।।চতুর্থ।।
বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল। বেশ ভালো বেতন পান। আর তাঁর সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটরি থেকে বই ছেপে ও নিজেদের ও অপরের বই বিক্রি করে যথেষ্ট আয়। একদা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ইচ্ছা হল যে, মাকে কখানিক গহনা দিয়ে সাজানোর….. মাতুলালয় বড় হওয়া এবং নিজেদের অসচ্ছল অবস্থায় গহনা পড়ার কথা ভগবতী দেবী কোন দিন ভাবতে পারেননি ঠিক – কিন্তু এখন তো অবস্থা ফিরেছে …একদিনমার কাছে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে ঈশ্বরচন্দ্র ..মা বললেন, ” ঠিক বলেছিস, আমার বড় স্বাদ তিন খানি গহনার। তুই দিতে চাইছিস যখন বলি ..”
বিদ্যাসাগর খানিক বিস্মিত হয়ে রইলেন, তারপর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বললেন , ” বলো বলো”। ভগবতী দেবী তার সাধের গহনার কথা জানালেন।
প্রথম হলো ,গ্রামের ছেলেদের জন্য একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন। দ্বিতীয় হলো, গ্রামের মেয়েদের চিকিৎসার জন্য একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন যেখানে চিকিৎসা ও ঔষধ বিনামূল্যে প্রদান করা হবে ।আর তৃতীয়টি হলো, গ্রামের গরিব ছেলেদের খাওয়ার ব্যবস্থা ।
বিদ্যাসাগর বিনা বাক্যব্যয় রাজি হলেন এবং সেই দিন থেকেই কাজ শুরু করে দিলেন । মায়ের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত করলেন , যারা রাখালি ও ক্ষেতের কাজের জন্য দুপুরে স্কুলে আসতে পারে না তাদের জন্য নাইট স্কুল আর মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় । মায়ের পাঁচ লহরি হার।
ভগবতী দেবীর কথা বলতে শুরু করলে আর শেষ হয়না । বিদ্যাসাগর বলতেন , “আমি যদি মায়ের গুণের একশত ভাগের এক ভাগও পেতাম, তাহলে আমি কৃতার্থ হতাম । আমি যে এমন মায়ের সন্তান, এই আমার গৌরব । ”
পরবর্তীতে যখন বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের নিমিত্ত আন্দোলন সূচিত হল , বিভিন্ন সামাজিক চাপের কারনে ভগবতী দেবীর সঙ্গে হয়তো বিদ্যাসাগরের মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল । তবুও এ সত্য থেকে আমরা চলে যেতে পারি না যে, বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন নিয়ে কিন্তু ভগবতী দেবীকে সামাজিকভাবে গ্রামাঞ্চলে বহু অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল।
ভগবতী দেবী। ছেলের পরিচয়ই আজও তাঁর একমাত্র পরিচয়। তার আড়ালে আশ্চর্য ওই মানবীর জীবনের আখ্যানটুকু জানলই বা ক’জনে! হোক ছেলের সঙ্গে মতানৈক্য কিন্তু সাহাসটুকুও মা ছেলেকে জুগিয়ে ছিলেন।
বিদ্যাসাগর তখন জীবন পন করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিধবাবিবাহের সপক্ষে শাস্ত্রের কোথায় কী বিধান আছে।
পরাশর সংহিতা থেকে বিধান মিলল বটে। কিন্তু এর পরেও কিঞ্চিৎ দোনামোনায় যেন তিনি।
গেলেন মা’য়ের কাছে।
সব শুনে ভগবতীদেবীর একটাই উত্তর, ‘‘এক বার যখন কাজ শুরু করেছ, সমাজের কর্তাদের ভয়ে পিছিয়ে এসো না, উপায় একটা বেরোবেই।’’
এখানেই থামলেন না।
ছেলেকে আরও বললেন, ‘‘আমি প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করিতেছি। আহা! জন্মদুঃখিনীদের যদি কোনও গতি করিতে পারো, তাহা বাবা এখনই করো।’’
ভগবতী দেবীকে লাগাতার হেনস্থা করত গ্রামের মাতব্বররা। ছেলে বিধবাদের বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। গাঁয়ের সমাজ ছ্যা ছ্যা করছেন। যুক্তির যুদ্ধে তাঁরা হেরেছেন বটে, কিন্তু ঘুরপথে নাকাল করতে ছাড়ছেন না তাঁরা। তাই দিনের পর দিন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সমাজসংস্কারক ছেলের পরিবার।প্রতিদিন বাড়ির সামনে কুলকাঁটা , কাঁটা গাছ ডাই হয়ে থাকত।
এসব খবর পৌঁছল বিদ্যাসাগরের শ্বশুরমশাই শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি আবার ক্ষমতাবান ব্যক্তি। গাঁয়ের লোক তাঁকে সমীহ তো করেই, ভয়ও পায়।
খবর পেয়ে তিনি সটান হাজির বীরসিংহ গ্রামে। রীতিমতো কড়া ভাষায় সাবধান করে দিলেন গোঁড়া পণ্ডিতসমাজকে। কিন্তু তাতেও যে পুরোপুরি টনক নড়ল মাতব্বরদের, তেমন নয়। উৎপাত চলতেই থাকল। এ বার খবর গেল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষালের কাছে। তিনি আবার বিদ্যাসাগরের বিশেষ সুহৃদ। ঘোষালমশাই ছদ্মবেশে বীরসিংহে এলেন। সব দেখেশুনে ঠাকুরদাসের কাছে মাতব্বরদের নাম চাইলেন।
ঠাকুরদাস কিছুতেই নামধাম দেবেন না। ভগবতী দেবীও তাই। কিন্তু কেন? দিনের পর দিন যা নয় তাই অত্যাচার করে যাঁরা তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন, তাঁদের নাম দিতে কীসের সঙ্কোচ?
গ্রামের ‘নিরীহ’ মানুষগুলো যদি সরকারি রোষে পড়ে যান, বাঁচাবেন কী করে! তাই নাম দিতে তো নারাজ বটেই, উপরন্তু কোনও সূত্রে যদি সরকারি তরফে সবটা জানাজানি হয়ে যায়, তাই ঘুম ছুটে যাওয়ার দশা ঠাকুরদাস-ভগবতীর। শেষমেশ একটা উপায় বের করলেন ভগবতীদেবী নিজেই।
কী উপায়?
যাঁরা প্রতিদিন উৎপাত শুরু করেছিলেন, প্রত্যেকের বাড়ি-বাড়ি হাজির হলেন ভগবতীদেবী। নেমন্তন্ন করলেন সকলকেই।
উদ্দেশ্য একটাই।
সাহেবের যেন মনে হয়, কোথাও কোনও গোলমাল নেই।
মাতব্বরদের কিন্তু লাজলজ্জা বলে কিছু নেই। তা ছাড়া সরকারি তল্লাশির খবরও তত ক্ষণে তাঁদের কানে গেছে। ফলে ভগবতীর ডাকে সাড়া দিয়ে সুড়সুড় করে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে চলে এলেন তাঁরা।
এমনই ছিলেন ভগবতী দেবী।
এ ঘটনা যখন ঘটছে, বিধবা বিবাহ আন্দোলন তখন তুঙ্গে।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে , ” তাহার নির্মল বুদ্ধি ও উজ্জ্বল দয়া, প্রাচীন সংস্কারের মোহ-আবরণ এমন অনায়াসে বর্জন করিতে পারে ইহা আমার নিকট বড় বিস্ময়কর! লৌকিক প্রথার বন্ধন বোধহয় রমনীর কাছে দৃঢ় এমন আর কার কাছে? অথচ কি আশ্চর্য ? স্বাভাবিক চিত্ত শান্তির দ্বারা জরতাময়প্রথার ভিত্তি ভেদ করিয়া নিত্য জ্যোতির্ময় অনন্ত বিশ্ব ধর্মকাশের মধ্যে উত্তীর্ণ হইলেন । এ কথা তাহার কাছে সহজবোধ্য হইল কি করিয়া? তাহার কারণ , সকল সংহিতার অপেক্ষা প্রাচীনতম সংহিতা তাহার হৃদয়ের মধ্যে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত ছিল।”
রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন, সকল সংহিতার অপেক্ষা প্রাচীনতম সংহিতা তাহারে হৃদয়ের মধ্যে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত ছিল ।তাই এমন কঠিন পরিস্থিতির অনেক সহজ সমাধান তিনি করতে পেরেছিলেন। আর সেই জন্য এই মহীয়সী দেবীর উদ্দেশ্যে আমাদের থাক শত কোটি প্রণাম।
সমাপ্ত
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী – প্রিয়দর্শন হালদার; রবি জীবনী; বিদ্যাসাগর – বিহারিলাল সরকার