নীচু এবং মাঝারি নীচু জমির উৎপাদনশীলতা এবং আয় বৃদ্ধি করবেন কীভাবে?

নিম্ন গাঙ্গেয় এলাকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৬০০ মিলিমিটারের মতো। আর সেই বৃষ্টির বারো আনাই বর্ষার কয়েকটি মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সময় অতি বৃষ্টি এবং বন্যার ফলে ফসল নষ্ট হওয়া এক নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাছাড়া প্রযুক্ত সারের কার্যকারিতা ঠিক মতো পাই না বলে উৎপাদন মার খায়। নীচু এবং মাঝারি নীচু জমিতে সাধারণত বর্ষার সময় ধান চাষ করা হয়। ধান উঠে যাওয়ার পর রবি ফসল চাষ করা সেখানে একটা বড় সমস্যা। যদি দেরিতে বৃষ্টি হয় তাহলে অতিরিক্ত মাটির রসের কারণে রবি ফসল চাষ করা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দেরিতে চাষ করলেও সেখান থেকে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া যায় না। যদি সেচের সুবিধা থাকে তাহলে অনেক সময় এই সকল জমিতে বোরো ধান চাষ করা যেতে পারে। সার্বিক ভাবে এই ধরনের জমিগুলো এক ফসলি, কদাচিৎ দ্বি-ফসলি হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গের নব্বই শতাংশ জমির মালিক ক্ষুদ্র অথবা প্রান্তিক। সেক্ষেত্রে এই ধরনের ভূ-বিন্যাসে যে সকল চাষী চাষবাস করে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ খুব কষ্টকর হয়ে ওঠে। শস্য বৈচিত্রায়নের মাধ্যমে এই সকল জমিতে ফুল, ফল ও সব্জি চাষের ব্যবস্থা করতে পারলে চাষীদের মুখে হাসি ফোটাতে পারা যাবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে জমির চরিত্র অবিকৃত রেখে এই সকল জমিতে অধিক আয়ের ফসল চাষ প্রায় অসম্ভব। তাহলে উপায়?

উপায় অবশ্যি আছে। এই সকল জমিতে ভূমি উন্নয়ন-অবনয়ন অর্থাৎ ল্যাণ্ড শেপিং (Land shaping) প্রযুক্তি প্রয়োগ করে জমির ফলন এবং আয় বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের land shaping প্রযুক্তি বিভিন্ন কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলি উদ্ভাবন করেছে। তাদের মধ্যে Raised bed and sunken bed (RSB) প্রযুক্তি (উত্থিত কেয়ারি ও প্রোথিত আলোকিত কেয়ারি) নিম্নগাঙ্গেয় অঞ্চলের পলিমাটি এলাকায় সহজে অবলম্বন করা যায়। এই প্রযুক্তি গ্রহণ করাটা আজ শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই প্রযুক্তি বাস্তবসম্মত; প্রচুর পরিমাণে অধিক মূল্যের কাঁচা ফসল ফলানো যায়, তা বিক্রি করার জন্য বিরাট বাজারও কাছাকাছি এলাকায় রয়েছে। এই প্রযুক্তি অবলম্বন করে ফসল চাষের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে এই ধরনের ভূ-বিন্যাসে অতি-বৃষ্টি, নাবি-বৃষ্টি (দেরীতে বৃষ্টি) এবং বন্যার ফলে ফসল নষ্ট হওয়া এক নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। এই আরএসবি (RSB) প্রযুক্তি অবলম্বন করে এই ধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। তাছাড়া সাঙ্কেন বেডে জল ধরে রেখে শুখা মরশুমে সেচের ব্যবস্থার সুযোগ থাকছে

আরএসবি প্রযুক্তির বহুমুখী সুবিধা বিচার বিশ্লেষণ করে চাষীদের মধ্যে সেটা প্রয়োগ করার লক্ষ্যে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকা সর্ব ভারতীয় সমন্বিত গবেষণা প্রকল্প — সমন্বিত চাষাবাদ-তন্ত্র (AICRP on IFS, BCKV) এর তরফ থেকে ২০১২ সাল থেকে আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র, গয়েশপুরে (২১°৮৩’৯৮১” L ও ৮১°৪২’৩২৩”) একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা চলছে। এই গবেষণায় রেইজড+সাঙ্কেন (১:১) বেডে বা কেয়ারিতে পাঁচ ধরনের শস্য পর্যায় নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সাথে তুলনা করবার জন্য এই ধরনের জমিতে জনপ্রিয় ধান-ধান পর্যায়কে (১নং সংযোজন) রাখা হয়। প্রত্যেক সেটের আয়তন ৪০০ বর্গ মিটার [(৫ মি X ৪০ মি) X ২ ] অর্থাৎ প্রত্যেক সাঙ্কেন বা রেইজড বেড ৫ মিটার চওড়া এবং ৪০ মিটার লম্বা এবং সাথে ১০ মিটার X ৪০ মিটার ধান-ধানের জন্য বরাদ্দ করা হয়। সাঙ্কেন বেডের ৫০ সেমি মাটি কেটে পাশের রেইজড বেডের নির্ধারিত জমিতে ফেলা হয়। ফলে নীচু জমির গভীরতা ১ মিটার হবে। এর ফলে উঁচু জমিতে অর্থকরী সব্জী, ফল এবং ফুলের চাষের সুযোগ তৈরি হয়। অন্যদিকে নীচু জমিতে ধানের সাথে মাছ চাষের উপযুক্ত পরিবেশ দেখা দেবে। এই গবেষণায় উঁচু জমিতে উচ্চ মূল্যের বিভিন্ন ধরণের সব্জিচাষ করা হচ্ছে এবং নীচু জমিতে বর্ষায় ধান+মাছ/শোলা কচু চাষ হচ্ছে, বোরো মৌসুমে হয়েছে ধান চাষ। উঁচু জমির ধার দিয়ে হাইব্রিড নেপিয়ার লাগিয়ে একদিকে ভূমিক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়েছে, অন্যদিকে প্রচুর সবুজ গোখাদ্য পাওয়া গেছে। এই গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেছে সর্বোচ্চ ধানের সমকক্ষ ফলন (৬২৬ কেজি / ৪০০ বর্গ মিটার) লালশাক + ঝিঙা – মূলো + বেগুন (৩ : ২) – ঢেড়স + বরবটি (২ : ৩) রেইজড বেডের ফসল পর্যায়ের সাথে সাঙ্কেন বেডের ধান + মাছ – মাছ পর্যায় থেকে পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম ধানের সমকক্ষ ফলন স্বাভাবিক ধান – ধান চাষ করে পাওয়া গেছে। আয় ব্যায় হিসাব করে দেখা গেছে সর্বোচ্চ নিট লাভ (Rs.৫১৩৪/- প্রতি ৪০০ বর্গ মিটার) লালশাক + ঝিঙা – মূলো + বেগুন (৩ : ২) – ঢেড়স + বরবটি (২ : ৩) রেইজড বেডের ফসল পর্যায়ের সাথে সাঙ্কেন বেডের ধান + মাছ – ধান পর্য ায় থেকে পাওয়া যায়, যেখানে প্রতি ১ টাকা খরচ করে ২.১৫ টাকা ফেরত পাওয়া যায়। অপর দিকে প্রচলিত বর্ষা এবং বোরো মৌসুমে দুবার ধান চাষ করে ১ টাকা ব্যায় করে ১.০৫ টাকা ফেরত পাওয়া যায়। সামগ্রিক ভাবে চাষীর আয় ব্যায়ের কথা মাথায় রেখে বলা যেতে পারে মাঝারী এবং নীচু জমির জন্য এটা একটি খুব সুন্দর কার্যকরী প্রযুক্তি।

(ডঃ মানবেন্দ্র রায়, সহযোগী অধ্যাপক, শস্য বিজ্ঞান বিভাগ, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোহনপুর, নদীয়া, 741235, ইমেইল:[email protected])

ডঃ মানবেন্দ্র রায় (Dr. Manabendra Roy)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.