কয়লা খনি, ইস্পাত এবং সিমেন্ট কারখানা সহ অন্যান্য অনেক শিল্প সমৃদ্ধ ব্যস্ত শিল্পাঞ্চল এর পাশাপাশি আসানসোল একটি প্রধান রেলওয়ে হাবও। যার পশ্চিমে সীমান্তবর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ড। রাজ্যের ৪২ টি সংসদীয় অঞ্চলের মধ্যে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রটি বাংলার অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এবং দেশের ভিন্ন ভিন্ন এলাকার অধিক সংখ্যক মানুষ বাস করে এখানে।
কিন্তু এরই পিছনে রয়েছে শুধু তীব্র রাগ, ঘৃণা, অসন্তোষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যার ফলে সাম্প্রদায়িক হিংসা, রক্তাক্ত শত্রুতা এবং আরও খারাপ ঘটনার প্রাদুর্ভাব ঘন ঘন দেখা যায়। শক্তিশালী মাফিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অবৈধ কয়লা খনি, অবৈধ বালি খাদান এবং অবৈধ কসাইখানা থেকে উপার্জিত কালো অর্থনীতি দ্বারা এলাকাটি চালিত হয়। এগুলি সাম্প্রদায়িক অবক্ষয় কে যেমন উৎসাহিত করেছে তেমনি বাড়িয়ে দিয়েছে অপরাধমূলক কার্যকলাপের পাশাপাশি রাজনীতি ও সমাজের অপরাধ প্রবণতাকে।
বাংলার এই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের অধিবাসীদের মতে ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি আরও খারাপ হয়ে গেছে।
মাফিয়া প্রভাব
প্রায় ১,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত অবৈধ কয়লা খনি থেকে বছরে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা উৎপন্ন হয়। প্রতিদিন আনুমানিক ২৫,০০০ টন কয়লা অবৈধভাবে খনি থেকে বের করা হয়। বছরে আনুমানিক ২,০০০ কোটি টাকা উৎপন্ন হয় নদী গর্ভ থেকে অবৈধ বালি খনন করে ।
ভারতের প্রথম ইস্পাত কারখানা ইস্কো এবং রেল থেকে নির্গত বিভিন্ন স্ক্র্যাপ নিলামে ৪,০০০ কোটি টাকার বেশি উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে বেশিরভাগই অবৈধ ও মাফিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । অবৈধ কসাইখানাগুলি থেকেও বিপুল অর্থ উৎপন্ন হয়। এছড়াও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলাবাজির মাধ্যমে মাফিয়া ডন এবং অপরাধ সিন্ডিকেট গুলি বছরে ২৫,০০০ কোটির বেশি উপার্জন করে। ছোট এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত মাফিয়া ডন গ্যাংগুলি এই সমস্ত অবৈধ ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
যদিও এই মাফিয়াদের অপরাধ মূলক ক্রিয়াকলাপগুলির কীভাবে সম্পাদন করে তা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে না।শিল্পপতি, এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুরক্ষা অর্থের বিনিময়ে তোলাবাজির ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্মাণ ব্যবসার ক্ষেত্রে আছে সিন্ডিকেটের বাড় বাড়ন্ত এবং সাধারণ মানুষ সহ সবাইকে সিন্ডিকেটগুলি থেকে বেশি দামে নির্মাণ উপকরণ এবং শ্রমিক নিতে হয়।
এর ফলস্বরূপ প্রচুর কালো টাকা উত্পন্ন হয় এবং অপরাধ মূলক ক্রিয়াকলাপগুলি উত্তরোত্তর বেড়েছে। কালো টাকা অপরাধ মূলক কাজে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই অপরাধ করে আবার কালো টাকা উৎপন্ন হচ্ছে এবং এই ক্ষতিকারক চক্রটি আসানসোলের সংগঠিত অপরাধের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। আসানসোলের বেশিরভাগ জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা মেনেচলা সাধারণ নাগরিকদের জন্য বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে এবং তারা অপরাধীদের থেকে দূরে থাকার উদ্দেশে অনেক জায়গায় যাবার বিষয়টি এড়িয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক বিভক্তি
আসানসোলের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ বাঙালি হিন্দু, হিন্দিভাষী হিন্দুরা প্রায় ৩৫ শতাংশ আর মুসলমানরা মাত্র ২০ শতাংশ। হিন্দুরা একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার কারণে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র শত্রুতার কারণের অবকাশ নেই।
তবুও হিন্দুদের মধ্যে একটি গভীর ছত্রভঙ্গ অবস্থা বিদ্যমান, এবং এর প্রধান কারণ সবরকম অবৈধ এবং অপরাধমূলক কার্যক্রম মুসলমানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। একজন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) -এর সাথে যুক্ত সামাজিক কর্মী বলেন, সব মাফিয়া ডন মুসলমান এবং তারা মুসলমানদের সুরক্ষা প্রদান করছে এবং হিন্দুদের সাথে আগ্রাসী হওয়ার জন্য তাদের উৎসাহ দিচ্ছে।
বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক এই মুসলিম মাফিয়া ডনরা এবং তাদের সহযোগীরা হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে আসানসোল জুড়ে জমি ক্রয় করে চলেছে। মুসলিম অভিবাসী বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গারা সেখানে বসতি স্থাপন করতে সাহায্য করছে। বসতি স্থাপনকারী মুসলমান অভিবাসীরা সাধারণত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ যারা কুৎসিত পরিবেশ সৃষ্টি করে। হিন্দু মেয়েরা তাদের ‘লাভ জিহাদ’এর পরিকল্পনার শিকার হচ্ছে এবং নারীদের হয়রানি এবং ইভটিজিং জুটছে। একবার একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় জমির একটি বৃহৎ অংশ তাদের হাতে চলে গেলে, হিন্দুদের ঐ এলাকায় বসবাস করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ছে। শীতলা দাঙ্গাল ও আকুরিয়াপাড়া র মতো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসানসোলের অনেক এলাকাগুলি মুসলমান-সংখ্যাগুরু এলাকায় পরিণত হয়েছে।
হিন্দুদের রাগের কারণ
যেখানে তারা কয়েক দশক ধরে বসবাস করছিল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তেমন বহু এলাকা থেকে হিন্দুদের সরে যেতে হয়েছে। এর ফলে হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্তি সৃষ্টি হয়েছে। মাফিয়া ডন মুসলমান এবং তাদের লালন পালনকারী পেশীশক্তিও তাদের সহ-ধর্মাবলম্বীদের হওয়ার কারণে আসানসোলের বেশিরভাগ অপরাধের নিয়ন্ত্রক মুসলমানরা।
আসানসোলের বসবাসকারী একজন প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন রেল অফিসারের মতে, মুসলমানদের হাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ এবং বিপুল অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে এবং সেইকারণে তারা রাজনৈতিক দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেচলেছে। এর আগে সিপিএম ক্ষমতায় থাকার সময় এই পৃষ্ঠপোষকতায় যে রাখঢাক ছিল তৃণমূলের শাসনে সেটা এখন আনেক খোলামেলা এবং উজ্জ্বল।
আগে সিপিএম এবং এখন তৃণমূল আসানসোলের অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতার করার কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থবল বৃদ্ধিতে অনেক অবদান রাখে। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ মুসলিম লোক দরিদ্র শ্রেণীর হওয়ায় তারা মাফিয়া ডনদের দেওয়া আদেশে কোনও বিশেষ দল বা প্রার্থীকে ভোট দেয় এবং সম্প্রদায়টি একটি মূল্যবান ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অতীতের নির্বাচনী ফলাফল বিশদে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় ভোটারদের একটি প্রার্থী বা দলের জন্য ব্লক ভোটার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গত আট বছরে মুসলমানদের তুষ্টিকরণের জন্যও হিন্দুদের মধ্যে বিরক্তি ও ক্ষোভ ফুটে উঠেছে।
২০১১ সালের পর থেকে চাকরি ও বিভিন্ন সমাজকল্যাণ প্রকল্পগুলিতে মুসলমানদের অগ্রাধিকার বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আসানসোলের চাঁদমারী শ্রীনগর এলাকার বিপিএল হাউজিং স্কিমের প্রায় সকল সুবিধাভোগী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একজন ভিএইচপি কর্মকর্তা বলেন মুসলমান অপরাধীদের প্রতি পুলিশও একটু সদয় হয়ে তাকায়।
আসানসোলের অধিবাসীদের অভিযোগ মুসলমানরা রেলওয়ে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্কোর বিপুল পরিমাণে জমির অবৈধ দখল করেছে। আসানসোলের আদি অধিবাসী একটি টেলিকম কোম্পানীর অফিসার জানান রেলওয়ের প্রায় ৮৬ বিঘা জমিতে একটি নতুন অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে যা অপসারণের পরিবর্তে রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ সহ অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য সড়ক নির্মাণ করেছে। তৃণমূল সরকারের মুসলমানদের প্রতি এই রাজনৈতিক তোষণ বাড়ার কারণে হিন্দুদের মধ্যে বিরক্তি এসেছে এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ উজ্বল হয়েছে।
এক অটোমোবাইল লুব্রিকেন্ট ব্যবসায়ী বলেছেন যে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও তাদের সংখ্যার চেয়ে তাদের কালো টাকা এবং প্রচুর অস্ত্রের শক্তি অনেক বেশি। রাজনীতিবিদরা ও তাদের মূল্যবান ভোট ব্যাংকের কারণে তাদের পকেটে বন্দী।
আসানসোলের বস্তিবাজার এলাকায় দুর্গা মণ্ডপ এর বিষয়টি হিন্দুদের কাছে একটি দুঃখজনক এবং বারংবার মনে কষ্টের কারণ। আগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ছিল বস্তিবাজার, কিন্তু গত চার দশক ধরে মুসলমানরা সেখানে সংখ্যাগুরুতে পরিণত হয়েছে। কয়েক দশক আগে হিন্দুরা প্রতি বছর মণ্ডপটিতে দুর্গা পূজা শুরু করেছিল এবং পরবর্তীকালে লক্ষ্মী পূজা ও কালী পূজাও শুরু হয়।
গত কয়েক বছর ধরে, হিন্দুরা মণ্ডপটিকে স্থায়ী মন্দিরে রূপান্তরিত করে দুর্গার মূর্তি স্থাপন করতে চাইলে মুসলমানরা আপত্তি করে এবং প্রশাসনের অনুমতি মেলেনা। স্থানীয় মুসলমানদের নির্দেশে প্রশাসন নিয়মিত পূজাও বন্ধ করেছে আর মণ্ডপটি তালা চাবি দিয়ে আটকে রেখেছে। কেবলমাত্র বার্ষিক দুর্গা, লক্ষ্মী ও কালী পূজাগুলির মধ্যে মণ্ডপের দরজা খোলা হয়। মুসলমানরা যাতে না চটে এই অজুহাতে এমনকি পূজার সময় শাঁখ, ঢাক কিংবা ঘন্টা বাজানোর অনুমতি দেওয়া হয় না। স্পষ্টতই এটা হিন্দুদেরকে রাগতে সাহায্য করেছে।
প্রচলিত বার্ষিক রাম নবমীর পদযাত্রা এলাকার প্রাথমিক সাম্প্রদায়িক বিষয় হয়ে উঠেছে। “ঐতিহ্যগত এবং প্রথাগতভাবে হওয়া পদযাত্রার অনেকগুলি পথ মুসলিম সংখ্যাধিপত্যপূর্ণ এলাকা হয়ে উঠেছে এবং তারা এই পদযাত্রায় আক্রমণও করেছে। অপরদিকে প্রশাসন মুসলমানদের আনন্দিত করার জন্য রাম নবমীর পদযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা মুসলমানদেরকে আরো আক্রমনাত্মক হতে উৎসাহিত করেছ্যা। আসানসোলের বিভিন্ন অঞ্চলে খোলাখুলি গো হত্যা এবং মাংস বিক্রি হিন্দুদের রাগ বাড়াতেও সাহায্য করেছে।
শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক বিভক্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তৃণমূলকে দায়ী করলেও দুর্ভাগ্যের বিষয় মুসলমান সম্প্রদায়ের কয়লা, বালি ও গবাদি পশু মাফিয়াদের সাথে তৃণমূল নেতদের গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ার কারণে ঐ অঞ্চলের অপরাধমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা সত্য যে অনেক মুসলমান অপরাধে জড়িত হচ্ছে এবং তারা পুরো সম্প্রদায়ের নাম খারাপ করছে। ইসলাম অপরাধকে ঘৃণা করে এবং অপরাধ থেকে উপার্জনকে হারাম হিসাবে মনে করে। সুতরাং, এই মাফিয়া ডন এবং অপরাধীরা প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন একটি সিমেন্ট কোম্পানির আধিকারিক শাফী কুরেশি , যার বাবা আসানসোলের একজন বিশিষ্ট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়াতেন এবং ঠাকুরদা রেলওয়েতে কাজ করতেন। মুসলমানদের প্রতি অযৌক্তিক অনুগ্রহ এবং পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করা সরকারের ভুল, যেহেতু এটি অমুসলিমদের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি করে এবং সম্প্রদায় গুলিকে বিভক্ত করে দেয়। কিন্তু তৃণমূল সরকার তার সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের জন্য এটি করছে যা সমাজে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী ক্ষতির কারণ হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
নির্বাচনী এলাকার রাজনৈতিক অবস্থান
আসানসোল লোকসভা আসনটি পশ্চিম বর্ধমান জেলার সাতটি বিধানসভা পাণ্ডবেষর, রানীগঞ্জ, জামুরিয়া, আসানসোল দক্ষিণ, আসানসোল উত্তর, কুলটি ও বারাবনী নিয়ে গঠিত। সব কটি বিধানসভা আসনেই হিন্দুরা সংখ্য গরিষ্ঠ কেবল আসানসোল, রানীগঞ্জ ও কুলটির কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ছাড়া।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত প্রথম দুই নির্বাচনে কংগ্রেস আসানসোল আসনটি নিজেদের দখলে রাখলেও পরের নির্বাচনে সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক দল এটি কেড়ে নেয়। সিপিএম ১৯৭১-১৯৭৭ ও ১৯৭৭-১৯৮০ সাল পর্যন্ত পরবর্তী দুবার ঐ আসনে জয় লাভ করার পর কংগ্রেস ১৯৮০-১৯৮৪ ও ১৯৮৪-১৯৮৯ দু দফায় মার্কসবাদীদের কাছ থেকে এটি ছিনিয়ে নেয়। তারপর ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পরবর্তী ৮ বার সিপিএম এর প্রতিনিধি এই আসন ধরে রাখলেও ২০১৪ সালে বিজেপির বাবুল সুপ্রিয় ঐ আসনে জয় পেয়েছিলেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয় ৪.১৯ লক্ষ ভোট পেয়েছিলেন যা ২০০৯ সালে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ভাগ থেকে ৩১.১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৪ সালে তৃণমূলের ভোটের হার ছিল ৩০.৫৮ শতাংশ, যা আগের লোকসভা ভোটে তাদের শেয়ারের থেকে ৯.৯৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল।
২০০৯ সালের পর সিপিএমের প্রাপ্ত ভোটের হার সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। ৪৮.৬৯ শতাংশ থেকে কমে ২০১৪ সালের নির্বাচনে সিপিএমের ভোটের হার দাঁড়িয়েছে ২২.৩৯ শতাংশে। ২০০৫ এর উপনির্বাচনে সিপিএম ৬১.৩৩ শতাংশ, তৃণমূলের ২৭ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৭.৮৫ শতাংশ ভোটে পেয়ে তৃতীয় হয়েছিল।
২০০৫ সালে বিজেপি শীর্ষ পাঁচেও জায়গা করতে পারেনি। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় স্থান দখল করে ছিল কংগ্রেস কিন্তু ১৯৯৮ সালে ৩৮.০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সেথেকে এযাবৎ তৃণমূল আসানসোলে রানার আপ হয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে তারা ৪১.৬৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল আর ২০০৪ সালে পেয়েছিল ৩৩.৮৫ শতাংশ ভোট।
তৃণমূল এখন পর্যন্ত আসানসোল লোকসভা আসন না জিততে পারলেও আসানসোল দক্ষিণ, আসানসোল উত্তর, কুলটি, বারাবনী ও পাণ্ডবেষর এই পাঁচটি বিধানসভা আসনে নিজেদের দখল রেখেছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর সিপিএম সাতটি আসনের মধ্যে অন্য দুটি রানীগঞ্জ ও জামুরিয়াতে জয়ী হয়েছে।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার বছরে সিপিএম পাণ্ডবেশ্বর ও জামুরিয়ায় জিতেছিল তার আগে তারা প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রায় সবকটি বিধানসভা আসনেই জিতত। গত দুই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ভাগ চার থেকে নয় শতাংশের মধ্যে ছিল।
প্রার্থী ও সমস্যা
আসনসোল থেকে বিজেপি গায়ক বাবুল সুপ্রিয়কে পুনরায় মনোনীত করেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর নামে প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি যদি পুননির্বাচিত হন, তাহলে তিনি শিল্প ক্ষেত্রেকে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি কয়লা, বালি, ভূমি ও গবাদি পশু মাফিয়া নির্মূল এবং বিনিয়োগে আনতে অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করবেন। বাবুল সুপ্রিয় তার অসাধারণ গান গাওয়ার শৈলী এবং তার হিট ছবি থেকে গানগুলি গেয়ে প্রচার করছেন এবং আসানসোলের অনুন্নত নাগরিক সুবিধার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে দোষারোপ করেছেন।
গতবার দোলা সেনকে তৃণমূল মনোনীত করেছিল কিন্তু তিনি এখন রাজ্যসভার সাংসদ। ২০১৪ সালে বাঁকুড়া লোকসভা আসন থেকে জেতা মুনমুন সেন কে আসনসোল জন্য দলের তারকা প্রার্থী মনোনীত করেছেন। মমতা ও তার নিজের মা, বিখ্যাত অভিনেত্রি সুচিত্রা সেনের নামে তিনি ভোট চাইছেন ও প্রচার করছেন। তার সহজ এবং সংক্ষিপ্ত আবেদন করে তিনি বলছেন “আমাকে ভোট দিন এবং আপনি মমতা এবং অগ্রগতির জন্য ভোট দিন”। তিনি বলেছেন যে, তিনি করবেন না, কিন্তু মমতা আসানসোলের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন।
যাইহোক, এখানে অন্তর্নিহিত বিষয় হল সাম্প্রদায়িক বিভক্তি, মুসলিম তোষণ, দুর্নীতি ও তোলাবাজি এবং তৃণমূলের মাফিয়া পৃষ্ঠপোষকতা। ২০১৪ সাল থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধারাবাহিকতা বিজেপির পিছনে হিন্দুদের একত্রিত করতে পেরেছে। হিন্দু ভাষী হিন্দুরা বিজেপির পিছনে আরো জোরালোভাবে এগিয়ে এসেছে।
তৃণমূলের সংখ্যালঘু তোষণ ও হিন্দুদের প্রতি বৈমাত্রিয় সুলভ আচরণে ক্ষোভের কারণে হিন্দুদের একটি বড় অংশ, যারা তৃণমূলের প্রতি আনুগত্য রাখার আগে সিপিএম ও কংগ্রেসের সমর্থক ছিল, তারা এখন বিজেপির দিকে এগিয়ে আসছে। হিন্দুরা তৃণমূলের মাফিয়া পৃষ্ঠপোষকতা এবং মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধে রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের চোখ বন্ধ করে উদাসীনতা দেখানোর সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়েছে।
মুসলিমরা অবশ্যই তৃণমূলকে সমর্থন করে, এছাড়াও বাঙালি হিন্দুদের সমর্থন এবং হিন্দু ভাষী জনগোষ্ঠীর একটি অংশ যারা তৃণমূল থেকে উপকৃত হয়েছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত তারাও সমর্থন করে। তবে, সিপিএমের প্রার্থী গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় মুসলমানদের মধ্যে গভীরভাবে প্রচার চালাচ্ছেন এবং মুসলমানদের একটি অংশের আস্থা অর্জন করেছেন।
তিনি বাঙ্গালি হিন্দুদের একটি অংশের সমর্থন পাবেন আশা করছেন। এভাবে ভোটাভুটিতে তিনি তৃণমূলের ভোট কাটতে পারেন এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটাকে বিজেপির পক্ষে সহজ জয় লাভের পথ তৈরি করবে বলে মনে করছেন।
তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী প্রধান দলের জেলা নেতৃত্ব তথা মন্ত্রী এবং অন্য আসনসলের মেয়র তীব্র গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে যুক্ত। নিম্ন স্তরের তৃণমূল নেতৃবৃন্দের চাঁদাবাজি, পৌর করের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং নাগরিক কমিটিতে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে এবং নোটবাতিল ও জিএসটির-বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্ত্বেও তারা বিজেপির পক্ষে ভোট দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিজেপির মধ্যে সবই ভাল এমনটাও নয়। বাবুল সুপ্রিয়ের সাথে অনেকেই অসন্তুষ্ট , আসানসোলের বিজেপি পুরাতন নেতারা বলছেন যে, বাবুল সুপ্রিয়, পার্টিতে নতুন , সাংগঠনিক নেতাদের যথাযথ গুরুত্ব দেননা এবং আসানসোলের পার্টি নেতৃবৃন্দের সাথে তিনি খুব বেশি যোগাযোগ করেন না। এই পার্থক্য সত্ত্বেও, তারা তাদের প্রার্থীর হয়ে প্রচার করেছেন। সামগ্রিক বিশ্লেষণে বলা যায়, বাবুল সুপ্রিয় তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুন মুন সেনের পরিবর্তে আবারও লোকসভায় পুনরায় নির্বাচিত হবেন বলে ।
জয়দীপ মজুমদার