গতবছর ঠেংড়ীজীর জন্মশতবর্ষিকী উৎযাপনের উদ্যোগ নিচ্ছিলাম। এক বামপন্থী বিচার ধারার মানুষ প্রশ্ন করলেন, আপনি জানেন, আপনাদের দত্তপন্থ ঠেংড়ী কখনো পুরস্কার গ্রহণ করেন নি, পারিতোষিক নেননি, বড় রাজনৈতিক পদ গ্রহণ করেন নি, মন্ত্রীসান্ত্রী হন নি। ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যক্তিপুজো, জন্মদিন পালনের বিরোধিতা করেছিলেন, নেতার নামে জয়ধ্বনির বিপক্ষে ছিলেন! আর আপনি ঘটা করে তার জন্মশতবর্ষ পালন করছেন! এটা কী ঠিক করছেন, কল্যাণ বাবু?
এর থেকে কী বুঝছেন? দত্তপন্থজীকে ভয় পাচ্ছেন ওরা। ভেবে দেখুন, আমাদের বিচারধারার মানুষেরা অনেকে দত্তপন্থজীর নাম শোনেন নি; কেউ শুনেছেন কয়েক মাস আগে, পড়াশোনা করা তো দূরের কথা! বামপন্থীরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই কোমর বেঁধে বসে আছেন কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করবেন বলে! তাই ওনার রচনা, দর্শন কিছু কিছু পড়েছেন।
হ্যাঁ, আমরা ব্যক্তিপুজো করি না, তবে চরিত্রপূজা করি। রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কোনো কার্যকর্তার দেখানো শুভঙ্করী পথের মণিমাণিক্যগুলি আহরণ করি। যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বৈচারিক পথকে পাকাপোক্ত করি। সেজন্যই জন্মশতবর্ষ পালন করি; প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করি, তুল্যমূল্য করি, কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিচার করি। তারজন্য সমকালীন এবং অধুনাতন ইতিহাস, সমাজ, দর্শন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করি। জন্মশতবর্ষ পালন করি পুরোনো ধুলো সরানোর জন্য। পুরাতন ঋণ শোধ করার জন্য। আজ যখন রাষ্ট্রঋষির জন্মশতবর্ষ পালন করবো তখন বিকাশের নিরিখে ঝালিয়ে নেবো নতুন শিক্ষানীতি, নতুন কৃষিনীতি, স্বনির্ভর ভারতরাষ্ট্র নির্মাণের ডাক, কৃষকের দ্বিগুণ আয়বৃদ্ধির ডাকও। তুল্যমূল্য করবো দত্তপন্থজীর উন্নয়ন-ভাবনার সঙ্গে বর্তমান ভারত সরকারের উন্নয়ন-যজ্ঞ একই পথে চলতে সক্ষম হচ্ছে কিনা!
আমরা নিশ্চিত ভবিষ্য-তত্ত্ব ছাড়া ইতিহাস পাঠ যেমন বৃথা (History without futurology would be fruitless), ভবিষ্য-তত্ত্বে ইতিহাসের শিক্ষা না থাকলে, তাও শিকড়হীন (Futurology without history would be rootless)।
উন্নয়ন নিয়ে পূঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মত ও পথ আলাদা। ঠেংড়ীজী ‘Third Way’ বা হিন্দুমার্গকে পুনরায় দেখালেন। এই পথে বিকাশ ও সমৃদ্ধির স্বাতন্ত্র্য কী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অবস্থান কোথায় — তার সুলুকসন্ধান, চিরস্থায়িত্ব, সার্বিক মাঙ্গলিক পথ পরিক্রমার কথা বললেন তিনি। এই শাশ্বত সত্যের পথ খোঁজার মধ্যেই তাঁর জন্মশতবর্ষ পালনের সার্থকর্তা। যখন বুঝবো সমন্বিত পথই হচ্ছে চিরস্থায়ী ও কাঙ্খিত অগ্রগতি ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য; যখন ভাবতে সক্ষম হবো যে প্রকোষ্ঠ-চিন্তন বা বেছে বেছে উন্নয়ন করানোটা এক মূল্যহীন অর্থনীতি, আত্মপরাজয়ের অর্থনীতি, তখনই তৃতীয় পথের রাস্তা পরিস্কার দেখতে পাবো আমরা৷ যখন প্রথম ও দ্বিতীয় পথের অসাড়তা চোখে পড়বে আমাদের কাছে, তখন বুঝতে পারবো বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের মধ্যে সমতা দরকার, সমন্বয় দরকার।
প্রথম ও দ্বিতীয় পথের গোলোক ধাঁধায় হারিয়ে গেলে চলবে না। অভিমন্যু চক্রব্যূহে ঢোকার পথ জানতেন, বেরোনোর পথ জানতেন না, তাই অভিমন্যু বধ হলেন। উন্নয়নের কাজ শিখতে দত্তপন্থজীকে হতে হয়েছিল কচ-দেবযানী উপাখ্যানের ‘কচ’। কীভাবে!
কমিউনিস্ট পরিচালিত ডাক ও তার বিভাগের ইউনিয়নে গিয়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি বনে গেলেন ঠেংড়ীজী। গুরুজীর সঙ্কেত ছিল। পৌনে দু’বছর সেখানে থেকে আন্দোলনের ভিতর প্রবেশ করে বুঝতে সক্ষম হলেন৷ ইউনিয়ন খাড়া করার সকল বিষয় জেনে বুঝে নিলেন। গুরুজির কাছ থেকে আবারও সঙ্কেত এলো — মধ্যপ্রদেশে গিয়ে ‘ইনটাক’-এ সামিল হলেন তিনি।
তখন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পন্ডিত দ্বারকা প্রসাদ মিশ্র। তিনি বুঝেছিলেন ঠেংড়ীজীর মত মানুষের সংগঠনে থাকাটা কতটা জরুরি। সেই প্রয়োজনীয়তায় তিনি মধ্যপ্রদেশে ‘ইনটাক’-এর মহামন্ত্রী মনোনীত হলেন। দুই-আড়াই বর্ষ ছিলেন কংগ্রেসের এই শ্রমিক সংগঠনে। সংগঠনের যাবতীয় বিচারধারা জানলেন, কাজ করার পদ্ধতি, সাংগঠনিক চর্চার সুযোগ হল। জেনে নেওয়া গেল, সঙ্ঘবিচার ধারায় শ্রমিক সংগঠন কীভাবে দাঁড় করানো যায়!
কচ-দেবযানীর আখ্যানে কী দেখি আমরা? গুরু শুক্রাচার্যের কাছ থেকে সঞ্জীবনী বিদ্যালাভ করার জন্য দেবতারা কচ-কে অসুর-পরিবৃত শুক্রাচার্যের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সাফল্যের সঙ্গে তা লাভ করে ফিরেছিলেন কচ। সংগঠন সঞ্জীবন মন্ত্র আহরণ করে ফিরেছিলেন ঠেংড়ীজীও। তৃতীয়পন্থার পাশাপাশি অন্য পন্থার সীমাবদ্ধতা জানলেন।
বলা হয় ঠেংড়ীজি একজন সামগ্রিক চিন্তক, সমাজ-মহীরূহরূপ-স্থাপত্যের স্বপ্নদর্শক, একজন উজ্জ্বল আরএসএস তাত্ত্বিক। গুরুজী, দীনদয়ালজীর পর এতবড় চিন্তনবিদ আসেন নি। সঙ্ঘের চিন্তানদীতে তিনি কেবল অবগাহন করেছিলেন তাই নয়, নদীকে বেঁধেও দিয়েছিলেন। আরএসএস সম্পর্কিত দৃষ্টিক্ষেপ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ডাক্তারজী, গুরুজী, দীনদয়ালজীর উপলব্ধি সম্প্রসারণ করেছেন। তিনি তাদের বাণীমূর্তি, রাষ্ট্র সাধনায় প্রামাণ্য মূর্ত বিগ্রহ। কেন এ কথা বলা হল?
কারণ, কোনো একটি ভাষা তার আপন ছন্দে এগিয়ে চলে। ব্যাকরণ তার পিছে পিছে ভাষাকে বাঁধতে বাঁধতে যায়। ভাষা একটি বহতা নদীর মতো৷ ব্যাকরণ হল তার দুই কূল বাঁধানো তীর। ডাক্তারজী, গুরুজী নদীর মতো; রাষ্ট্রঋষি হচ্ছেন তার বাঁধানো কূল। ডাক্তারজীরা কাদামাটি ছেনে মানুষ গড়েছেন, ঠেংড়ীজী তৈরি করে গেছেন তার ‘পাঠ্যপুস্তক’।
দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর উন্নয়ন-বোধ দাঁড়িয়ে আছে একাত্ম মানব দর্শনের আধারে। বৈষম্য বা খণ্ডিত চিন্তন নয়; অদ্বৈত বা একাত্মভাবের উপর। একাত্ম মানবদর্শনই মৌলিক বিচার; সমস্ত বিষয়বস্তুতেই একাত্মতার প্রচার প্রয়োজন — বিকাশতত্ত্বেও প্রয়োজন। ঠেংড়ীজী দীনদয়ালজীর একাত্ম মানবদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
প্রশ্ন হল মানবদর্শন কী? একটি মানুষ সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে ওঠেন যখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কার্যকরী, সুস্থ সবল থাকে। একটি ফুল তখনই মনোরম যখন তার প্রতিটি পাপড়ির অস্তিত্ব সুন্দর, নান্দনিক। তেমনই একটি সমাজ সার্থক, যখন তার প্রতিটি ব্যক্তিসত্বা পূর্ণ, পবিত্র এবং বিকশিত। সেজন্যই তো মনুষ্য নির্মাণ করতে হয়। ব্যক্তি সাধনা এবং সমাজ-সমষ্টির আরাধনা ভিন্ন নয়, ‘অহং’-এর মধ্যে ‘বয়ং’ সত্তা, ‘I’ -এর মধ্যে ‘We’-এর অনুসন্ধান, ‘আমার’ মধ্যে ‘আমরা’-কে বিরাজিত করালেই সেই সমাজ প্রবলগতিতে এগিয়ে চলে। সমষ্টির নিত্য অনুসন্ধান জরুরি। ভারতীয় সংস্কৃতি একাত্মবাদী, উন্নয়নও হবে একাত্মবাদের উজ্জ্বল উদ্ধারে। আপাত প্রভেদের মধ্যে তার অন্তর্নিহিত ঐক্য বিরাজমান। ধরতে হবে সেই ঐক্যের বাণী। বিরোধ, সংঘর্ষের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা, পরিপূরকতা এবং অনুকূলতা আমাদের নিত্যকালের সাধনা। উন্নয়ন-যজ্ঞেও এই একতারা খোঁজার নাম একাত্মমানবতাবাদী উন্নয়ন। সমাজকে প্রকোষ্ঠে ভাগ করবো না; আজকের ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর স্লোগান সেই অনুষঙ্গেই রচিত।
সঙ্ঘ এবং সমাজ সমাব্যাপ্ত। ‘অখণ্ডমণ্ডলাকারম’ — ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব একে অপরে বিলীন — এক বৃহৎ পরিবার। ঠেংড়ীজী বলছেন, পশ্চিম আজ ‘Globalisation’ বলে চীৎকার করছে, বিশ্বায়ন তো ভারতীয় কনসেপ্ট, হিন্দু হেরিটেজ — ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। “The whole earth is our family; we identified ourselves with the entire mankind, ourselves as part and parcel of the entire humanity.” ঠেংড়ীজী বলছেন, এখন গ্লোবালাইজেশনের কথা কারা প্রচার করছে? যাদের ইতিহাস ‘Imperialistic Exploitation’-এর ইতিহাস, শয়তানরা বাইবেলকে ‘quote’ করছে। তারা আমাদের গ্লোবালাইজেশন শেখাবে? বলছেন, বর্তমানের বিশ্বায়ন পূঁজিবাদের লোভ, লুঠ এবং শোষণের প্রতীক; স্বার্থজনিত লাভ পাবার অনর্গল প্রচেষ্টা, যেমন করেই হোক বাজারকে একচেটিয়াভাবে দখল করার চেষ্টা। ঠেংড়ীজী বলছেন স্বদেশী এবং সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি দেখতে হবে কোনো চাপের কাছে কোন দেশের স্বার্থ যেন বিনষ্ট না হয়। WTO (World Trade Organization বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) যখন তৈরি হল, তাতে বিশ্ববাণিজ্যের নিয়মাবলি Rules and regulations সবদেশের জন্য স্বচ্ছ ও সমান fair and equal ছিল না। তাই তিনি WTO -র বিরোধিতা করেছিলেন।
স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ যখন গঠন করলেন, বিদেশী পূঁজিপতিদের একটি পরিস্কার বার্তা দিলেন। বিশ্বের যা কিছু সম্পদ বা রিসোর্স, আমেরিকাকে বাদ দিলে, তা সবই রয়েছে সাউথ হেমিস্ফিয়ারে। ক্যাপিটাল যা আছে তা নর্থ-এ। যে দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, তা কেন পরমুখাপেক্ষী হবে? বিকল্প অর্থনীতির কথা এবং মার্গদর্শন করিয়ে তিনি লিখলেন, ‘Third Way’. ‘Preface of Hindu Economics’-এ তিনি পরিস্কার উল্লেখ করলেন, দেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাওয়া দরকার। তিনি Sustainable Development বা চিরায়ত উন্নয়নের কথা বলেছেন। Self-employment System-এর পক্ষে সওয়াল করেছেন, যা নেহেরু জামানায় রাশিয়াকে নকল করতে গিয়ে ভারতবর্ষে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আগে ভারতবর্ষের গ্রামগুলি সমস্ত পেশার মানুষের বসবাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল; নাপিত, ছুতোর, মুচি ছিল। এখন ‘হাবিব’ সারা ভারতবর্ষে সেলুন খুলে বসে পড়েছে। বহুজাতিক সংস্থা ‘বাটা’ জুতোর ব্যবসায় বহুদিন রাজত্ব করেছে। বড় বড় কোম্পানি ফার্ণিচার তৈরি করে, গ্রামের ছুতোরের কাছে যায় না, ছুতোরের ছেলে বড় ফার্ণিচারের দোকান করে না। আগে গ্রামে তন্তুবায়, কামার, কুমোর, স্যাঁকরা — সবাই থাকতেন। দত্তপন্থজী মনে করতেন, দরকার ছিল স্বাধীন ভারতে এদের সকলকে Skill development করিয়ে দেওয়া, মার্কেটিং-এর ব্যবস্থা করা; তা না করে নেহেরু রুশ মডেলে ITI গড়ে, কিছু আধা-কারিগর বানিয়ে শিল্পের জন্য নতুন ভারত গড়তে চাইলেন।
সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ং সম্পূর্ণ কাঠামো ভেঙ্গে পড়লো, কারিগর সমাজ নষ্ট হয়ে গেল। কারখানায় কাজের লোভে সামান্য ট্রেনিং নিয়ে ছাত্রেরা ছুটলো মাসকাবারি চাকরি করতে, কলের সস্তা জিনিস বাজারে এলো, গ্রামে কামারের জিনিস, কুমোরের জিনিস আর বিকোলো না। ঠেংড়ীজী বলতেন, দেশীয় জিনিস যদি সামান্য নিম্নমানেরও হয়, তাই পরম আদরে ব্যবহার করা দরকার।
আত্মনির্ভর ভারত গঠনের জন্য স্বদেশী চিন্তাচেতনার প্রয়োজন এসে পড়েছে। আর্থিকক্ষেত্রে দেখতে হবে অঞ্চলে অঞ্চলে সমীক্ষা করে কী কী করা যায়, কতটুকু আছে সেই অঞ্চলে, কতটুকু নেই, কতটুকু ছাড়াই দৈনন্দিন জীবন চলে যায়, কতটুকু সেই অঞ্চলেই উৎপাদন করে নেওয়া যায়।
১৯৭৯ সালের ৪ ঠা মার্চ রাজস্থানের কোটা শহরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ। তার ধ্যেয় বাক্য — ‘কৃষিমিত্ কৃষস্ব’, ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত, Do farming itself, শুধু কৃষিকাজই করো। কৃষিকাজ সনাতনী ভারতবর্ষের চিরায়ত সেবাকাজ, সম্মানের কাজ, আত্মনির্ভরতা ও আত্মগরিমার কাজ, ‘কৃষি’ থেকেই এসেছে ‘কৃষ্টি’ কথাটি। এর প্রতীক চিহ্নে বিশ্বভূমণ্ডলে অখণ্ড ভারতবর্ষে মানচিত্র, তাতে লাঙ্গলের চিহ্ন আঁকা। রাজনীতি বর্জিত অরাজনৈতিক সংগঠন করে তুলতে চাইলেন। কিষানের উত্থান ও উন্নতি ছাড়া যে পরম বৈভবশালী রাষ্ট্রের উত্থান সম্ভব নয় তা বুঝেছিলেন। কাজের লক্ষ্য স্থির হল — “দেশ-কা হাম ভাণ্ডার ভরেঙ্গে, লেকিন কিমত পুরা লেঙ্গে।” দেশের খাদ্য ভাণ্ডার ভরিয়ে তোলা হবে, কিন্তু কৃষক যেন পুরো দাম পায়। যদি নতুন কৃষি আইন রূপায়ণ করে কৃষককে দামের গ্যারান্টি দিতে পারি, ন্যায্য দাম তুলে দিতে পারি — তবে তা শতবর্ষে ঠেংড়ীজীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হবে।
দত্তপন্থজী ‘Swadeshi’-র সংজ্ঞা দিচ্ছেন, “as the practical manifestation of patriotism”. সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা, National Spirit আনা দরকার। সচরাচর আমরা স্বদেশী বলতে কেবল পণ্য ও পরিষেবাকে বোঝাই। তিনি বললেন, “Swadeshi not merely an economic affairs confined to material goods but a broad-based ideology embracing all departments of natonal life.” ‘স্বদেশী’ মানে আত্ম-নির্ভরতা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সামগ্রিক স্বাধীনতা বজায় রাখা।
স্বদেশী অর্থনীতিতে তিনি জোর দিয়েছেন —
১. মূল্যবোধ ভিত্তিক প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতা।
২. আর্থিক সমানতার সুযোগ
৩. প্রকৃতিকে শোষণ নয়, দোহন।
৪. আত্ম-রোজগার, স্ব-নিযুক্তি; বেতনভোগী কর্মচারী হয়ে ওঠা নয়।
ঠেংড়ীজী লিখছেন, প্রয়াগে নেহেরুর বাড়িতে গান্ধীজি গেছেন। নেহেরু গান্ধীজির হাতে জল ঢালছেন। কিছুটা জল হাতের বাইরে পড়লো। বিরক্তি প্রকাশ করলেন গান্ধীজি। নেহেরু বলছেন এটা আর এমন কি বড় কথা, আমাদের এখনো তো গঙ্গা বয়ে চলেছে৷ গান্ধীজি বলছেন, গঙ্গা তো কোনো একজন ব্যক্তির জন্য বইছে না। দুই তীরের মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা সকলের জন্য বয়ে চলেছে। গান্ধীজি বলতে চাইলেন, অতিরিক্ত জলের ব্যবহার বন্ধ করো। জল অপচয় কোরো না। ‘ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ’ গঠনের উদ্দেশ্য হিসাবে নানান বিষয়ের সঙ্গে বলা হয়েছে জলসহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ করতে হবে। ঠেংড়ীজীর অনুভব-কথনকে মান্যতা দিয়েই এটা করা হয়েছে।
প্রকৃতিকে শোষণ না করার কৃষিকাজ হল অর্গানিক ফার্মিং। ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ মনে করে জৈবিক ক্ষেতির ব্যাপকতা আমাদের আত্মনির্ভর করবে; কৃষিতে খরচ কমবে; সারের জন্য সরকারকে ভর্তুকির বিপুল টাকা গুণতে হবে না। বীজ-কীটনাশকের দাম ক্রমেই কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাঁর স্থাপিত কৃষক সংগঠন দাবী করছে National Seed Policy রূপায়ণের — বীজ কৃষকের অধিকার। কৃষক নিজের বীজ নিজেই তৈরি করে নিতে পারে, সরকারী খামার থেকেও যাতে বীজ পায়। ঠেংড়ীজীর স্বপ্নপূরণ করতে হলে আত্মনির্ভর কৃষি চাই। ভারতের গ্রামগুলিকে যথাসম্ভব উৎপাদনে, আয়োজনে, জীবনচর্যায় আগের মতোই সাবলম্বী করে তোলা চাই।
আর্থিক নীতি, সমৃদ্ধির দিক বদলের ক্ষেত্রে তিনি আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের সব কিছুকেই ভাবনার মধ্যে আনতে চেয়েছেন। পারিবারিক সিস্টেম, মূল্যবোধ, ভোগবাদের বৈপরীত্য, পরিবেশবান্ধবতা, সমাজের অ-সক্রিয় সদস্য যেমন শিশু, বৃদ্ধ ও দিব্যাঙ্গদের যত্ন; উন্নয়নের কেন্দ্রিকতা ও বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যেকার ভারসাম্য রক্ষা — সবই চিন্তনের মধ্যে রাখতে হবে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি যথাযথ প্রযুক্তি বা Appropriate Technology-র কথা বলেছেন। কোনো প্রযুক্তিকে চালু করতে হলে দেখে নিতে হবে তা পরিবেশ ও লোকবান্ধব কিনা, খরচ-সাশ্রয়ী কিনা, টেঁকসই কিনা। কারণ বারবার অ-সামঞ্জস্যের প্রযুক্তি বদল করা সম্ভব নয়।
Self sufficiency নয়, Nation self-reliance চাই; রাষ্ট্রের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব চাই; সকলের Basic needs পূরণের কথাও থাকবে — খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য; গ্রাম-শহরের উন্নয়নের মধ্যে অন্ত্যদয়ের কথা বলেছেন, অর্থাৎ সমাজের দুর্বলতম শ্রেণীকে তুলে ধরার কথা বলেছেন।
আমরা জানি, ঠেংড়ীজী ‘অখিল ভারত গ্রাহক পঞ্চায়েত’-এরও সংস্থাপক ছিলেন। শুধু কৃষক – শ্রমিকের কথা নয়, সমস্ত ভোক্তার কথাও ভেবেছেন তিনি, বলেছেন Consumer interest is closet to the national interest; সমস্ত আর্থিক বিষয়ে উপভোক্তার কথাও ভাবতে হবে। এই যে নতুন বিলে উৎপাদন ও উপভোক্তার মধ্যে যথাসম্ভব দালাল শ্রেণী বিলোপের চেষ্টা হয়েছে, তাতে কৃষক পণ্যের দাম বেশী পাবে তাই নয়, মধ্যসত্ত্বভোগীদের নানান হাত ঘুরতে হবে না বলে গ্রাহকও কমদামে কৃষিপণ্য কিনতে সক্ষম হবে। তিনি দাবী তুলেছিলেন ‘the selling price should be printed on every product and also the cost of production of that product’, কোনো শিল্পপণ্যের উৎপাদন মূল্য এবং বিক্রয় মূল্য লিখে দিতে হবে। এতে কী লাভ? দেশের উৎপাদক ও খুচরো বিক্রেতারা কী পরিমাণ লাভ ঘরে তুলছে, তার চালচিত্র পরিস্কার হবে আমাদের কাছে। বিদেশী পণ্যের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হলে বোঝা যাবে কত টাকা লাভ নিয়ে যাচ্ছে তারা। তিনি দাবী তুলেছিলেন কোম্পানিগুলি Cost Audit Report প্রকাশ করুক। এই রিপোর্ট যেন Bureau of Industrial Costs and Prices-এর কাছে জমা পড়ে, সকলের কাছে উপলব্ধ হয়, যে যা খুশি দাম ধার্য করবে — সেটা চলবে না।
অরাজনৈতিক ‘ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ’ যখন তৈরি করলেন, তার নীতিবাক্য রাখলেন, রাষ্ট্র কা উদ্যোগীকরণ Industrialize the nation, শ্রমিকন কা রাষ্ট্রীয়করণ Nationalize the labour, উদ্যোগন কা শ্রমিকীকরণ Labourize the Industry. এর মানে হল জাতীয় স্বার্থ সর্বাগ্রে থাকবে, Supreme interest. রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রথমে দেখা হবে, তারপর শিল্পস্বার্থ, এবং শ্রমিক স্বার্থ। কমিউনিস্টরা যেখানে শ্লোগান দেয়, “চাহে যো মজবুরি হো, হামারি মাঙ্গে পুরি হো” Whatever may be the difficulties, our demands must be fulfilled, সমস্যা যাই হোক, আমাদের মজুরি চাই। ঠেংড়ীজী মজদুর সঙ্ঘের শ্লোগান দেওয়ালেন, “দেশ কি হিত মে করেঙ্গে কাম,/কাম কে লেঙ্গে পুরে দাম”, দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করবো, এবং কাজের জন্য পুরো দাম নেবো, We will work in the interest of the country and take full wage for the work done.
শিল্প, কৃষি, নানান ক্ষেত্রে ভারতীয় বামপন্থীরা ‘Disguised Unemployment’-এর সূচনা করে গেছে, ছদ্মবেশী অকর্মসংস্থান বলে এটাকে। Two many workers are filling two few jobs. কলকারখানায় ভূ-স্বামীর জমিতে যে কাজটি ৫ জনে করে ফেলার কথা, তা করেছে ৮ জন। এই ৮-৫= ৩, এটি হল Disguised Unemployment; তাতে কোনো প্রকল্পই লাভের মুখ দেখতে পারে না, মুখ থুবড়ে পড়ে, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়। সার্বিকভাবে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়।
ঠেংড়ীজীর অর্থনৈতিক বিচার এবং উন্নয়ন অবধারণার মধ্যে যে চুম্বক, magnet, abstract, তা হল এটি একটি Hindu Paradigm. এখন উন্নয়নের পাশ্চাত্য ধারণা এবং হিন্দু বা প্রাচ্য ধারণার মধ্যে তুলনা করবো কীভাবে? ১৯৯৭ সালে তিনি ABVP-র জাতীয় কনফারেন্সে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই দুই উন্নয়ন ধারণার ফারাক তুলে ধরেছিলেন৷ তা বিন্দু আকারে পরিবেশিত হল —
১. পশ্চিমের চিন্তন প্রকোষ্ঠবদ্ধ, Compartmental; হিন্দুচিন্তন Integrated, সমন্বিত।
২. পশ্চিম কেবল ‘মেটেরিয়াল’-এর কথা বলে। এদেশ বলে Physical, mental, intellectual, spiritual — সার্বিক উন্নয়নের কথা।
৩. পশ্চিম জোর দেয় অর্থ, কামের উপর। পূর্বের জোর পুরুষার্থের উপর, চতুষ্ঠায়মের উপর।
৪. পাশ্চাত্যের কাছে Society বলতে আত্মকেন্দ্রিক মানুষের ক্লাব, হিন্দুচিন্তনে সমাজ বলতে সকলের অবস্থান, একটি দেহের মধ্যে থাকা নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন।
৫. একার সুখ নয়, উন্নয়নের চাবিকাঠি সকলের সুখে — “সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ”।
৬. পশ্চিমের উন্নয়নে অধিগ্রহণের কথা Acquisitiveness-এর কথা আছে। হিন্দু ধারণায় আছে অপরিগ্রহ, অগ্রহণ, মুক্ত থাকার কথা, Non possessiveness.
৭. পশ্চিম Profit motive (লাভ অভিসন্ধির) কথা বলে, বলে Consumerism-এর কথা, Exploitation-এর কথা; হিন্দু অবধারণায় Service motive (সেবার উদ্দেশ্য) আছে, ভোগের কথা নেই, আছে অন্ত্যদয়ের কথা, সমাজের শেষ মানুষটির মঙ্গলের কথা৷
৮. পশ্চিম right oriented-এর কথা বলে, অধিকার ফলানোর কথা; হিন্দু ধারণায় Duty-oriented-এর কথা আছে, কর্তব্যের ডাক, কর্তব্যের প্রেরণা।
৯. পশ্চিম কৃত্রিম দুষ্প্রাপ্যতার কথা শোনায়, তার নানান ছলাকলা; হিন্দু ধারণায় আছে উৎপাদনের প্রাচুর্য, স্বাভাবিকতা।
১০. একচেটিয়া পূঁজিবাদ জুড়ে থাকে পশ্চিমী ধারনার মধ্যে, বাজারের প্রতারণাও পাশ্চাত্য ধারণা। আর পূর্বে পুবের বাতাসের মত মুক্ত প্রতিযোগিতা free competition, কোনো ম্যানুপুলেটেড বাজারের স্থান নেই এখানে।
১১. মজুরির কর্মসংস্থান বা Wage-employment নিয়েই দিনাতিপাত পশ্চিমের, পুবের ব্যবস্থা ছিল স্ব-রোজগারের, Self-employment-এর।
১২. প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারার বর্ধিত মিছিল হচ্ছে পশ্চিমের অনুভূতি Western concept; বিশ্বকর্মার চির-উদ্ভব বা আপন পেশায় নিত্যদিনের কাজের মানুষ গড়ে ওঠা হিন্দু-ধারণা।
১৩. পশ্চিমী দুনিয়া প্রকৃতিকে ধর্ষণ করে, আর হিন্দু সমাজ প্রকৃতিকে দোহন করে; The milking of mother nature.
১৪. দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবক্তারা ব্যক্তি-সমাজ-পরিবেশের মধ্যে সবসময় দ্বন্দ্বই খুঁজে যায়। হিন্দু-উন্নয়নের ধারণার মধ্যে খোঁজা হয় হারমোনি, সমন্বয়।
ঠেংড়ীজী বলছেন আমরা প্রায়ই যে পরিভাষা শুনি যেমন — এজেন্ট, ব্র্যান্ড, কপিরাইট, ট্রেড নেম, লাইসেন্স, কোটা, প্রোটেক্টিভ টারিফ, কার্টেল, পুল, ট্রাস্ট, হোল্ডিং কোম্পানি, ইনকর্পোরেটেড বোর্ড অফ ডাইরেক্টস্, ইনকর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি — এগুলি সব পাশ্চাত্য থেকে আমদানি। ঠেংড়ীজী বলছেন আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদেরা অন্ধভাবে পশ্চিমী প্যাটার্ণ অনুসরণ করেছে৷ অথচ তারা স্বদেশীয় বৃদ্ধি তত্ত্বে (Growth Theory), দেশীয় প্রতিবেশে কাজ করতে সক্ষম, কিন্তু তারা তা করছেন না৷ তাদের চিন্তা নিজের চিন্তা নয়, ধার করা চিন্তা। দেশীয় অর্থনীতিবিদেরা পৌনঃপুনিক মানসিক ধারে ঋণী, Recurrent rent জমে আছে। এই ধার শোধ করতে পারলেই আত্মনির্ভর ভারত গড়া যাবে।
পশ্চিমী উন্নয়নের মডেল অনুসরণ করলে যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব হবে না৷ বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে “এক গাছের ছাল/ আর গাছে লাগে না”, অর্থাৎ সামঞ্জস্য বা compatibility-র অভাব হয়। যা কিছু বিদেশী তত্ত্ব, প্রযুক্তি আনলেই দেশ সমৃদ্ধ হবে না। নতুন শিক্ষানীতিতে ক্লাস সিক্স থেকেই পেশাগত/কারিগরি শিক্ষার কথা আছে। অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে ছাত্রেরা কাজ শিখবে, খানিকটা আয় করতে শিখবে। কৃষক সন্তানকে ‘চাষা’ বলে অপমান করেছি, সেই অপমানের প্রায়শ্চিত্ত করছি এখন, কৃষককে ন্যায্য দাম দিই নি, ফড়ে-দালালশ্রেণীতে ভরে গেছে বাজার। কৃষিতে লাভের অঙ্ক ভুলে গেছে চাষী, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে কৃষকের ছেলে দূরে চলে গেছে, গাঁয়ের ছেলে শহরে রিক্সা টানে তবুও চাষ করে না। ঠেংড়ীজী যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতীয় কিষানকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন, তার স্বরূপ সন্ধান করে যদি তা বাস্তবায়ন করতে পারি, তবে দেশ স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাবে, দত্তপন্থজীর জন্মশতবর্ষ পালন সার্থক হবে।
কল্যাণ গৌতম
(লেখক পরিচিতি: বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ)
প্রবন্ধের সঙ্গে ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য।