“হাটের লোকের পায়ে-চলা রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরতে ভরসা পায় না বলেই আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর। দক্ষযজ্ঞের গল্পে এই কথাটির পৌরাণিক ব্যাখ্যা মেলে। ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ একেবারে স্বর্গের ফ্যাশানদুরস্ত দেবতা, যাজ্ঞিক মহলে তাঁদের নিমন্ত্রণও জুটত। শিবের ছিল স্টাইল, এত ওরিজিন্যাল যে মন্ত্র-পড়া যজমানেরা তাঁকে হব্যকব্য দেওয়াটা বে-দস্তুর বলে জানত।” (শেষের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাশীদাসী মহাভারত পড়ে জানা যায়, সমুদ্র-মন্থনের মত বৃহৎ কার্যক্রমের খবর দেবাদিদেব মহাদেব জানতেন না। অথচ সমুদ্রমন্থনজাত গরল পান করে নীলকন্ঠ হয়ে বিশ্বের যাবতীয় জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। দেবর্ষি নারদ যখন জানতে পারলেন, মহাদেব খবর পাননি, ব্যথিত হলেন তিনি —
“সুরাসুর যক্ষ রক্ষ ভুজঙ্গ কিন্নর।
সবে সিন্ধু মথিল, না জানে মহেশ্বর।।
দেখিয়া নারদ মুনি হৃদয়ে চিন্তিত।
কৈলাসে হরের ঘরে হৈল উপনীত।।”
কৈলাসে পৌঁছে তিনি শিবদুর্গার চরণে প্রণাম করলেন। দেবী দুর্গা তাকে আসন দিলেন, আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। “নারদ বলেন, আমি ছিনু সুরপুরে।/শুনিনু মথিল সিন্ধু যত সুরাসুরে।।” বললেন, সকল দেবতা নানান সামগ্রী লাভ করেছেন মন্থনে, নরকূলও পেয়েছে নানান ধাতু, মহৌষধি। কেবল আপনি সকলের ঈশ্বর হয়েও কিছু পান নি, এমনকি জানতেও পারেন নি এ সংবাদ। এ শোকেই আজ আমি তত্ত্ব নিতে এখানে উপনীত হয়েছি।
“বিষ্ণু পায় কমলা কৌস্তভ-মণি-আদি।
ইন্দ্র উচ্চৈঃশ্রবা ঐরাবত গজনিধি।।
নানারত্ন পায় লোক, জল জলধর।
অমৃত অমর-বৃন্দ কল্পতরু বর।।
নানা ধাতু মহৌষধি পায় নরলোক।
এই হেতি হৃদয়ে জন্মিল বড় শোক
স্বর্গ মর্ত্য পাতালে আছয়ে যতজনে।
সবে ভাগ পাইল কেবল তোমা বিনে।
সে কারণে তত্ত্ব নিতো আইলাম হেথা।
সবার ঈশ্বর তুমি বিধাতার ধাতা।
তোমারে না দিয়া ভাগ সবে বাঁটি লৈল।
এই হেতু মোর চিতে ধৈর্য নাহি হৈল।।”
নারদের কথায় কোনো উত্তর দিলেন না মহাদেব, কিন্তু ক্রোধে কম্পিতা হয়ে উঠলেনব দেবী দুর্গা, বললেন,
“কণ্ঠেতে হাড়ের মালা বিভূষণ যার।
কৌস্তুভাদি-মণি-রত্নে কি কাজ তাহার।।
কি কাজ চন্দনে, যার বিভূষণ ধূলি।
অমৃতে কি কাজ, যার ভক্ষ্য সিদ্ধি-গুলি।।
মাতঙ্গে কি কাজ, যার বলদ-বাহন।
পারিজাত কিবা কাজ, ধুতুরা ভূষণ।।”
এরপরেই পূর্ব-বৃত্তান্ত এবং দক্ষের প্রসঙ্গ টানলেন দেবী। “জানিয়া উহারে দক্ষ পূজা না করিল।/সেই অভিমানে তনু ত্যজিতে হইল।।” দেবীবাক্য শুনে হাসলেন মহাদেব, বললেন, “বাহন ভূষণে মোর কিবা প্রয়োজন।/আমি লই তাহা, যাহা ত্যজে অন্য জন।।” তিনি পট্টাম্বর দিব্য-বাস নন, তিনি বাঘাম্বর; তিনি অগুরু চন্দন, কুঙ্কুম কস্তুরী না মেখে বিভূতিকে সমাদরে গ্রহণ করেছেন। মণি-রত্ন হার, মুক্তা প্রবাল ছেড়ে পরেছেন হাড়মাল। কানে ধুতুরা ফুলকে বিভূষণ করেছেন। রথ গজ বাহন পরিচ্ছদ ত্যাগ করে বলদ নিয়ে আছেন। দক্ষ-প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন তিনিও —
“অজ্ঞান তিমিরে দক্ষ মোহিত হইল।
মোহে মত্ত হয়ে দক্ষ যজ্ঞ যে করিল।।
সকল দেবেরে পূজি মোরে না পূজিল।
সমুচিত দণ্ড তার তখনি পাইল।।”
দেবী বললেন, বিভূতি-বৈভব-বিদ্যা যত্নে সঞ্চয় করেও যে সংসারে বিমুখ, সকলে তাকে কাপুরুষ বলেন। বললেন, সাগর সেঁচে সব রত্নধন মথে নিলো সবাই, কেউ তোমাকে একটিবার জানালেও না। “রত্নাকর মথি সবে নিল রত্নধন।/কেহ না পুছিল তোমা করিয়া হেলন।।” পার্বতীর এই কথায় ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন দেবাদিদেব, সমুদ্র-মন্থন স্থানে পৌঁছাতে বৃষভ সাজাতে নির্দেশ দিলেন।
“পার্বতীর হেন বাক্য শুনিয়া শঙ্কর।
ক্রোধেতে অবশ অঙ্গ কাঁপে থরথর।।
কাশীরাম কহে, কাশীপতি ক্রোধমুখে।
বৃষভ সাজাতে আজ্ঞা করিল নন্দীকে।”
দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিক হিসাবে দেবর্ষি নারদের ভূমিকা। পুরাণের বহু ঘটনাবলীতে দেখা যায়, নারদজী সংবাদ-বাহক। আজকের দিনের মতো কারও কেনা সাংবাদিক ছিলেন না তিনি, সত্য সংবাদ পরিবেশনে তিনি বরাবরই কৃতবিদ্য ছিলেন। অনেক সময় দানবেরাও তাঁর কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে দেবতাদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। হয়তো দেবাতারা বহু যুদ্ধে কোনঠাসা হয়েছেন, কিন্তু সবশেষে শুভ শক্তিরই জয় হয়েছে। সংবাদদাতা হিসাবে নারদজী ছিলেন সকলের ভালোবাসার পাত্র। বিশ্বের প্রথম সাংবাদিক দেবর্ষি নারদকে আজ নারদ জয়ন্তীতে প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই। প্রার্থনা করি, আগামী দিনে ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ — সংবাদমাধ্যম‘ তাদের যথোচিত কাজ সাধু উপায়ে করবেন, বিদেশের টাকায় কেনা যাবে না তাদের, সেই সমস্ত সাধু-সাংবাদিকেদের প্রেরণা জোগাবেন তিনি। নারদ! নারদ!
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)