ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ও ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সম্পর্ক

তখন যোগমায়া দেবীর বয়স ৮২ বছর; যোগমায়া দেবী স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সহধর্মিণী, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বৃদ্ধা মা। ১৯৫৩ সালের ২৪ শে জুন সকালে তিনি খবর পেয়েছেন আগের দিন তাঁর প্রিয়তম পুত্র কাশ্মীরে ‘এক বিধান এক প্রধান এক নিশান’-এর জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে বন্দীদশায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। শোকে একেবারে ভেঙ্গে পরেছেন তিনি। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে কেঁদে কেঁদে প্রশ্ন করছেন, কেমন করে ভুলতে পারি যে শ্যামা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। এই তো বিধান ছিল, সে আমার শ্যামার মতো, বিধান তুমি আছো, আর আমার ছেলে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল?

কাশ্মীরে শ্যামাপ্রসাদের রহস্য মৃত্যুর তদন্ত হয় নি। সমস্ত জাতির সমবেত দাবী, মানবাধিকারকে অমান্য করেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। শ্যামাপ্রসাদের বিধবা মার আবেদনও অস্বীকার করলেন নেহেরু৷

নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে ৬ ই জুন লেখা শ্যামাপ্রসাদের চিঠি ১২ ই জুন কলকাতায় হাতে পেয়েছিলেন তাঁর ভাই। ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হল, আর অনুরোধ করা হল কাশ্মীর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রার্থনা জানিয়ে। ডা. রায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, তিনি শেখ আবদুল্লার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন তা জানালেন।

৪ ঠা জুলাই যোগমায়া দেবী নেহেরুকে যে চিঠি লেখেন তাতে উল্লেখ ছিল, যখন তাকে (শ্যামাপ্রসাদকে) হাসপাতালে পাঠানো হল, তখনও তারা খবরটি আমাদের বা ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে অবিলম্বে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।
নেহেরুর সঙ্গে চিঠি চালাচালির মধ্যে ৯ ই জুলাই নেহেরুকে আবার চিঠি লেখেন শ্যামাপ্রসাদের মা, তাতে উল্লেখ করলেন, আমার চিঠিতে উল্লিখিত নানা বিষয়ের উত্তর পাই নি।…..আপনি কারাগারের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন বিদেশী শাসনাধীনে আর আমার ছেলে বিনা বিচারে বন্দীদশায় মৃত্যুবরণ করল এক জাতীয় সরকারের আমলে।….আপনি প্রকৃত ঘটনার সম্মুখীন হতে ভয় পাচ্ছেন। আমার পুত্রের মৃত্যুর জন্য আমি কাশ্মীর সরকারকে দায়ী করছি। আপনার সরকারকে এই অপকর্মের অংশীদার হিসেবে অভিযুক্ত করছি। আপনি আপনার হাতে যা বিপুল ক্ষমতা তার সব কিছু দিয়ে বেপরোয়া প্রচার চালাতে পারেন, কিন্তু সত্য নিজে তার প্রকাশের পথ খুঁজে নেবেই, এবং একদিন আপনাকে ভারতবাসীর কাছে এবং ঈশ্বরের কাছে এর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে।

শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সুসম্পর্ক ছিল। নানান সময়ে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছিলেন মানুষের জন্যে। বিধানচন্দ্রের প্রতি তাঁর বিশেষ আস্থা ছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরে (১৯৪৩) শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগে যে বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটিতে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে রাখলেন, তিনি বদ্রিদাস গোয়েঙ্কাকে সভাপতি করে, নিজে সহ-সভাপতির দায়িত্ব নিলেন৷
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৪২–১৯৪৪) তখন পেশাগত কারণে ও রাজনৈতিক ব্যস্ততায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ঠিকমতো দেখতে পারতেন না। এই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ব্যাপারে বহুলাংশে শ্যামাপ্রসাদের উপর নির্ভর করতেন। কারণ শ্যামাপ্রসাদ ইতোমধ্যে চার বছর উপাচার্য হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন (১৯৩৪ — ১৯৩৮) এবং তারও দশ বছর আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে ও সিণ্ডিকেটের মেম্বার ছিলেন। এত বড় অভিজ্ঞতা সেই সময় কোনো শিক্ষাবিদের ছিল না। জাস্টিস রাধাবিনোদ পালকেও উপাচার্য কালীন সময়ে (১৯৪৪ — ১৯৪৬) শ্যামাপ্রসাদ নানানভাবে সহায়তা করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক উপাচার্য আজিজুল হক (১৯৩৮ –১৯৪২) ছাড়া সমসাময়িক প্রায় সকল উপাচার্য তাঁর সহায়তা নিয়েছিলেন ( আচার্য যদুনাথ সরকার, ১৯২৬ — ১৯২৮; ডব্লিউ এস আরকুহার্ট, ১৯২৮ — ১৯৩০; হাসান সরওয়ার্দি, ১৯৩০ – ১৯৩৪)। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ও সহায়তা নিলেন শ্যামাপ্রসাদের।

১৯৫০ সালের ৮ ই মার্চ, তখন শ্যামাপ্রসাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য, শিল্প ও সরবরাহ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। নেহেরু শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশনের কাছে এবং যশোর রোডের ধারে উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে করছেন, সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়। তারা সমবেতভাবে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, দুজনে বাংলা কথাগুলি অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন নেহেরুকে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি যাতে যথোপযুক্ত কেন্দ্রীয় সহায়তা পায়। ইতোমধ্যে এই বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পূর্ব বাংলার অগুনতি পীড়িত হিন্দু এপার বঙ্গে আসতে শুরু করেছেন। বরিশাল থেকে যাতে হিন্দুরা স্টীমারে কলকাতা পর্যন্ত আসতে পারেন, তারজন্য মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ব্রিটিশ স্টীমার কোম্পানিগুলিকে আবেদন জানালেন যাতে বেশি করে স্টীমার চালানো যায়। বরিশাল থেকে এইভাবে এক লাখ হিন্দু ৭৫ ঘন্টায় কলকাতায় আসতে সমর্থ হল। এই কাজে শ্যামাপ্রসাদ বিধান রায়কে সবসময় সহায়তা করে এসেছেন। কারণ রিফিউজিদের নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ কখনও রাজনীতি করেন নি, যা বামপন্থীরা চিরকাল করে এসেছে।

যে ‘নেহেরু-লিয়াকৎ’ চুক্তি(১৯৫০ সালের ৮ ই এপ্রিল)-কে ‘নিষ্ফল চুক্তি’ বলে অভিহিত করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দুই বাঙালি মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন (শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এবং বাণিজ্য মন্ত্রী ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী), সেই বৈঠকে নেহেরু ডাকলেও তাতে যোগ দেন নি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি দিল্লিতে বৈঠকে আসবেন, তার আগে বিধান বাবুকে দিল্লি ডেকে পাঠালেন নেহেরু। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় থাকার অনুরোধ; কিন্তু ডাক্তার রায় নেহেরুর নির্দেশ অমান্য করে আগেই কলকাতা ফিরে এলেন। হয়তো তিনিও জানতেন এই চুক্তি হতে যাচ্ছে বাঙালি হিন্দুকে প্রবল বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলার জন্য। এই চুক্তি কেবল ভারতীয় মুসলমানদের সুখ-সমৃদ্ধি এনে দিল তাই নয়, নিরপত্তার চিরস্থায়ী সমাধান করে দিল; অথচ পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনগণ চিরস্থায়ীভাবে নেকড়েদের মুখের খাবার হিসাবে পড়ে রইলো। নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি যে কতটা হিন্দু বিরোধী তা যারা যথাযথ ভাবে খোঁজ করবেন, বুঝতে পারবেন। শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন এবং প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন, কারণ তিনি কংগ্রেসী ছিলেন না। বিধান রায় বুঝেছিলেন, কিন্তু তিনি কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাই কোনো কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। ইতিহাসের এ এক চরম ট্র্যাজেডি!

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ড. শীর্ষ চ্যাটার্জী
ছবি : ড. গোপী ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.