কাল বা সময়ের স্বাভাবিক ধর্ম বিস্তৃতি ঘটানো। সময় গড়িয়ে গেলে. অতীত হলে, মানুষ ক্রমে তা ভুলে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা এমনই মর্মঘাতী যা, মানুষ সহজে ভোলে না বা ভুলতে পারে না।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এইরকম এক হৃদয় বিদারক ঘটনা হল জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড, যা ঘটেছিল আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যাবেলা। এখনও ভারতের মানুষেরা ওই দিনের মর্মান্তিক ঘটনার কথা ভেবে শিউরে ওঠে, তৎসহ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের নৃশংস কদর্য রূপটিকে যা স্মরণ করায়। আর বর্তমানে রাক্ষস বা অসুরদের কথা শুনে থাকলেও তাদের দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমাদের হয়নি। কিন্তু ওইরূপ এক আসুরিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন জেনারেল ডায়ার, যাঁর আদেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।
বর্তমান পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত এই পার্ক বা উদ্যানটি। এই পার্কটির চারদিক অট্টালিকা বেষ্টিত ছিল এবং মাত্র একদিক প্রায় ৩০ মিটার লম্বা ও ২ মিটার উঁচু একটি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কোনও একজন মানুষের পক্ষে এই পাঁচিল টপকে বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পার্কটিতে প্রবেশের জন্য একস্থানে একটু চওড়া একটি মাত্র প্রবেশ পথ ছিল। এছাড়া চার পাঁচটি বাইরে বেরোনোর পথ ছিল, আর ওই পথগুলির কোনটিই সাড়ে চার ফুটের বেশি চওড়া ছিল না। স্বভাবতই একসঙ্গে এক-দু জনের বেশি লোক যেতে পারত না। পার্কের মাঝখানে ছিল একটি কুয়ো।
দিনটা ছিল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। কথা ছিল, মহাত্মা গান্ধী, কংগ্রেসের কিছু নেতা এবং পাঞ্জাবের দুই প্রধান নেতা ডা. সৈফুদ্দিন কিচলু ও ডা. সৎপালের গ্ৰেফতারির প্রতিবাদে বিকাল সাড়ে চারটার সময় জালিয়ানওয়ালা বাগে একটা সভা হওয়ার কথা ছিল। আগের দিন ১২ এপ্রিল সন্ধ্যা বেলা পাঞ্জাবের তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে অমৃতসরে সভা-সমিতি নিষেধের আদেশ প্রচারিত হয়। কিন্তু সেই আদেশ সম্বন্ধে অনেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। পাঞ্জাবে ওই সময় বৈশাখী পরব চলছিল। ওই সভায়ও তাই হিন্দু, মুসলমান, শিখ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। লক্ষণীয় তারা প্রত্যেকেই ছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। শান্তিপূর্ণ ভাবেই সভা চলছিল। হঠাৎ শিখ, গোর্খা, বালুচ ও রাজপুত রেজিমেন্টের বিশাল বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন জেনারেল ডায়ার এবং পার্কের মেন গেটটি একটি বড় ট্যাঙ্কার দিয়ে আটকে দেন। তারপর কোনও প্রকার সতর্কবাণী বা ঘোষণা না করেই এই জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ১০ মিনিট ধরে ৫০ টি রাইফেলের সাহায্যে ১৫০০ ( মতান্তরে ১৬০০) রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়।
লুটিয়ে পড়তে থাকেন একের পর এক মানুষ। ভয়ে আতঙ্কে পালানোর চেষ্টা করেও বের হতে না পারায় প্রাণ বাঁচাতে বহু মানুষ পার্কের কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দেন , সেখানেও চাপে ও দম আটকে বহু মানুষ প্রাণ হারান।
সরকারি প্রচারে বলা হয়, ওইদিন মাত্র ৩৭৯ জন মানুষ প্রাণ হারান ও আহত হন মাত্র ১২০০ জন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হল, সেদিন বেশ কয়েক হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছিলেন, মৃত্যুর সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কত ছিল তা জানা বা অনুসন্ধান করা সম্ভব ছিল না। কারণ ওই দিন ব্রিটিশ সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে, ফলে মৃতদেহগুলি উদ্ধার করে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব ছিল না।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও নিন্দা ধ্বনিত হয়েছিল সারা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদে ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। তৎকালীন প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলও এই ঘটনার নিন্দা করে বক্তব্য রাখেন। মহাত্মা গান্ধী সহ ভারতের প্রত্যেক দেশনেতা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিলেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ব্রিটিশ সরকারের এরূপ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পেছনে কারণ কী ছিল? উত্তর পেতে হলে তৎকালীন ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ শক্তি বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে সারা ভারত জুড়েই তখন বিপ্লবী আন্দোলন ভীষণভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছিল। এইসব আন্দোলন যেমন একদিকে অহিংস ছিল, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা সহিংস রূপও নিয়েছিল। বেশ কিছু ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য ইংরেজ সরকার বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ একটি আইন পাশ করে, ‘রাওলাট আইন’ নামে এটি ,কুখ্যাত। এই আইনে বলা হয়েছিল যে, ইংরেজ সরকার ইচ্ছা করলে যে কোনও ব্যক্তিকে যে কোনও সময় গ্ৰেপ্তার করতে পারবে, বিচারের সময় ওই ব্যক্তির কোনও উকিল নেওয়া যাবে না, আর কোনও সংবাদপত্র ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে কোনও সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না। কোনও সংবাদ পরিবেশন করতে হলে আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
এই কালা আইনের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হল। ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল গান্ধীজি এর প্রতিবাদে হরতাল পালন করলেন। অব্যবহিত পরে এই আইনের প্রতিবাদে অমৃতসরের হলব্রিজে এক প্রতিবাদে মিছিল বের হলে ব্রিটিশ পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, এতে ২০ জন সাধারণ মানুষ মারা যায়। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উন্মত্ত জনতা বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, রেল স্টেশন, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি স্থানে ভাঙচুর চালায়, আগুন লাগিয়ে দেয় এবং কয়েকজন অত্যাচারী সরকারি কর্মীকে হত্যাও করে।
এই সকল কারণে জেনারেল ডায়ার সামরিক শাসন জারি না করেই নিজের হাতে পুরো শাসনভার তুলে নেন ও সভা, সমিতি, মিটিং, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, কিন্তু সেই খবর বিশেষ ভাবে প্রচার করা হয়নি। সাধারণ মানুষ ওই সংবাদ জানত না। এর পরিণাম লক্ষ্য করা যায় জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডে।
জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের পরে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দেই লর্ড হান্টারের সভাপতিত্বে এক অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে চারজন ইউরোপীয় এবং তিনজন ভারতীয় সদস্যকে নেওয়া হয়। অপরদিকে তৎকালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিও মহাত্মা গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করে। হান্টার কমিশনের অধিকাংশের মতে জেনারেল ডায়ারের গুলি চালানো অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ হয়েছিল বলে বর্ণনা করা হয়। অপরদিকে ভারতীয় তদন্ত কমিটি ডায়ারের এই কাজের তীব্র নিন্দা ও মানবতা-বিরোধী অত্যাচার বলে মত প্রকাশ করে। ভারতীয়দের মতে, পৃথিবীর কোথাও নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি বর্ষণ করা হয় না। ইংরেজ সরকার কিন্তু জেনারেল ডায়ারের কাজকে পুরোপুরি সমর্থন করে। পরে অবশ্য ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ ডায়ারের কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে তাঁকে সৈন্যাধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অফ্ কমন্সে ২৩২ জন সদস্য ডায়ারের শাস্তি অনুমোদন করেননি। এমনকি হাউস অফ্ লর্ডসের অধিকাংশ সদস্য ডায়ারের পদচ্যুতির তীব্র সমালোচনা করেন। এদেশে বসবাসকারী ইংরেজরা ডায়ারকে তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে সম্মান জানায় ও অভিনন্দিত করে এবং বিশ হাজার পাউন্ড উপহার দেয়। খুব অল্প সংখ্যক ইংরাজ ডায়ারের কাজের নিন্দা করেন।
এর দ্বারা কি প্রমাণিত হয় না যে এতবড় নৃশংস পাপকর্ম করে জেনারেল ডায়ার পার পেয়ে গেলেন। একজনও কেউ কি ছিল না যে ডায়ারের এই অত্যাচারের উপযুক্ত ও সমুচিত দণ্ড দান করতে পারে? এরপর কেটে যায় প্রায় ২১ বছর। পাঞ্জাবের এক বীর বিপ্লবী জেনারেল ডায়ারকে সামনাসামনি গুলি করে তার দেশের মাটিতেই তাকে হত্যা করে। সেই বিখ্যাত বিপ্লবীর নাম সর্দার উধম সিংহ। আর সেই স্মরণীয় দিনটি ছিল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ।
ঘটনাটি এইরূপ। জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্ৰহণের জন্য সর্দার উধম সিং নিজেকে তিল তিল করে প্রস্তুত করেন। বহু কষ্ট করে অর্থসংগ্ৰহ করে ইংল্যান্ডে যান। পরে সুযোগ বুঝে এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে জেনারেল ডায়ারকে সামনাসামনি গুলি করে হত্যা করেন। তাঁর এই বীরত্বের কাহিনিকে স্মরণ করে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
ঋণ স্বীকার :-
১) ভারতকোষ – বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ – কলিকাতা,
২) সাময়িক পত্রপত্রিকা সমূহ