কল্পান্তরে সৃষ্টি তখন ধ্বংস হয়ে গেছে। চরাচরে কেবলই জল আর জল। তার বুকে হাওয়া সৃষ্টি করে বুদ্বুদ, তাও একসময় মিলিয়ে যায় জলেই। একা একা আর তার ভালো লাগে না। এ তো গেল আকারের কথা। জল যাঁকে দেখতে পাচ্ছিল না, সেই নিরাকার ব্রহ্মরূপে ব্যাপ্ত বিষ্ণু জলের একাকীত্বের ব্যথা বুঝলেন। অনন্ত জলমালার ওপর তখন তিনি তাঁর পরিচিত সেই অনন্তশয্যার ওপর আবির্ভুত হলেন। দেহী হওয়ার এই এক জ্বালা! একাকী আবির্ভুত হয়ে তাঁরও একাকীত্ব এলো প্রাণে, মনে এলো চরাচর আবার সৃষ্টিতে ভরিয়ে দেওয়ার বাসনা। তাই তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞের দুই মহান প্রতিভূ শিব ও ব্রহ্মাকে তিনি সৃষ্টি করলেন নিজের দেহেরই দুটি গুণ থেকে। তমোগুণ থেকে শিবকে আর রজোগুণ থেকে ব্রহ্মাকে। জন্ম থেকেই ব্রহ্মার পাঁচ মুখ। চারটি মুখ চার দিকে আর পঞ্চম মুখটি মাথার ওপর, আকাশের দিকে। ব্রহ্মার চারটি মুখ থেকে শাস্ত্রবাক্য শোনা গেলেও পঞ্চম মুখটি দিয়ে তিনি পরের নিন্দামন্দ ছাড়া আর কিছুই করতেন না।
সেই পঞ্চবদন নিয়ে ব্রহ্মার ভারি অহং, ভারি দেমাক। কারণ, শিবের একটাই মাথা, পরে থাকেন বাঘ ছাল, ঘুরে বেড়ান ষাঁড়ে চড়ে, দিন কাটান শ্মশানেমশানে। তাই নিয়ে তাঁকে সময়ে অসময়ে উপহাস করেন ব্রহ্মা। এমনিতে শিব খুব নির্বিবাদী ঠাকুর, কিন্তু ধৈর্য্যেরও তো একটা সীমা আছে, সহ্যেরও তো অন্ত আছে। তাই একদিন যখন ব্রহ্মা বিনা দোষে তাঁর পিছনে লেগে বার বার উপহাস করতে লাগলেন ভিখারি বলে, মূর্খ বলে, অক্ষম বলে, নিকৃষ্ট তমোগুণ থেকে জাত বলে ; তখন শিব আর কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না, অসম্ভব রেগে গেলেন তিনি। আর এই রাগ থেকে ধারণ করলেন বিনাশকারী রুদ্রের রূপ। সাদা, লাল, সোনালি, নীল ও পিঞ্জর–এই পাঁচ রঙের পাঁচটি মুখ উদ্গত হল তাঁর কাঁধে। তাঁর তৃতীয় চোখ থেকে বেরুতে লাগল আগুনের শিখা। তাঁকে ক্রুদ্ধ হতে দেখেও ব্রহ্মা নিরস্ত্র হলেন না। শিবকে আরও রাগিয়ে দিয়ে মজা লুটবার জন্য তিনি পঞ্চম মুখ দিয়ে ক্রমাগত শিবনিন্দা করে তাঁকে উপহাস করে যেতেই লাগলেন। তখন রুদ্ররূপী শিব আরও রেগে গিয়ে প্রচণ্ড একটি হুঙ্কার ছেড়ে বাঁ হাতের নখ দিয়ে ব্রহ্মার সেই নিন্দুক মাথাটি সমূলে উপড়ে নিলেন। অমনি অসম্ভব ব্যথায় ব্রহ্মার পাগলপারা অবস্থা হল, তিনি তিন লোকে কাতর হয়ে ছুটতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও শান্তি পেলেন না। অন্যদিকে ব্রহ্মাকে শাস্তি দিয়েও শিব স্বস্তি পেলেন না। তাঁর হাতে আটকে গেল ব্রহ্মার পঞ্চম মাথার করোটি। কিছুতেই তা হাত থেকে আর মুক্ত করতে পারেন না! তিনি ছুটলেন বিষ্ণুর কাছে। দুই অঙ্গজের এই বিরোধ চোখের সামনে দেখে বিষ্ণু তখন নিতান্তই অসুখী এবং অসন্তুষ্ট হয়ে বসে ছিলেন। তবু শিব তাঁকে প্রণতি জানিয়ে জানতে চাইলেন এই করোটি থেকে মুক্তির উপায়।
বিষ্ণুর উপদেশ নিয়ে শিব বারাণসী এসে গঙ্গার জলে স্নান করে বসলেন এক কঠিন তপস্যায়। দীর্ঘ ত্যাগ ও তপস্যার মধ্য দিয়ে একদিন তিনি তুষ্ট করতে পারলেন বিষ্ণুকে। তখন বিষ্ণুর আশীর্বাদে শিবের হাত থেকে খসে পড়ল ব্রহ্মার করোটি, তিনি মুক্ত হলেন। কিন্তু তিনি মুক্ত হলেও করোটিকে মুক্তি দিলেন না। ব্রহ্মাকে তাঁর কৃতকর্মের কথা চিরকাল স্মরণ করিয়ে দিতে, ব্রহ্মার হীনতা মনে করিয়ে দিতে, অন্যায়ের দমনকারী হিসেবে ভক্তের মনে জায়গা করে নিতে সেই করোটিকে নিজের আহারের পাত্র করে নিলেন শিব। করোটিকে ‘কপাল’ বলে, তাই এই কপাল ধারণ করে শিবের নাম হল, ‘কপালী’। এখান থেকে কাপালিকদের মধ্যে নরকপালে আহার গ্রহণের রীতিটির একটি সূত্র পাওয়া যায়। এই গল্পটি আমাদের পুরাণমালার অন্যতম ‘বামন পুরাণ’ থেকে নেওয়া।