খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে একটি অদ্ভুত মহামারীর কবলে পড়ে গিয়ে প্রাচীন গ্রিসের সমুন্নত রাষ্ট্র এথেন্স পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে স্পার্টার হাতে বিধ্বস্ত হয় এবং তার সমুদয় গৌরব ও আর্থিক বুনিয়াদ তছনছ হয়ে যায়। আর আজ তমাম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র আর্থিক দিক থেকে কেবল বিপন্ন নয়, সকল সম্ভাবনাই যেন বিসর্জিত হতে চলেছে কোনো অতলান্তিক খাদে। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এই সময়ে এক স্থিরবদ্ধ, অবিচলিত, সুচিন্তার অধিকারী একনিরভিমান ব্যক্তিত্বকে নেতার আসনে পেয়েছি। করোনা মহামারী যখন আমাদের সবদিক থেকেই বিপন্ন করে চলেছে, অর্থনীতির নাভিশ্বাস উঠেছে, অথচ বিরোধিতার নামে ইতিউতি চলছে বচনসার লীলাবিলাস, সেই দেশনেতা সঠিক পথে ও পন্থায় একটার পর একটা সিদ্ধান্ত ও প্রকল্পকে বাস্তবায়নের জন্য এক রকম জান কবুল করে রেখেছেন। এমত প্রয়াসের সাম্প্রতিকতম নজির শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদী কর্তৃক ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। করোনা আক্রান্ত ভারতকে প্রকৃতই আত্মনির্ভর করে তুলবে এই বিপুল বিনিয়োগ। আমরা এখানে ব্যক্তিবিশেষের মহত্ত্বের । ব্যাখ্যায় না গিয়ে বিনিয়োগের বিশ্লেষণে যাবার চেষ্টা করব। কোথাও আত্মহারা হবার অবকাশ নাস্তি। কারণ করোনা আমাদের সর্বার্থেই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন করে রেখেছে। যাঁরা এখানেও রাজনীতির দুর্গন্ধ টেনে আনছেন, তাদের আমরা একরকম উপেক্ষা করতেই বাধ্য। এই বিপুল বিনিয়োগ মুখ্যত দেশের বিকাশ যাত্রাকে মসৃণ করবার ধারালো আয়ুধ। বহু বিষয়কেই এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যতটা সম্ভব বিপদকে কাটিয়ে উন্নয়নের পথকে খুঁজে নিতে হবে। জমি-জমা, শ্ৰমদানের স্থান, নগদপ্রাপ্তি, কৃষক, শ্রমিক, চাকুরিজীবী, মধ্যবিত্ত ইত্যাদি সর্বব্যাপ্ত বিষয় ও নাগরিকদের স্বস্তি প্রদান। এই আর্থিক প্যাকেজ স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একটি মস্ত ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এমত বিনিয়োগ ও তজ্জনিত সাফল্য তাদের মুখকেই শুকনো করে রাখবে, যাঁরা নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না এখনও। ওই ভুরু কুঁচকে হড়বড় হড়বড় করে বাক্যনিক্ষেপ আমাদের নিকট অতি ব্যবহারে ক্রমশই ক্লিশে হয়ে উঠছে। এ কথা স্বীকার করে নিতে কী দোষ যে, এই আর্থিক প্যাকেজ দেশের সর্বস্তরের নাগরিকদের কাছে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে স্বস্তিদায়ক আবহ
তৈরি করবে? ধৈর্য ধরুন, দেশকে ভালো বাসুন, উন্নয়নের শামিল হন। জনগণকে নিশ্চয় সঙ্গে পাবেন। অন্যথায় সম্মানহানির সমূহ সম্ভাবনা।। | একথা সত্যি যে, এই ২০ লক্ষ কোটি টাকার সঙ্গেই যুক্ত থাকছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক প্যাকেজ এবং বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণের পূর্ব ঘোষিত ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজও। তাই এটা ঠিক | জিডিপির ১০ শতাংশ নয় বলে মোদীজীকে যাঁরা খোঁচা মারার চেষ্টা করছেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা ক্রমে বুঝতে পারছি। গঠনমূলক প্রকল্পকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমর্থন জানাবার একটা বড়ো সুযোগ হারালেন তারা। প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের ভূমিকা রচনা করেছেন এই কথাগুলি বলে, “করোনার বিষকামড় হেতু আত্মনির্ভরতার সংজ্ঞাটাই বদলে গিয়েছে। আত্মনির্ভরতায় আর এখন আত্মকেন্দ্রিকতা থাকলে চলবে না। তল্লাশি চালিয়ে দেখলাম, আত্মনির্ভরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে বিশ্বকল্যাণবোধও। ভারতে এই আত্মনির্ভরতা আজ পাঁচটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে : (১) আর্থিক নীতি, (২) পরিকাঠামো, (৩) আধুনিক প্রযুক্তি, (৪) ডেমোগ্রাফি, (৫) চাহিদা।।
পরিস্থিতি কঠিন। কিন্তু ভারতবাসী যে যুদ্ধজয়েও কত অনন্য, সংগ্রামী, পরিশ্রমী এবং সৃষ্টিশীল, এই ভয়ংকর সময়ে তার বিস্তর সবুদ পেলাম। ভবিষ্যতেও পাব। আমাদের শিরদাঁড়া ঋজু।তাইমাটিফুড়েও উঠে দাঁড়াতে পারি। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। করোনা সংকট শুরুর সময় ভারতে কোনও পিপিই কিট তৈরি হতো না। আজ সেই ভারতেই রোজ ২ লক্ষ পিপিই ও ২ লক্ষ এন-৯৫ মাস্ক তৈরি করা হচ্ছে ।…’
প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রত্যয়ের ওপর নির্ভর করেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ১৩ মে ২০২০ বিকেলে জাতির গোচরে আনলেন ২০ লক্ষ কোটি টাকার একটি প্রকৃতই অসচরাচর প্যাকেজ। একাধিক পরিচিত জনের সঙ্গে দূরভাষে কথা বলে তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হলাম। তারা সকলেই বিশ্লেষণ করেছেন। বিস্ফারিত হননি গগনচুম্বী খুশিতে। আবার নৈরাশ্যে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেননি। প্রশংসা করেছেন সরকারের চেতনাকে। একজনও ছিদ্র খুঁজে বেড়াননি। মধ্যবিত্তদের মধ্যে স্বস্তির আবহ স্পষ্ট। আবার খুশির ছোঁয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকলের। করোনা কবলিত দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি, কুটিরশিল্পোদ্যোগুলির জন্য সরকার তার প্যাকেজে রেখেছেন ৩ লক্ষ কোটি টাকা। এখান থেকে ঋণ দেওয়া হবে এসএসএমই বা ক্ষুদ্র- মাঝারি সংস্থাগুলিকে। ঋণের সময়সীমা চার বছর। আর একটি মস্ত সুবিধা, এই ঋণ ১০০ শতাংশ গ্যারিন্টি ফ্রি। তার চেয়েও চমকপ্রদ বিষয়, এই ঋণ যাঁরা নেবেন, তাদের ১ বছর কোনও সুদই দিতে হবে না। ২০২০-এর অক্টোবর মাসে সূচনা হবে ঋণের শুভযাত্রা। ক্ষুদ্র শিল্পের যাঁরা মালিক তারা তাদের ক্রেডিট লিমিটেডের আরও ২০ শতাংশ বেশি ঋণ নিতে পারবেন। বিত্তমন্ত্রী তার ব্যাখ্যায় জানালেন, ইপিএফে সরকারি আর্থিক সহায়তার মেয়াদ আরও ৩ মাস বাড়িয়ে আগস্ট মাস অবধি করা হলো।
আবার যাদের বেতন ১৫ হাজার টাকার কম, তাদের পিএফ-এ জমা দেবার টাকা আগামী তিন মাস কেন্দ্রীয় সরকারই বহন করবেন। আর যাঁদের মাস মাইনে ১৫ হাজার টাকার অধিক, তাদের আগামী ৩মাস ইপিএফ জমা বেতনের ১২ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ করা হলো। তবে এই সুবিধাগুলি সবই বেসরকারি ক্ষেত্রে। সরকারি কর্মীদের অবস্থা থাকছে পূর্ববৎ। কর্মীদের ইত্যাকার সুবিধা প্রদানে সরকারের ব্যয় হবে ৬,৭৫০ কোটি টাকা। ফলে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বড়ো অংশ অধিকতর আর্থিক বলে বলীয়ান। হয়ে উঠছেন। আর একটি বড়ো স্বস্তির খবর দিলেন নির্মলা সীতারামণ। তা হলো এই যে, আয়করের রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা বাড়িয়ে করা হলো ৩০ নভেম্বর, ২০২০। এর ফলে দেশের আয়কর দাতাদের হাতে বাড়তি ৫০ হাজার কোটি টাকা থাকবে। সত্যিই এটা তাঁদের কাছে বিলক্ষণ খুশির খবর। ১৪ মে, ২০২০ থেকে ৩১ মার্চ, ২০২১ অবধি বেসরকারি সংস্থাগুলির টিডিএসে ২৫শতাংশ ছাড় দেবার সুখবরও দিলেন অর্থমন্ত্রী। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মালিকরা সরকারের কাছে যত টাকা বকেয়া রয়েছে, তার সবটাই একলপ্তে পেয়ে যাবেন আগামী দেড় মাসের মধ্যে। ফলে বাজারে টাকার জোগানও অনেক বেড়ে যাবে। রেললাইন পাতা, রাস্তা তৈরি করা এবং অন্যান্য নির্মাণ কর্মে ঠিকাদারদের সময় ও আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। যে সকল সংস্থা এসএমএমই, তারা চলে আসবে ৫০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ প্যাকেজে। ফলে সবিশেষ উপকৃত হবে ৪৫ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ। আমার তো স্মরণে আসেনা এযাবৎ কোনও কেন্দ্রীয় সরকার এই ধরনের কোনও বাস্তব বা অতিলৌকিক ব্যবস্থা গ্রহণে পরিকল্পনাটুকুও করেছিলেন বলে। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার কবলে পড়ে অনেক সংস্থাই নির্মাণ প্রকল্পে পিছিয়ে পড়ে প্রায়শ। এদের সাহায্য করতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছেন যে, অতঃপর ২০০ কোটি টাকা অবধি নির্মাণ কর্মের টেন্ডার আর গ্লোবাল’ হবেনা। দেশীয় সংস্থাগুলির মধ্যেই প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ থাকবে। আবার এখন যে সকল কোম্পানি ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ৫ কোটি টাকা অবধি লেনদেন চালাতে সমর্থ হয়েছে, তারা নতুন অর্থনীতির বিচারে ক্ষুদ্র শিল্পের শিরোপা পাবে। আর যারা সর্বাধিক ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা অবধি লেনদেনের নজির গড়তে পারবে। তারা নবীন ও প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন শিল্পোদ্যোগের মান্যতা অর্জন করবে। এদেরই পাশাপাশি
গৃহঋণ প্রদানকারী সংস্থা, নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ছোটো ছোটো বাণিজ্যিক ঋণ দিয়ে থাকে এরকম বেসরকারি সংস্থা ইত্যাদিরা সরকারের কাছ থেকে পাবে ‘লিকিউডিটি পুশ’ শীর্ষক আর্থিক সহায়তা।
এর জন্য বরাদ্দ করা হলো ৩০ হাজার কোটি টাকা। ধারাবাহিক লকডাউনের ফলে যে সমস্ত বিদ্যুৎ উৎপাদক এবং বণ্টন সংস্থাগুলি অর্থাভাবে কাহিল হয়ে পড়েছে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তাদের অবস্থা ফেরাতে ৯০ হাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজ রেখেছেন। সারা দেশ ব্যাপী সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, দীর্ঘ দ্বিমাসাধিক লকডাউনের অপ্রত্যক্ষ প্রভাবে চাকরি খুঁইয়েছেন প্রায় ১০ কোটি উপার্জনক্ষম মানুষ। তাদের পুনরায় কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনবার শপথ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর ২০ লক্ষ কোটি টাকার মূল লক্ষ্যই হলো ওই মানুষগুলিকে পুনরায় ‘আত্মনির্ভর’ করা। ওই ১০ কোটি নর-নারীর সকলেই শ্রমিক নন, বহু কৃষকও রয়েছেন। অর্থাৎযুগপৎ শ্রমিক ও কৃষক এবং অন্যান্য সকল উপার্জসক্ষম নাগরিকদের উজ্জীবিত করে তুলতে আমাদের সামনে এসে যাচ্ছে এক অতুলীয় কর্মযজ্ঞ।
| কেন্দ্রীয় সরকারের এই রকম অতিকায় প্রকল্প ও বিনিয়োগকেও ব্যঙ্গ করবার জন্য কিছু রাজনীতির চাদরে ঢাকা লোকের সন্ধান আমি-আপনি অবশ্যই পাচ্ছি। যেহেতু দেশটি গণতান্ত্রিক, তাই অমন অনন্য প্রয়াসকেও চিহ্নিত করতে চান এঁরা ‘অশ্বডিম্ব’রূপে। মজা হলো, ওই শব্দটির প্রভাবকেই যেন পালটা শূন্যগর্ভ করে তুলতে হঠাই দুরন্ত চাঙ্গা হয়ে উঠল দেশের শেয়ারবাজার। প্যাকেজ ঘোষিত হয় মঙ্গলবার। আর বুধবার অর্থমন্ত্রী বিস্তারিত তথ্য দেবার আগেই বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ আর ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্চ ফিরে পেল হারানো গতিবেগ ও প্রাণচাঞ্চল্য। বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই চড়চড় করে ১,২১৪.১৫ পয়েন্ট উঠে যায় শেয়ার সূচক। ফিফটি সূচকেও প্রাণ আসে ৩৪৭.৭৫ পয়েন্টের চকিত বৃদ্ধিতে। করোনা কবলিত একটি দেশে যখন শেয়ারমার্কেটের এই ধরনের উচ্চলন ঘটে, তার মর্মার্থ প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই অনুধাবন করতে সক্ষম। আমি আর কী বলব!
শেখর সেনগুপ্ত
(লেখক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক আধিকারিক)