ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ল। হাতে গোনা কয়েকটা দিন। তারপরেই দেশের প্রায় ৯০ কোটি ভোটার সিদ্ধান্ত জানাবেন, ভারতবর্ষের নতুন প্রশাসক কে হবেন। গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই দামামা তুঙ্গে। সত্য-মিথ্যা, দ্বেষ-বিদ্বেষ, স্তুতি-ঘৃণা, সুবাক্য-কুবাক্য, শ্লীল-অশ্লীল, অম্ল-মধুর ভাষণের তরজার ধুন্দমার চলবে যতদিন না ভোটের ফল চূড়ান্ত হচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ভোট-যুদ্ধে এটাই রেওয়াজ। পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলবে, বুদ্ধিজীবীরা বিতর্কে যোগ দেবেন, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষজন গান বাঁধবেন, পথনাটিকার স্ক্রিপ রচিত হবে, সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে ওয়ালে ছড়িয়ে পড়বে ব্যঙ্গচিত্র, ব্যঙ্গাত্মক ছড়া, ব্যঙ্গাত্মক সংলাপ আর রাস্তার মোড়ে, গ্রাম-শহরের আনাচে-কানাচে বড়ো মেজো সেজো, ন, নতুন, ছোটো নেতা-নেত্রীরা গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেবেন, রাস্তাঘাট, দেওয়াল জুড়ে চলবে রাজনৈতিক দলের আল্পনা আঁকা আর উদ্দাম স্লোগানে ঝালাপালা হবে কান। ভারতবর্ষের ভোটযুদ্ধ এটাই চিরকাল তাই হয়ে এসেছে। হয়তো ভারতবর্ষের সর্বত্রই ছবিটা থাকবে এমনই। একমাত্র ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া। কারণ পশ্চিমবঙ্গে ভোট মানে আনন্দের উৎসব নয়। রক্তের হোলিখেলা। পশ্চিমবঙ্গের ভোট মানে অপসংস্কৃতির জোয়ারে রাজ্যকে ভাসিয়ে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গের ভোট মানে মিথ্যার বেসাতি করা। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে অশ্লীলতার রাজনীতির জটিল আবর্তে রাজ্যবাসীকে বিভ্রান্ত করা। অদূর অতীতে পশ্চিমবঙ্গেও ভোট মানে ছিল উৎসব। ভোটের দিন বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আর শহরের মধ্যবিত্ত পাড়াগুলিতে বয়ে যেত এক অদ্ভুত উন্মাদনা। বিশেষ করে মহিলামহলে কে কি শাড়ি পরবেন, কে কীভাবে চুল বাঁধবেন, কে কাকে ভোট দেবেন— এসব নিয়ে চলত জোরকদমে আলোচনা। রাজনীতির কথা ছিল কম। রাজনীতির বাইরের কথাই বেশি। আর ভোটের দিন সকাল সকাল রান্নাবান্না সেরে দল বেঁধে আলতা-পরা পায়ে ভোটের লাইনে। রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাছে তারা ছিলেন মাসিমা, কাকিমা, ঠাকুমা, বৌদি। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র থাকত না। এমনকী লাঠিও নয়।
সে এক দিন ছিল। দিনটা এখন বদলে গেছে। শুরু বামফ্রন্টের আমল থেকেই। তবে রাজনৈতিক ভোটের সংস্কৃতির আগাপাশতলা মুড়িয়ে গেল ২০১১ সাল থেকেই যখন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আমদানি হলো তৃণমূলি সংস্কৃতির। এ সংস্কৃতির কোনও ব্যাকরণ নেই। এ সংস্কৃতির কোনও ঐতিহ্যগত পরম্পরা নেই। এ সংস্কৃতিতে বলা হয় ভোটকে প্রহসনে পরিণত করার কথা। এ সংস্কৃতিতে ‘উন্নয়ন’কে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এ সংস্কৃতিতে ভোটারদের ‘গুড় -জল, বাতাসা-জল, নকুলদানা-জল খাওয়ানো’র পরামর্শ দেওয়া হয়। এ সংস্কৃতিতে ভোটারদের ‘পাঁচনের বাড়ি’ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ সংস্কৃতিতে ভোট বাক্সকে বিরোধীশূন্য করে দেওয়ার ডাক দেওয়া হয়। আর মানুষের সামনে উন্নয়নের প্রকৃত অর্থকে আড়াল করে গ্রাম-শহরের বহিরঙ্গে পাউডারের প্রলেপ দিয়ে দাবি করা হয়— এ উন্নয়ন বিশ্বশ্রেষ্ঠ। এ রাজ্যে তাই ঘন ঘন ‘বিজনেস সামিট’ হয়। শিল্প হয় না, বরং বন্ধ হয় চালু শিল্প। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ ঘন ঘন বিদেশ যান শিল্পের কোমরে দড়ি দিয়ে আনতে। ফিরে আসেন টেমস আর রাইনের হাওয়া খেয়ে। এরাজ্যে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে যত বেশি সাইকেল দেওয়া হয়, তত বেশি বাড়ে স্কুলছুটের সংখ্যা। যত বেশি অর্থ দেওয়া হয় বই কেনার জন্য, তত বেশি মোবাইল ফোনের বিক্রি বাড়ে। ক্রীড়াখাতে উন্নয়নের নজির গড়তে যত বেশি অর্থসাহায্য করা হয়েছে ক্লাবগুলিকে, তত বেশি পিকনিকের সংখ্যা বেড়েছে, চটুল নাচ গানের আসর বসেছে তত বেশি। পিঠে উৎসব, ইলিশ উৎসব, বোরোলি উৎসব, মৌরলা উৎসব, পুঁটি উৎসব হতে পারে এ রাজ্যে বছরভর। কিন্তু ভোটটাকে ‘উৎসব’ হতে দেয় না শাসক দল। তাই ভোটের দিন গুনে গুনে লাশ পড়ে। বোমার আগুন ছিটকোয়। পিস্তলের গুলি ছোটে। ভোটের লাইন ফাঁকা হয়ে যায়। ভোটবাক্স ভরে ছাপ্পা ভোটে।
গত ৭ বছরে রাজ্যে যে কটি ভোট হয়েছে, সব কটিতেই অভিজ্ঞতা তাই। ভোটের আগে মানুষকে ভুল বোঝানো। ধরা পড়ার পর ভোটার পেটানো। ২০১৯-এর ভোট কী হবে। কোন স্বতন্ত্র চেহারা নেবে?
এ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বুঝে গেছে, মুখে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত বলুন না কেন- ‘২০১৯, বিজেপি ফিনিশ’, তিনি নিজেও হাড়ে হাড়ে বুঝছেন, তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি। ২০১৬-র রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন এবং ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে গত তিন বছরে। সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে ‘জনজাগরণ’ হিসেবে প্রচার করা হলেও মানুষ বুঝে গেছে, দুটি আন্দোলনই ছিল মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে শাসকদল আর দলনেত্রীর ব্যক্তিগত আখের গোছানোর কৌশল।
সেই আক্রমণ এখন আরও প্রবল, আরও প্রখর। এখন নেত্রীর লক্ষ্য ৪২টি লোকসভা আসনে ৪২ টাই তার। অর্থাৎ তিনি চাইছেন পশ্চিমবঙ্গ হোক বিরোধীশূন্য। ভোটের লড়াইয়ে নয়, পাচনের বাড়িতে। ছাপ্পা ভোটে। বোমার বিস্ফোরণে। পিস্তলের গুলিতে। মা বোনের ইজ্জত কেড়ে নিয়ে। ছিন্নমস্তার মতো বিরোধীদের রক্তপান করে। যে মুখে তিনি উন্নয়নের বুলি আউড়ান, সেই মুখেই বলেন, ‘মনে রাখবেন, এ রাজ্যের গুন্ডাদের আমি কন্ট্রোল করি।’ যে মুখে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আউড়ান, সেই মুখে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘গব্বর সিংহ’ বলে গালাগালা দিতে দ্বিধা করেন না। যে মুখে তিনি বাংলার মেয়েদের অনুপ্রেরণা জোগান এগিয়ে যেতে, সেই মুখে তিনি মিথ্যা এবং ভুল ইতিহাস অনর্গল বলে যেতে দ্বিধা করেন না। বাংলা সংস্কৃতিতে এখন একজনের অনুপ্রেরণা ছাড়া কেউ গান গাইতে পারেন না, কেউ নাটক করতে পারেন না, কেউ যাত্রাপালায় অভিনয় করতে পারেন না, কেউ নাচতে পারেন না, কেউ কবিতা, ছড়া, গল্প লিখতে পারেন না। অনুপ্রেরণার দাক্ষিণ্য পাবার জন্য মেলায়, খেলায়, সার্কাসে, গ্রামেগঞ্জে শহরে, দিনে রাতে, দুপুরে, সাদা শাড়ির আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ান শিল্পী, সাহিত্যিক, কলাকুশলীরা। ১৯ জুলাই-এর মধ্যে একটু দাঁড়াবার ঠাঁই যদি মেলে, যদি ইলিশ উৎসবে বিনি পয়সায় একটু ইলিশের ভাপা চাখার আমন্ত্রণ মেলে, যদি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে মুখ দেখাবার একঝলক সুযোগ পাওয়া যায়। তাহলে সব সম্মান, সব যশ, সব ব্যক্তিত্ব হারায় হারাক, শাসকের প্রসাদ থেকে অন্তত বঞ্চিত হতে হয় না। তাই রাতারাতি ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে’ কলকাতার সব সিনেমা হল থেকে একটা জলজ্যান্ত সিনেমা ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ভূত হয়ে যায়। এই কর্তৃপক্ষটি কে তা মানুষ বুঝে গেলেও, তিনি নির্দ্বিধায় বলে দেন, “আমি এসব কিছু জানি না।’
পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এখন সব কিছুই দেখতে হচ্ছে নতুন চশমা পরে। তাই দেখতে হয় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর হোর্ডিংয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণার বড়ো ছবির নিচে এতটুকু রবীন্দ্রনাথকে। নজরুল জন্মজয়ন্তীতে তার পদতলে ছোট্ট নজরুলকে। তাই জানতে পারি, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় কিংবা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর স্মরণসভাও হয় তার অনুপ্রেরণায়। সেখানেও তাঁর মুখব্যাদানের ছবি জ্বলজ্বল করে। Legends of Bengal নামাঙ্কিত হোর্ডিংয়ে সারবন্দি প্রয়াত স্মরণীয় ব্যক্তিদের ছবির সঙ্গে তিনিও জ্বলজ্বল করেন। সবই নতুন করে শিখতে হচ্ছে— শিখতে হচ্ছে প্রতিবাদ করলেই তিনি হবেন মাওবাদী। তারা সমাজে নয়, কারাগারে থাকবেন। সত্য কথা বলা যাবে না। আপনার ঠাঁই হবে কারাগারে। আপনি যদি প্রতারক হন, মুখ্যমন্ত্রী আপনার সমর্থনে রাজপথে নির্লজ্জের মতো ধরনায় বসবেন। চিটফান্ড প্রতারিতরা আর্তনাদ করলে, পুলিশের লাঠিতে তাদের মাথা ফাটাবে। আর তার প্রিয় ভাই অনুব্রত মণ্ডল ‘চড়াম চড়াম’ ঢাকের বাদ্যির হুমকি দিলেও তিনি আদর করে বলবেন, আহা! বেচারা মাঝে মাঝে অক্সিজেনের অভাবে ভোগে। তাই ভুলভাল বলে ফেলে।
গোটা পশ্চিমবঙ্গটাকে গত ৭ বছরে তিনি উন্নয়নের নামে ভিখারির রাজ্যে পরিণত করেছেন। গরিব মানুষের সামনে দু’টাকা কেজি চাল, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী, স্বাস্থ্যশ্রীর মতো ‘ডোল পলিট্রিক্স’-এর টোপ ঝুলিয়ে তাদের হাতে বাটি ধরিয়ে দিয়ে শিরদাঁড়াগুলো কেড়ে নিয়েছেন। ঠিক যেভাবে নিজেকে মাফিয়া সর্দারণি হিসেবে পরিচিত করেছেন, ঠিক সেইভাবেই কলেজে-কলেজে, স্কুলে-স্কুলে, পাড়ায় পাড়ায় তরুণ যুবসমাজের হাতে ঝান্ডার নামে ডান্ডা তুলে দিয়ে শিখিয়েছেন মাস্টারদের মারো, অধ্যাপকদের মাথা ফাটাও, অধ্যক্ষকে চেয়ার থেকে টেনে নামিয়ে দাও, প্রতিবাদীদের পিঠের চামড়া গুটিয়ে দাও। সাংবাদিকদের কলম কেড়ে নাও, আলোচনা সভায় বসে অযৌক্তিক কথা বলে সব গুলিয়ে দাও। বোকা বোকা কথা শুনে লোকে হাসলে ডান্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দাও। তাই ভোট এলেই এখন মানুষ তৈরি হয়ে যায় লাশের পাহাড় গুনতে। মানুষ বুঝে গেছে, এ রাজ্য এখন এক মহিলা স্বৈরাচারীর হাতে যিনি হিটলারও বেঁচে থাকলে সেলাম জানাতেন। স্ট্যালিন অবনত হতেন।
সামনেই ভোট এ রাজ্যেও। এবার মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবেন তারা। বঙ্গসংস্কৃতিকে, নাকি মমতা সংস্কৃতিকে? কোন রাজনীতিকে সম্মান জানাবেন তারা? নীতির রাজাকে নাকি ‘রানি’র নীতিকে? কোন ইতিহাসকে স্মরণ করবেন তারা ? বহুত্ববাদের ইতিহাসকে ? নাকি মুসলমান তোষণের ইতিহাসকে? রাজ্যের মুসলমান ভাই-বোনেরাও আজ বুঝে গেছেন, দিদির তোষণ মানেই শোষণ। প্রতিটি মুসলমান গত ৭ বছর ধরে দেখেছেন, হিজাব পরে আল্লার দোয়াভিক্ষা করাটা মুখ্যমন্ত্রীর নাটুকেপনা চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য তিনি কিছুই করেননি। তারা শিক্ষায় এগোননি। তারা চাকরি পাননি। তারা ব্যবসার সুযোগ পাননি। অথচ শুধু মুসলমানদের তুষ্ট করার জন্য নুসরত জাহানের মতো তৃতীয় শ্রেণীর অভিনেত্রীকে লোকসভার প্রার্থী করেছেন। সময় এসে গেছে এবার বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করার। একথা ঠিক, প্রকাশ্যে প্রতিবাদের সুযোগ নেই। কারণ প্রতিবাদ মানেই এ রাজ্যে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাওয়া। নিঃশব্দে প্রতিবাদ করুন। ‘হোক কলরব’ বলে স্লোগান তোলার দরকার নেই। কলরব হোক ইভিএম মেশিনে। বিশ্বের প্রথম স্বৈরাচারিণীকে একটু শিক্ষা দিন। বুঝিয়ে দিন এ রাজ্যের মাটিতে স্বৈরাচারের ঠাই নেই। তাই চলে যেতে হয়েছে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে। তাই চলে যেতে হয়েছে মেকি বামপন্থীদেরও। এবার ভোটে আনতেই হবে নতুন দিনের সূর্য, নতুন এক ভোরবেলাকে যার নাম গণতন্ত্র।
সৃজিত রায়