তেলেনিপাড়ায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ ইন্টারনেট বন্ধ করে সত্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা

আমার ছোটবেলার শহর চন্দননগর। আমাদের ছোটবেলায় সকালে আমাদের ঘুম ভাঙত একের পর এক জুটমিলের সাইরেন শুনে।বড়োরামিলের শিফট শেষের সাইরেনের আওয়াজ শুনে ঘড়ি মেলাতেন। সকালে আর সন্ধ্যেয় দেখতাম দলে দলে লোক জিটিরোড ধরে সাইকেল নিয়ে চলেছে বিভিন্ন মিলে কাজ করতে।

গঙ্গার ধারের চন্দননগর আর ভদ্রেশ্বরের সংলগ্ন এই তেলিনীপাড়া শুধুমাত্র চন্দননগরেরই নয়, পুরো পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। ইন্ডিয়া জুটমিল, বঙ্গশ্রী জুটমিল, ভিক্টোরিয়া জুটমিল –এই তিনটি মিলে কর্মসংস্থান হতো কয়েক লক্ষ মানুষের। তবে আজ সেসব নেহাতই অতীত দিনের কথা। একের পর এক ইউনিয়নের ঝামেলা আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবসা বিমুখ নীতি আজ তেলিনীপাড়ার সেই সুদিন আর নেই। তবে এই মিলগুলিতে কাজ করতে আসা বাঙ্গালি, তেলুগু, ওড়িয়া, বিহারি শ্রমিকদের জীবন আজও এই জুটমিল এবং সেই সংলগ্ন এলাকাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। মূলত শ্রমিক কলোনিগুলিতেই এদের বসবাস। সেখানে এই মহামারীর সময়ে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং সত্যিই খুব কঠিন কাজ। কিন্তু তার পরেও তারা লড়ছিলেন নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারকে এই ভয়াবহ চীনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করতে। নিজেদের রুজি রুটি ক্ষতিগ্রস্ত করেও তারা লড়ছিলেন। কিন্তু সেই লড়াইই আজ তাদের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। কয়েকদিন ধরেই চন্দননগরের উর্দিবাজারে একের পর এক করোনা আক্রান্তের হদিশ পাওয়া গেছে। সেই ঘটনার রেশ আছড়ে পড়েছে। সিঙ্গুরের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারেও। তেলিনীপাড়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও কিছু মানুষ করোনা আক্রান্ত বলে খবর হয়। যেহেতু রাজ্য

সরকার কোথায় কত আক্রান্ত এবং তাদের এলাকার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করছে না, ফলে তেলিনীপাড়ার মানুষকে এই খবরের উপরেই নির্ভর করে চলতে হয়। এমতাবস্থায় নিজেদের রক্ষার্থে তারা সিদ্ধান্ত নেন আপাতত তারা নিজেদের এলাকা বন্ধ রাখবেন এবং সেখানে অন্য এলাকার কাউকে আগামী ১৫ দিন প্রবেশ করতে দেবেন না। কারণ তাঁরা জানেন এই ঘনবসতি এলাকায় একবার যদি চীনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরে তাহলে তা অতিদ্রুত সমগ্র এলাকার অধিকাংশ মানুষকে আক্রান্ত করে ফেলবে। এই ঘন বসতি এলাকাকে তাই আশপাশের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়াই তাদের কাছে একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কন্টেইনমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানা যাচ্ছে, এই ব্যবস্থা চালু করার পরে তাঁরা এলাকায় বাইরের সবজিওয়ালা, ফলওয়ালা সবারই প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। এমনকী এলাকায় রমজান উপলক্ষ্যে যে বাজার বসে সেই বাজার সম্বন্ধেও তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে তাদের এলাকার মধ্যে এই বাজার তাঁরা এবছর চালু করবেন না। কারণ বাজার থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই বেশি। তামিলনাড়ুর সবজি মন্ডির উদাহরণ আমরা সবাই জানি।।

এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, এক মুসলমান সবজিওয়ালা যখন তাদের এলাকায় প্রবেশ করতে চায় তখন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী কিছু যুবক তাকে বলে আপাতত পনেরো দিন এই এলাকায় বহিরাগত কার প্রবেশ নিষেধ। এরপর সবজিওয়ালার সাথে যুবকদের কিছু বাকবিতণ্ডা হয়। কিন্তু সেই ঘটনা বেশিদূর এগোয়নি। এরপরে সন্ধ্যেয় বৃষ্টি নামে। স্থানীয়রা সবাই নিজের নিজের বাড়িতেই ছিলেন। এমন সময় অপ্রত্যাশিত আক্রমণ শুরু হয় তাদের উপর। আঘাত হানা হয় মন্দিরে। ভাঙচুর করা হয় বেশ কিছু দোকান, বাড়ি। প্রথমটায় অকস্মাৎ আক্রমণের অভিঘাতে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। নিজেদের শ্রমিক কলোনির বাড়ি ছেড়ে তারা আশ্রয় নেয় জুট মিলগুলিতে। আক্রমণকারীরা একেনিজেদের জয় ভেবে নিয়ে আরও দ্বিগুণ উল্লাসে আক্রমণ শুরু করে। মুহুর্মুহু বোমাবাজি শুরু হয় এলাকায়। কিন্তু এই পুরো পর্বে কোথাও পুলিশের দেখা পাওয়া যায়নি।

এই সময় স্থানীয়রা প্রাথমিক আক্রমণের আকস্মিকতা সামলে নিয়ে নিজেরাও পালটা আক্রমণ করে আত্মরক্ষার্থে। এবার পুলিশের দেখা পাওয়া যায়। পুলিশ পথে নামে এবং গ্রেপ্তার করে বেশ কিছু স্থানীয় যুবককে। তাদের অপরাধ, তারা আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ করছিল। উলটোদিকে যারা বোমাবাজি করছিল, মন্দিরে আক্রমণ করেছিল তারা নির্বিঘ্নে ফিরে যায় নিজের এলাকায়।।

এর পরেরদিন পরিস্থিতি শান্ত ছিল। কিন্তু পার্শ্ববর্তী মুসলমান এলাকার এক শাসক দলের নেতার নেতৃত্বে জমায়েত হয় এবং সেই জমায়েতে ঘোষণা করা হয় তারা পরেরদিন সকালে এক প্রতিবাদ মিছিল বার করবেন। পরের দিন সকালে প্রতিবাদ মিছিলের নামে পুরো এলাকায় শুরু হয় তাণ্ডব। মুহুর্মুহু ধর্মীয় স্লোগান তুলে তারা শ্রমিক কলোনির একের পর এক বাড়িতে আক্রমণ শুরু করে। বোমার ধোঁয়ায় ভরে যায় এলাকা। বেশ কিছু দোকানে আগুন লাগানো হয়। আমরা অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিয়োতে দেখেছি কীভাবে বহুদূর পর্যন্ত সেই কালে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই পুরো ঘটনার সময় পুলিশ নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। বরং আবারও যখন স্থানীয়রা আত্মরক্ষার্থে নামেন তখন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই অভিযোগ খুব অসত্য বলে মনে হয়

যখন দেখি পুলিশ কমিশনার স্থানীয় সাংসদের ফোন ধরার মতো শিষ্ঠাচারটুকু দেখাচ্ছেন না। এখনও পর্যন্ত ঘটনা সম্বন্ধে যেটুকু বর্ণনা দিয়েছি সেসবই স্থানীয় সূত্রে নানা অভিযোগ এবং প্রতি অভিযোগ। কিন্তু সেই অভিযোগ, পালটা অভিযোগের জাল ছিন্ন করে সত্য ঘটনা প্রকাশ করার দায়িত্ব যাদের তাদের হতাশজনক ভূমিকা দেখে মনে হয় না প্রকৃত সত্য কোনো দিনই জানা যাবে। বিশেষত যখন অভিযুক্তের বাড়িতে চাল, ডাল পৌঁছে দেওয়াটাই এখন দস্তুর এই রাজ্যে।

তেলিনীপাড়ার মানুষদের দাবি অযৌক্তিক নয়। তারা এই অতিমারীর সময়ে নিজেদের এবং পরিবারের সুরক্ষার কথাটুকু ভাবতে চেয়েছেন শুধু। সেই ভাবনা থেকে সরকারের নির্দেশানুসারে লকডাউন এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের বোধহয় সেই অধিকারটুকুও নেই। সেই কারণে যখন তারা আক্রান্ত, পুলিশ মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে। আর যখন তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে তখন পুলিশ তাদের উপরেই জুলুম করেছে। এই অবিচারের শেষ কোথায় তা আমরা কেউ জানি না। শুধু এটুকুই আমরা জানি যে আমাদের সহ্যের সীমা খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। এমতাবস্থায় সবার, বিশেষত প্রশাসনের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটবে এই আশাই আমরা রাখতে পারি। তা নাহলে সামনের সময় অত্যন্ত অন্ধকার। আমরা এখনও আশা রাখি প্রশাসন নিরীহ নির্দোষ মানুষকে নয়, প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করে সত্য ঘটনা প্রকাশ করবে। ইন্টারনেট বন্ধ করে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা না করে ঘটনার প্রকৃত তদন্ত করবে।

দীপ্তাস্য যশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.