~~~পঞ্চম~~~
।।কান্যকুব্জ ক্ষত্রিয়যোদ্ধা মিত্র বংশ।।
বঙ্গেশ্বরী নিয়ে যখন আলোচনা তখন তার সেবায়েত মিত্র বংশের অতীত নিয়েও বলতে হয় বৈকি। বঙ্গেশ্বরী মাতা ঠাকুরানী র প্রতিষ্ঠাতা ও সেবায়েত আঁটপুরের মিত্র বংশের সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রদান করা আবশ্যক । গৌড়েশ্বর জয়ন্তরাজ যজ্ঞ সম্পাদনার্থে কান্যকুব্জ থেকে ৫জন ব্রাহ্মণকে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত অসি, কবচ, ধনু ধারণ করে ৫ জন ক্ষত্রিয় কায়স্থ তাদের সঙ্গে এসেছিলেন। এদের মধ্যে কালিদাস মিত্র অন্যতম ।
কালিদাস মিত্র বঙ্গদেশে মিত্র বংশের আদি পুরুষ। কালিদাস মিত্রের অধঃস্তন নবম পুরুষ ধুইরাম মিত্র ২৪ পরগনার বড়িশা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। বড়িশা মিত্রবংশের শুরু সেই সময় থেকে । তার ভাই গুঁইরাম মিত্র টাকি বসবাস শুরু করলে প্রতিষ্ঠিত হয় টাকিমিত্র বংশ। পরবর্তীকালে বড়িশার মিত্র বংশের জনৈক ব্যক্তি হুগলি জেলার গঙ্গার তীরবর্তী কোন গ্রামে বসতি স্থাপন করলে সূচিত হয় কোন্নগরমিত্র বংশের।
এই কোন্নগর মিত্র বংশের শ্রীরাম মিত্রের নবম পুত্র কন্দর্প মিত্র ভাগ্য অন্বেষণে জন্য ১০৯০ বঙ্গাব্দে আঁটপুরে এসে উপস্থিত হন। আঁটপুর , বোমনগর প্রভৃতি গ্রাম এক সময় ভুরীশ্রেষ্ঠ পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
কথিত আছে, আঁটপুর আগমনকালে কন্দর্প মিত্রের গলায় রাজরাজেশ্বর শালগ্রাম শিলা ঝুলানো ছিল । তিনি গ্রামে প্রবেশ করে একটি বৃক্ষের শাখায় শিলা ঝুলিয়ে রেখে বৃক্ষ তলে বসে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন ।সেই প্রাচীন বকুল গাছ আজও জীবিত রয়েছে। সুপ্রাচীন প্রাচীন বৃক্ষটি বর্তমানে লোকমুখে সিদ্ধ বকুল রূপে চিহ্নিত।
কন্দর্প মিত্রের তিন পুত্র – শোভরাম , কৃপারাম ও রামকিশোর। সেই থেকে আঁটপুর মিত্র বংশ তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায় । শোভারামের জ্যেষ্ঠপুত্র কৃষ্ণরাম মিত্র ১১২৫ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বালক কৃষ্ণরাম একটি হরিতকী গুরুদক্ষিণা দিয়ে গোপীনগর গ্রামে শ্রীরামলোচন ভট্টাচার্যের কাছে দীক্ষা নেন। কৃষ্ণরাম পরবর্তীকালে বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচাঁদ রায়ের দেওয়ান পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তার মহতী প্রচেষ্টায় ১৭০৮ বঙ্গাব্দে আঁটপুরে রাধা গোবিন্দজিউর পোড়ামাটির অলংকরণ সমৃদ্ধ সুবৃহৎ মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। তখন বর্ধমানের রাজা ছিলেন তেজচন্দ্র রায় ।
কন্দর্প মিত্রের দ্বিতীয় পুত্র বংশধররা আঁটপুর পশ্চিম পাড়ায় অন্নপূর্ণা এস্টেট স্থাপন করেন। তৃতীয় শাখা অর্থাৎ ,রামকিশোর মিত্রের বংশধর মথুরমোহন মিত্র জ্যেষ্ঠপুত্র অন্নদাপ্রসাদ মিত্রের সময়কালে প্রতিবেশী বোমনগর গ্রামে স্বপ্নাদিষ্ট বঙ্গেশ্বরী মাতা ঠাকুরানী প্রতিষ্ঠিত হন আনুমানিক ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে।
তবে আঁটপুর মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা কন্দর্প মিত্র শাক্ত ছিলেন। তিনি চণ্ডীমণ্ডপে তন্ত্র মতে চন্ডী পূজা করতেন। পরবর্তীকালে এই বংশে শৈব, শাক্ত, তন্ত্র, বৈষ্ণব এর এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল। বিভিন্ন সময় কালে নির্মিত ধর্মদেউল গুলি তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দিরের সম্মুখ নির্মিত কারুকার্য সমন্বিত কাঠের আটচালা বা নাটমন্দিরটি ১২৭২ বঙ্গাব্দের মহাঝড়ে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়ার পরবর্তীকালে সেই স্থানে ইস্টক নির্মিত নাটমন্দির প্রতিষ্ঠান হয় । তবে কাঁঠাল কাঠের নির্মিত চণ্ডীমণ্ডপ আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
চণ্ডীমণ্ডপটির নির্মাণ সন জানা যায় না ।শোনা যায় এটিই ছিল কন্দর্প মিত্রের তন্ত্র আরাধনার স্থান। তবে লিখিত প্রমাণাদি কিছু নেই । অনেকে মনে করেন তাঁর তন্ত্রসাধনা স্থলের উপর পরবর্তীকালে চন্ডীমন্ডপ নির্মিত হয়েছিল।
দুর্গেশনন্দিনী
(ক্রমশ)