চলতি মে মাসে করোনা সংক্রমণ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। এও বলেছিলেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাদের সেই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ২৫ হাজার পেরিয়ে গেছে। মৃত্যুর সংখ্যা চারশোর দোরগোড়ায়। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিস বিভাগ জানিয়েছে, গত ৯ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ৯২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ হিসেবটা সরকারি মৃত্যুর সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু বাংলাদেশে করোনার এই ভয়ংকর তাণ্ডবের মধ্যেও হামলা, জায়গাজমি দখল ও হিন্দুদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সৎকার নিয়ে নেতিবাচক ধারণাসৃষ্টির চেষ্টা। হিন্দুদের মধ্যে করোনার পাশাপাশি অস্তিত্ব নিয়েও নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে গত সপ্তাহে হঠাৎ করে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে এক ঘোষণা দিয়ে পূর্বের নিষেধাজ্ঞা তুলে নামাজের জন্য মসজিদ পুরো খুলে দেওয়া হয়, তবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়। যদিও প্রথম দিন থেকেই নামাজে গিয়ে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মেনেছেন, এটা দেখা যায়নি। বরং দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে যেভাবে নামাজ পড়া হয়, সেভাবেই সবাই নামাজ পড়ছেন। আলেমদের একটি বড়ো অংশ মসজিদখুলে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করতে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকার তাদের দাবির কাছে মাথা নত করে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ধর্মমন্ত্রী অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের ক্ষেত্রেও একই শৈথিল্য কার্যকর হবে বলে জানান। কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সমাজ এই শৈথিল্য মেনে নিতে নারাজ। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের স্থায়ী কমিটির এক ভিডিয়ো সম্মেলনে তিন সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এই শৈথিল্য আরও ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। করোনার সংক্রমণ যেভাবে ভয়ংকর গতিতে এগোচ্ছে সেখানে ধর্মস্থানেও শৈথিল্যের কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। হিন্দু নেতারা বলেছেন, তবে মন্দিরে সেবায়েত-পূজারিদের তারা নিত্য পূজার্চনা অব্যাহত রাখতে বলেছেন। বাইরে থেকে ভক্তদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের আরাধনা ঘরে বসেও হতে পারে। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজ করেন। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নেতারাও একইভাবে সামাজিক সংক্রমণ এড়াতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। সংখ্যালঘু নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আলেমদের কাছে সরকারের আত্মসমর্পণ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্বল করে দিতে পারে।
ঐক্য পরিষদের ভিডিয়ো সম্মেলনে আরও বলা হয়েছে, মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়েছে। তারপর থেকে যেভাবে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সমাজের ওপর হামলা, তাদের বাড়িঘর, মন্দির দখল , অগ্নিসংযোগ, প্রতিমা ভাঙচুর, কিশোরী ও যুবতীদের অপহরণ করে ধর্মান্তরিত করা এবং দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে চলিত মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই হামলা হচ্ছে। ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ও অন্যান্য হিন্দু নেতারা বলেছেন, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ১৯৯০, ১৯৯২ এবং ২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্বে ও পরে ছাড়া আর কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। এবার করোনা হানার পর গোটা দেশ যখন ভয়ংকর দুঃসময়ের মুখোমুখি তখন হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। মূল লক্ষ্য দেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করা। প্রশাসনকে জানানো সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। হিন্দু নেতারা আরও অভিযোগ করেছেন, সমাজের একটি অংশ মনে করছে করোনার তাণ্ডবের সময় হিন্দুদের ওপর হামলা চালালে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন এবং সুবিধামতো সময়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই দুর্বল সময়ে তাদের জায়গাজমি দখলে নেয়া সহজ হবে। এছাড়া বাংলাদেশের পূজা সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা অভিযোগ। করেছেন, করোনায় মৃত্যু কিংবা করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পর হিন্দুদের সৎকার নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারিভাবে বলা হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পর সুনির্দিষ্টনির্দেশনা অনুযায়ী সকার করবে প্রশাসন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সুনির্দিষ্ট পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরাই মৃতদেহ স্পর্শ ও বহন করবেন। পরিবারের অন্তত একজন ধর্মীয় রীতি নিশ্চিত করতে এই দলের সঙ্গে থাকবেন। প্রশাসন নিয়োজিত দলের নেতা মৃতের পরিবারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া সম্পাদন করবেন। দেখতে হবে কোনোভাবেই যেন ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যত্যয়
ঘটে। কিন্তু বিষয়টিকে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যেন পরিবারের কেউ সৎকার প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন না। দয়া করে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ সৎকারে এগিয়ে আসছেন। এতে ওই পরিবারের প্রতিই অসম্মান করা হচ্ছে। বাবা, মা কিংবা অন্য কোনো ঘনিষ্ঠ আপনজনকে হারানোর দুঃখ আরও প্রকট হচ্ছে। পূজা উদ্যাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দ এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং হিন্দু সমাজকে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি