহুধা প্রকোষ্ঠে বিভক্ত ও খন্ডিত পশ্চিমী চিন্তন-চালিত চলতি বিশ্ব অর্থনৈতিক নীতির সামগ্রিক কুপ্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করতে পারে কেবলমাত্র একাত্ম হিন্দু চিন্তন ভিত্তিক স্বদেশী নির্ভর অর্থনীতি। দত্তপন্থজী বলেছেন, “Swadeshi not merely an economic affairs confined to material goods but a broad based ideology embracing all departments of national life.” সবকা সাথ সবকা বিকাশ এর মতো মানবিক আবেদন কে সামনে রেখে দত্তপন্থ জী’র Third way বা তৃতীয় পন্থার আদর্শে নির্মিত স্বদেশী অর্থনীতির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন দিশার দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র শাশ্বত পথ। প্রকৃতিকে শোষণ নয় দোহন– এই নীতিতে আস্থা রেখে আমাদের সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পারস্পরিক বিশ্বাস, সামাজিক সুসংহতি এবং বিপদে সর্বতোভাবে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সনাতনী মানসিকতাকে পাথেয় করে স্বদেশী নির্ভর বিকল্প ম্যানুফ্যাকচারিং মডেল হয়ে উঠুক অর্থনীতির ভারতীয়করনের আদর্শ নিদর্শন।
ডঃ তরুণ মজুমদার
(লেখক পরিচিতি: ডঃ তরুণ মজুমদার, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ)
প্রবন্ধের সঙ্গে ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য।