চীনকে বুঝতে হবে এটা নতুন ভারত, আত্মনির্ভর ভারত, আত্মবিশ্বাসী ভারত

এই বছরে চীনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৭০তম বর্ষপূর্তি। ফলে দুই দেশ জুড়ে সত্তরটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা উদ্যাপন করার পূর্বপরিকল্পনা ছিল, করোনা নামক এক চীনা ভাইরাস সে স্বপ্নে যবনিকা টেনে দিয়েছে। তবে শুধুমাত্র সংক্রমণের উৎস ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্ধিহান হওয়া অবধি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন থেমে থাকেনি। ভুটানের ডোকালাম সীমান্তে ৭২ দিন ধরে চোখে চোখ-রাখা পরিস্থিতি শান্ত হতে না হতেই এই বিশ্বব্যাপী করোনা প্রকোপের মধ্যেই পূর্ব লাদাখে গালোয়ান উপত্যাকায় লাইন অব একচ্যুয়াল কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চীন আবার নতুন করে তাদের আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক নৈকট্যই বেজিংয়ের উদ্বেগের মূল কারণ। তাৎক্ষণিক সমস্যা হলো অকসাই চীন সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নীতি পরিবর্তন ও ভারতের লাগাতার জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপ।

আকসাই চীন এলাকাটি চিরকাল ভারতীয় মানচিত্রের অংশ । লাদাখের বিজেপি সাংসদ জামিয়াং শেরিং নামগিয়ালের স্পষ্ট বক্তব্য হলো জওহরলাল নেহরুর কারণেই ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের ফলস্বরূপ আকসাই চীন ভারতের হাতছাড়া হয়েছিল। কেন্দ্রে ২০১৪-য় বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উ পত্যকা ঘেঁষে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাট-সহ অবকাঠামো তৈরি করতে শুরু করেছে তাতে চীন প্রথমবার সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছে এবং ভয়ও পেয়েছে। লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণকে তাই চীন একটি হুমকি হিসাবেই দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যে মহাসড়কটি চীন তৈরি করেছে, তার নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে আদৌ আর তাদের হাতে থাকবে কিনা, সেই বিষয়ে চীন নিশ্চিত হতে পারছে না। এমনিতেই এই দুটো প্রত্যন্ত প্রদেশের বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই সংশয়িত। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীনের মধ্য দিয়ে গেছে। আর তারা একথাও জানে যে, আজকের নরেন্দ্র মোদীর ভারত আর সেদিনের নেহরুর ভারত এক নয়।

চীনের হৃঙ্গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে ৫ আগস্ট ২০১৯-এ সংবিধানের ৩৭০ ধারা খারিজের বিতর্কে সংসদে এক বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন যে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে নেওয়া যে কোনও সিদ্ধান্ত পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং আকসাই চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে গালোয়ান উপত্যকায় এখন চীন পদক্ষেপ করছে, সেখানে একসময় সাময়িকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ভারতের হাতে বিপুল শক্তিশালী চীনা ফৌজকে চরম লোকসান পোয়াতে হয়েছিল। বস্তুত ১৯৬২-র যুদ্ধে গালোয়ান উপত্যকায় চীন যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, সেই স্মৃতি এখনো তাদের তাড়া করে ফেরে। Snow of the Himalayas : Sino-Indian War Records (Chinese Edition 1991) বইতে পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রাক্তন অফিসার সুন জিয়াও লেখেন, “যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতীয় সেনার গোলাবারুদের ব্যবহার ভয়ানক ক্ষতিকারক ছিল। দু’ঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধের পর চীনা সেনা যদিও গালোয়ান উপত্যাকা দখল করতে সক্ষম হয়, তার জন্য মারাত্মক দাম চোকাতে হয়েছিল। ৮৭৪ জন। সৈন্যকে আমরা ওই বরফ ঢাকা উপত্যকায়। হারাই, ১৯৮০-৮২ সালে যাদের মধ্যে ৮০০-র বেশি সেনার দেহাবশেষ ওখান থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।” এবার চীন এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণরেখা পার করেনি, কিন্তু করলে কী হবে, সেটা তাদের অজানা নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরেই করে চলেছে। করোনা ভাইরাস মহামারীতে সারা বিশ্ব যখন ব্যস্ত, তখন বেজিং এটাকে একটা লক্ষ্য হাসিলের সুযোগ ব্যবহার করছে। সারা বিশ্বে শেয়ার বাজারের ধসের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির কোটি কোটি শেয়ার কানাকড়ির দামে কিনে নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সরবরাহের গোটা দিকটাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু ভারত সীমান্তে চাপসৃষ্টিকরাই নয়, হংকংয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন। গোটা দক্ষিণ চীন-সমুদ্র জুড়ে চীনের সৈনিক গতিবিধিও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরেও সংকটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ সাহায্য দিয়ে বেজিং এমনভাবেই তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। তবে ২০০৮ আর ২০২০-র মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। এবারে কিন্তু করোনা পরবর্তী কালখণ্ডে চীনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভিন্ন এবং ব্যাপক বেরোজগারি ও খাদ্যসংকটকে কেন্দ্র করে চীনে ভয়ানক গণঅসন্তোষ দানা বাঁধছে। রাষ্ট্রপতি পি জিং পিং-এর নেতৃত্ব আজ প্রশ্নের মুখে। প্রিমিয়ার লি-র সঙ্গে ওঁর নীতিগত মতভেদও প্রকাশ্যে এসে গেছে। ওদিকে চীনের ভেতরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির গ্রহণযোগ্যতা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে। যেভাবেই হোক শি জিন পিং অভ্যন্তরীণ সংকটের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন। চীনের ইদানীংকার সমস্ত পদক্ষেপই সেই আলোকেও দেখা প্রয়োজন।

এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের স্বার্থে এমন কিছু অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছেন। যা ভারত ও চীনের এযাবৎকার সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রথমত, বহুদিন ধরে চীন ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী ছিল, যদিও রপ্তানির চেয়ে চীন থেকে অনেক বেশি আমদানি করে ভারত। গত বছর বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৩০০ কোটি ডলার। ভারতে এখন মেক ইন ইন্ডিয়ার হাওয়া বইছে, প্রধানমন্ত্রী চাইছেন দেশ আত্মনির্ভর হোক, বিশ্বের অগ্রণী উৎপাদনকারী শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। ফলে ভারত এখন একদিকে যেমন চীন থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতে চলে এলে সবরকম সাহায্য দেবার কথা বলছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও আর তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ভারত এত দশক পর প্রথমবার তার নিজস্ব স্বার্থরক্ষার প্রতি যে দায়বদ্ধতাটা প্রকাশ করছে, এতদিন ধরে একতরফা মুনাফা লুটে যাওয়া চীনের স্বভাবতই সেটা মোটেও ভালো লাগছে না।

দ্বিতীয়ত, চীনের বেসরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন লেখায় এমন কিছু মন্তব্য করেছে যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ভারতকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী একটি অক্ষের অংশ হিসাবেই মনে করছে। ২৫ মে, ২০১৯-এর সংখ্যায় একজন চীনা বিশ্লেষক। লং শিং চুং উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন, “ভারত সরকার যেন তাদের দেশকে। যুক্তরাষ্ট্রের কামানের গোলা হিসাবে ব্যবহৃত না হতে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার দুই দেশকেই সতর্ক থাকতে হবে, কারণ যে কোনো সুযোগেই শাস্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব।” প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কোয়ালামপুরস্থিত চীন বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি বিবিসিকে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি ‘অক্ষশক্তি তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে। আমেরিকা মনে করে চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত দশ বছরে তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মতো অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। ফলে নিজেদের সামরিক শক্তি নিয়ে চীন যতই আস্ফালন করুক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণে যে এখন ভারতের গুরুত্ব ও প্রভাব ক্রমবর্ধমান, সেটা চীনকে বিচলিত ও উত্তেজিত, দুটোই করছে।

চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের ৩৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন। কিছু নয়। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫০০০ বর্গমাইল ভারতীয় এলাকা চীন দখল করে বসে আছে, যা নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতের পক্ষে আর মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে দাবি করে প্রতিনিয়ত উৎপাত সৃষ্টি করে, সেটাও বন্ধ হওয়া দরকার। করোনার সংক্রমণের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন সারা বিশ্ব, বিশেষত পশ্চিমি দেশগুলো জুড়ে চীনের কমিউনিস্ট সরকারের প্রতি একটি বিতৃষ্ণার আবহ তৈরি হয়েছে, যা চীনের পক্ষে অশনিসংকেত। তার ওপর ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন্স, তাইওয়ান, তিব্বত, কাজকিস্তান এবং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামক অপরিশোধীয় ঋণ-অস্ত্র ব্যবহার করে এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে চীনা সাম্রাজ্যবাদের যে কদর্যরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, তাতে চীন আজ বাস্তবিকই একঘরে। ভারত সীমান্তে চীনের আস্ফালন আসলে এক মনস্তাত্ত্বিক দাবাখেলা, যার জবাব ভারত ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে। গত ১৬ বছর ধরে সীমান্তবর্তী যে সমস্ত রাস্তা চুরির ফাঁদে আটকে ছিল, নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেগুলোকে প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন। ওদিকে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপার থেকে চীন চোখ রাঙাচ্ছে। আর এদিকে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন এগারোটা ট্রেন ভর্তি করে ১১, ৮১৫ জন নতুন শ্রমিক নিয়ে গিয়ে ডারবুক-শয়ক-দৌলতবেগের রাস্তার কাজ সম্পূর্ণ করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।

চীনকে বুঝতে হবে যে এটা নতুন ভারত, আত্মনির্ভর ভারত, আত্মবিশ্বাসী ভারত। ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও নেহাত ব্যবসায়িক মুনাফা পাইয়ে দেওয়ার দৌলতে এতদিন পার পেয়ে গেছে। এখন তাদের ভয় দেখানোর দিন শেষ, ভয় পাওয়ার দিন শুরু হয়েছে। হয় নিজেরা শোধরাবে, হয় শুধরে দেওয়া হবে।

সঞ্জয় সোম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.