"পুণ্যিপুকুর ব্রতমালা/কে করে গো সকালবেলা
আমি সতী,লীলাবতী/সাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী
হবে পুত্র,মরবে না/ধান সে গোলায় ধরবে না
পুত্র তুলে স্বামীর কোলে/আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গাজলে…’…”
পুণ্যিপুকুর ব্রত বাংলার হিন্দু সমাজের মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি কুমারীব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষদিন পর্যন্ত একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে।
…..বৈশাখ মাসের গরমে নদীনালা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার শুখা মরসুমে আজও নদিয়া , বর্ধমান , মুর্শিদাবাদ , বীরভূমের কিছু গ্রামে এই ছড়া কেটে পুণ্যিপুকুর ব্রত পালন হয়৷
যেখানে এখনও পুকুরের জলই পানীয় , সেখানে এই ব্রত করেই মানুষ পর্যাপ্ত জলের জন্য প্রার্থনা জানান৷ বাড়ির উঠোনে গর্ত কেটে জলে ভরাট করে নেওয়া হয়৷ ওই ভরাট গর্ত আসলে ভরন্ত পুকুরের প্রতীক৷ সকাল বা সন্ধ্যায় এই ব্রত পালনের কথা৷ তাই ছড়ার মধ্যেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে , ওই দুপুরবেলা কে ওই পুজো করছে ?
গ্রাম-বাংলার বসতবাড়ির মেঠো আঙিনা বা শানের মেঝেতে আল দিয়ে অথবা পুকুরপাড়ে বা বাগানে এই ব্রত করা হয়। মেয়েলি ব্রত হওয়ার দরুন ব্রতপালনে কোন মন্ত্র বা পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না।
পুণ্যিপুকুর ব্রতের তিনটি পর্যায় আছে। যথা: আহরণ, ক্রিয়া ও ছড়া। প্রথম পর্যায়ে ব্রত পালনের প্রয়োজনীয় উপচার অর্থাৎ সাদাফুল, চন্দন, দুর্বা ঘাস, তুলসী গাছ, পাতাসমেত বেলগাছের ডাল, কয়েকটি কড়ি ও একঘটি জল সংগ্রহ করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ,
চৌখুপি নকশার ভিতরে আঁক, চারপাশে পান -সুপারি এঁকে নদীকে ভরে রাখার ইঙ্গিত রাখা হয় এই ব্রতের আলপনায়৷ এক -একটি ব্রতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক -এক রকম আলপনা৷ চারদিকে চারটি ঘাটসহ চৌকো একটি পুকুর খনন করে প্রতিটি ঘাটের দুপাশ কড়ি দিয়ে সাজিয়ে পুকুরের মাঝখানে ফুলের মালা সজ্জিত তুলসীগাছ বা বেলগাছের ডাল বসানো হয়। তৃতীয় পর্যায়ে চার-ছয় পংক্তির ছড়া আবৃত্তি করে ঘটি দিয়ে গাছে জল ঢালা হয়। ব্রতের শেষে তিনবার চন্দন সহযোগে সাদাফুল ও দুর্বা ঘাস পুকুরে অঞ্জলি দিয়ে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করা হয়।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ঐরূপ অনেক ব্রত করেছি।এখনো করার চেষ্টা করি। খুব মনে পরে বৈশাখের ভরা দুপুরে সেজ পিসি আমাকে উঠোনে তুলসী তলার পাশে মাটি খুড়ে পুকুর করে দিত একেই ” পুণ্যিপুকুর ব্রত ” বলা হত।
পয়লায় হরিসভা থেকে একখানা নগরকীত্তন বার হত।সারা এলাকা ঘুরে তারা সংক্রান্তির মেলার জন্য দান-দক্ষিণে নিত । সব দরজায় ঘুরতো…
তারপর বৈশাখে প্রথম ব্রত করতাম আমরা…পুণ্যিপুকুরের ব্রত…ঘর-লাগোয়া বিশাল দীঘি ছিল। সেখান থেকে পুজোর জল নিতাম।
বেল গাছের ডাল পুঁতে জল, ফুল দূর্বা, ধুপ , প্রদীপ , ধুনো নিয়ে আমি পুজোয় বসতাম। পিসি মন্ত্র বলত।আমি উচ্চারণ করতাম। ভরা বৈশাখের দুপুরে দূরে দিগন্তের কাছে কোনো চিল উড়ে মিলিয়ে যেত। কোনো গাছের ডাল থেকে নাম না জানা পাখি ডেকে উঠত।
মন্ত্রের মধ্যে দশটি শ্লোক আছে , যথা – সীতার মত সতী হবে , দশরথের মত শ্বশুর হবে , কৌশল্যার মত শ্বাশুড়ী হবে , রামের মত পতি হবে , লক্ষণের মত দেওর হবে , কুন্তীর মত পুত্রবতী হবে , দুর্গার মত সৌভাগ্যবতী হবে , দ্রৌপদীর মত রাঁধুনী হবে , গঙ্গার মত শীতল হবে , পৃথিবীর মত ধৈর্য্য হবে। এই সব গুণ যদি প্রত্যেকের মধ্যে বর্ত্তমান থাকত তবে সুখের সীমাই থাকত না , কিন্তু সে যদি কিছু পরিমাণেও এগুলি পায়ে থাকে তবে তাহাও তাহার পক্ষে কম গৌরবের কথা নয়।
বৃষ্টিআবাহন কৃষিসংক্রান্ত একটি বিশেষ লোকউৎসব। যথাসময়ে বৃষ্টি না হলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সমাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নানা ধরনের ক্রিয়াচার পালন করা হয়। সেসবের মধ্যে ব্যাঙবিয়ে, বদনাবিয়ে, মেঘারানী, হুদমাদেও সম্পর্কিত বৃষ্টিআবাহন অনুষ্ঠান এবং পুণ্যিপুকুর ব্রত ও বসুধারা ব্রত উল্লেখযোগ্য। আদিবাসী মেয়েরা বৃষ্টিকামনায় রাতের অন্ধকারে দল বেঁধে হুদমাদেও-এর গান গায়। বৃষ্টিআবাহনের ক্ষেত্রে কাদামাটি অনুষ্ঠানটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এতে মেয়েরা কলসিতে জল ভরে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং মাটিতে জল ঢেলে একজন আরেকজনকে মাখিয়ে দেয়।
“ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?"
"….আকন্দ, বিল্বপত্র, তোলা-গঙ্গার জল
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর……”
এই ভরা বৈশাখের দুপুরে এখনো আমার চোখে ছবির মত ভেসে ওঠে
দখিনদুয়োরী বড় ঘরটার বাইরে তুলসিতলায় ঠিক মাঝখানে বড় করে আলপনা দিচ্ছে —চারদিক কেমন ধোঁয়াটে—আর একটানা কেউ যেন পাঁচালি পড়ছে—
কংক্রিটের জঙ্গলে , শহুরে মেকি বিলাসিতা, আধুনিকতায় ব্রত কথা গুলোর মতো আমিও হারিয়ে যাচ্ছি।
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার ব্রতকথা